জানা না জানা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ( প্রথম পর্ব )
জানা না জানা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস (২য়পর্ব )
মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের সম্প্রসারণ
আফগানিস্তানের তিলিয়া তেপের প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে খৃষ্ট পরবর্তী ১ম শতাব্দির একটি বৌদ্ধ মুদ্রার হদিস পাওয়া যায় যেটি প্রাচীন ভারতের বলে জানা যায়। মুদ্রাটির বিপরীত পিঠে একটি চলন্ত সিংহকে দেখা যায় যার সম্মুখভাগে নন্দিপদ,ষাঁড়ের খুর সম্বলিত এক ধরনের প্রাচীন প্রতীক রয়েছে, এবং সেখানে খরোষ্ঠী লিপিতে সিংহটিকে বর্ণনা করা হয়েছে Sih vigatabhay হিসেবে, যার মানে হলো,যে সিংহ ভয় দূরীভূত করে।বৌদ্ধ ধর্মে মহাযান শাখায় বুদ্ধকে সিংহ, হাতি, ঘোড়া এবং ষাঁড়ের মতো প্রাণীদের দ্বারা প্রতিকায়িত করা হয়। এছাড়া জোড়া পায়ের পাতা দিয়েও অনেক সময় বুদ্ধের স্বরূপকে বুঝানো হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তারা এই প্রতীকগুলোকে নন্দিপদ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এগুলো আসলে বিভিন্ন প্রতীকের একটি যৌগিক সংমিশ্রণ বলে ধরে নেয়া হয়। প্রতীকের উপরের অংশ মূলত বৌদ্ধ ধর্মের মধ্য পন্থাকেই রূপায়িত করে। প্রতীকের মধ্যভাগের গোলাকৃতি অংশটি দ্বারা বুঝায় ধর্ম-চক্র। এইভাবেই পুরো প্রতীকই আসলে ধর্ম-চক্র অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের স্বরূপ-কেই প্রতিনিধিত্ব করে। এইভাবে মুদ্রার দুই পিঠে চিহ্নিত প্রতীক দুইটির সম্মন্বয় রূপ মিলে মূলত বৌদ্ধ ধর্ম-চক্র ঘুরাচ্ছে, এটিই বুঝানো হয়। এভাবেই ভারতের সিংহের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত বারাণসীর সারনাথ শহরে অবস্থিত বৌদ্ধ নিদর্শনের জায়গাগুলোর স্তম্ভে উল্লেখিত সিংহ, হাতি, ঘোড়া এবং ষাঁড় কর্তৃক নন্দিপদ ঘুরানো দ্বারা মূলত বুদ্ধের ধর্ম চক্র ঘুরানোর স্বরূপকে প্রতিকায়িত করে। আরও একটি প্রতীক পাওয়া যায় যেখানে একজন ক্লামাইস বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে পরিহিত সম্রাট ও উচ্চ পদস্থ ব্যাক্তিদের পোশাক এবং মাথায় একটি কাপড় পরিহিত উলঙ্গ-প্রায় একজন ব্যাক্তি ধর্মচক্র আবর্তন করছেন। খরোষ্ঠী লিপিতে এই প্রতীকের বর্ণনাতে বলা হয়েছে, ধর্মচক্র-প্রাবাতা অর্থাৎ যিনি আইনের ধর্মচক্র ঘুরাচ্ছেন। এই প্রতীক থেকে এটা বলা হয় যে, এটি বুদ্ধকে নিয়ে উপস্থাপন করা প্রাচীন প্রতীকগুলোর মধ্যে একটি।ক্লামাইস পