somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মধ্যযুগীয় এবং ঐতিহাসিক একটি মন্দির আঙ্করভাট

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ কম্বোডিয়ার আংকরে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই মধ্যযুগীয় মন্দিরটি।এটি সুবিশাল এবং এই স্থাপনাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ একটি মন্দির।এই মন্দিরটি রাজা ২য় সূর্যবর্মণ ১২শ শতাব্দীতে তাঁর রাজধানী ও প্রধান উপাসনালয় হিসাবে নির্মাণ করেছিলেন ।
তখন থেকেই এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় স্থান হিসাবে বিবেচিত। প্রথমদিকে হিন্দু মন্দির হিসাবে ব্যবহার করলেও পরে এটি বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়।আঙ্করভাটের নির্মাণশৈলী খ্মের সাম্রাজ্যের স্থাপত্য শিল্পকলার অণুপম নিদর্শন। এটি কম্বোডিয়ার জাতীয় পতাকায় স্থান পেয়েছে এবং দেশটির প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।আঙ্করভাটে খ্মের মন্দির নির্মাণ কৌশলের দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, টেম্পল মাউন্টেন বা পাহাড়ি মন্দির ধাঁচ এবং গ্যালারি মন্দির ধাঁচ। এটি হিন্দু পুরাণের দেব-দেবীদের বাসস্থান মেরু পর্বতের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। এর চারদিকে রয়েছে পরিখা ও ৩.৬ কিমি দীর্ঘ প্রাচীর। ভিতরে ৩টি আয়তাকার গ্যালারি বা বেদি আকৃতির উঁচু এলাকা রয়েছে। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে স্তম্ভাকৃতির স্থাপনা। আংকরের অন্যান্য মন্দিরের সাথে পার্থক্য হল এটির সম্মুখ ভাগ পশ্চিমমুখী। মন্দিরটির বিশালত্ব, সৌন্দর্য ছাড়াও এর দেয়ালের কারুকার্যের জন্য এটি সারা বিশ্বে পরিচিত।


তখন মন্দিরটির আরাধ্যদেবতা ছিল বিষ্ণু। এটি সূর্যবর্মণের মূল মন্দির এবং রাজধানী হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। তবে মন্দিরের স্থাপনার সময়কার কোন লেখা বা সমসাময়িক কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় নাই বলে মন্দিরটির আদি নাম কী ছিল তার সঠিক কোনো ধারনা নাই।মন্দিরটি বর্তমানকালের সিয়েম রিপ শহরের ৫.৫ কিমি. উত্তরে, এবং প্রাচীন রাজধানী শহর বাফুওন এর সামান্য দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। রাজা সূর্যবর্মণের মৃত্যুর পর এর নির্মাণ কার্য বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এর দেয়ালের কিছু কারূকার্য অসমাপ্ত থেকে যায়। ১১৭৭ সালে আংকর শহরটি খ্‌মেরদের চিরাচরিত শত্রু চামদের হাতে পরাজিত ও লুণ্ঠিত হয়। এর পরে নতুন রাজা ৭ম জয়বর্মণ রাজ্যটিকে পূনর্গঠিত করেন। তিনি আঙ্করভাটের কয়েক কিমি উত্তরে আংকর থোম-এ নতুন রাজধানী ও বায়ুন নগরে প্রধান মন্দির স্থাপন করেন। .


রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে কম্বোডিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে। ফলে ১৪শ বা ১৫শ শতাব্দীতে আঙ্করভাট বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়, যা আজ পর্যন্ত বজায় আছে। আংকরের অন্যান্য মন্দিরের সাথে এর আরেকটি পার্থক্য হল যদিও ১৬শ শতাব্দীর পরে এটি কিছুটা অবহেলিত হয় তথাপি অন্যান্য মন্দিরের মতো এটি কখনোই পরিত্যক্ত হয় নাই। চারদিকে পরিখা থাকায় বন জঙ্গলের গ্রাস থেকে মন্দিরটি রক্ষা পায়। সেসময় মন্দিরটি সূর্যবর্মণের মরণোত্তর উপাধি অণুসারে প্রিয়াহ পিস্নুলোক নামে পরিচিত ছিল। আধুনিক নামটি, অর্থাৎ আঙ্করভাট নামটির ব্যবহার ১৬শ শতাব্দী হতে শুরু হয়। আর এই নামটির অর্থ হল নগর মন্দির। আংকর শব্দটি এসেছে নগর শব্দ হতে যা আসলে সংস্কৃত শব্দ নগর এর অপভ্রংশ। আর ওয়ত হল খ্‌মের ভাষার শব্দ যার অর্থ মন্দির।
পশ্চিমা পরিব্রাজকদের মধ্যে এই মন্দিরে প্রথম আগমন ঘটে পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারক আন্তোনিও দা মাগদালেনার। তিনি ১৫৮৬ সালে প্রথম এই মন্দির এলাকা ভ্রমণ করেন। তিনি লিখেছেন মন্দিরটি এমন অসাধারণ ভাবে নির্মিত যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। সারা বিশ্বে এরকম আর কোন ভবন বা স্থাপনার অস্তিত্ব নাই। এখানে রয়েছে খিলান এবং অন্যান্য কারুকার্য, মানুষের পক্ষে সম্ভাব্য সেরা সৃষ্টি। তবে পাশ্চাত্যে এই মন্দিরের কথা ছড়িয়ে পড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি অভিযাত্রী অনরি মৌহত এর ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমে। তিনি লিখেছিলেন, আঙ্করভাট কারুকাজ ও সুন্দর্য এমন যা সলোমনের মন্দিরকেও হার মানায়। মাইকেলেঞ্জেলোর মতোই কোন প্রাচীন শিল্পী এটি নির্মাণ করেছেন। আমাদের সবচেয়ে সুন্দর ভবন সমূহের সাথে এটি সমতূল্য। এটি এমনকী প্রাচীন গ্রিস বা প্রাচীন রোমের স্থাপনা গুলির চাইতেও অনেক বেশি রাজকীয়, সুন্দর। বর্তমানে এই দেশটি কম্বোডিয়া এলাকা যে বর্বরতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে, তার সাথে এই মন্দিরের বিশালতার এবং সৌন্দর্যের এক বিশাল ফারাক রয়েছে।


কম্বোডিয়ার পতাকায় আংকর ওয়ত প্রদর্শিত হয়েছে।অন্যান্য পাশ্চাত্যের পরিব্রাজকদের মত মৌহতও বিশ্বাস করতে পারেন নাই যে, খ্মেররাই এই মন্দির নির্মাণ করেছিল। তিনি ভুলক্রমে ধারণা করেন, মন্দিরটি রোম সাম্রাজ্যের সমসাময়িক। আঙ্করভাটের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটিত হয় এখানকার স্থাপত্যশৈলী ও শিলালিপি হতে, যা মন্দিরের সমস্ত এলাকা পরিষ্কার করার পরে প্রকাশ পায়। বিংশ শতাব্দীতে আঙ্করভাটের ব্যাপক সংস্কার সম্পন্ন হয়। সে সময় প্রধানত এর চারিদিকে গ্রাস করে নেয়া মাটি এবং জঙ্গল সাফ করা হয়।গৃহযুদ্ধ ও খ্মের রুজ শাসনকালে ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকগুলিতে সংস্কার কার্য বাধাগ্রস্ত হয়। তবে আঙ্করভাট এলাকায় পরে স্থাপিত মূর্তিগুলি চুরি যাওয়া ও ধ্বংস করে ফেলা ছাড়া মূল মন্দিরের খুব একটা ক্ষতি এসময় হয় নাই। বর্তমানে আঙ্করভাটের মন্দিরটি কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এটি দেশবাসীর গৌরব। ১৮৬৩ সালে প্রথম প্রবর্তনের পর থেকে কম্বোডিয়ার সব পতাকাতেই আঙ্করভাটের প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে। সারা বিশ্বে এটিই একমাত্র ভবন যা কোন দেশের পতাকায় প্রদর্শিত হয়েছে।

বাইরের দেওয়ালটি দৈর্ঘ্যে ১০২৫ মিটার, প্রস্থে ৮০২ মিটার, এবং উচ্চতায় ৪.৫ মিটার। এর চার দিকে ৩০ মিটার দূরত্বে ১৯০ মিটার চওড়া একটি পরিখা আছে। মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য পূর্ব দিকে একটি মাটির পাড় এবং পশ্চিম দিকে একটি বেলেপাথরের পুল রয়েছে। এই পুলটি মন্দিরের প্রধান প্রবেশদ্বার, এবং মন্দির নির্মাণের অনেক পরে যোগ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় যে, এর স্থানে পূর্বে একটি কাঠের পুল ছিলো।

মূল মন্দিরটি শহরের অন্যান্য স্থাপনা হতে উঁচুতে অবস্থিত। এতে রয়েছে তিনটি পর্যায়ক্রমে উচ্চতর চতুষ্কোণ গ্যালারি, যা শেষ হয়েছে একটি কেন্দ্রীয় টাওয়ারে। মান্নিকার মতে এই গ্যালারিগুলো যথাক্রমে রাজা, ব্রহ্মা, এবং বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। প্রতিটি গ্যালারির মূল বিন্দুগুলোতে একটি করে গোপুরা রয়েছে। ভিতরের দিকের গ্যালারিগুলোর কোণায় রয়েছে টাওয়ার। কেন্দ্রের টাওয়ার এবং চার কোনের চারটি টাওয়ার মিলে পঞ্চবিন্দু নকশা সৃষ্টি করেছে।

১৯৯০ এর দশক হতে আংকর ওয়তের রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। এর সাথে সাথে শুরু হয় পর্যটনশিল্প। ভারতের পুরাতাত্তিক সংস্থা ১৯৮৬ হতে ১৯৯২ সালের মধ্যে মন্দিরটিতে সংস্কারের কাজ করে। মন্দিরটি আংকরের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসাবে ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯২ সালে স্বীকৃত হয়। এতে করে মন্দিরের সংস্কারের জন্য অর্থায়ন ও কম্বোডিয়া সরকারের দ্বারা মন্দিরের সুরক্ষার কার্যক্রম সহজতর হয়েছে।জার্মানির অপ্সরা সংরক্ষণ প্রকল্প এই মন্দিরের অপ্সরা ও দেবতাদের ছবি সংবলিত কারুকার্যমন্ডিত দেয়ালের নকশাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করছে। সংস্থাটির সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রাকৃতিকভাবেই পাথর ক্ষয়ে যাওয়ায় দেবতামূর্তিগুলির ২০ শতাংশেরই খুব করুণ দশা। তার উপরে শুরুর দিকের সংরক্ষণকারীদের অনভিজ্ঞতার ফলেও অনেক ক্ষতি হয়েছে।সংস্কার কার্যের অন্যান্য দিকের মধ্যে রয়েছে ধ্সে যাওয়া অংশ মেরামত। যেমন, উপরের স্তরের পশ্চিম দিকের ২০০২ সাল থেকেই খুঁটি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।জাপানি বিশেষজ্ঞ্ররা ২০০৫ সালে উত্তর দিকের পাঠাগার মেরামত করেছেন। ২০০৪ সালে কম্বোডিয়াতে মোট পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১০ লাখের বেশি যার অন্তত ৫৭% আংকর ওয়তে যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন।পর্যটকদের আনাগোনার ফলে অল্প কিছু দেয়াল লিখন ছাড়া মন্দির এলাকার খুব ক্ষতি হয় নাই। মন্দিরের কারুকার্যকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পর্যটনশিল্পে লদ্ধ আয়ের ২৮% মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহার করা হয়।
ছবি ইন্টারনেট তথ্যসূত্রঃ Click This Link
http://www.talesofasia.com/cambodia-update-feb05.htm#million
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×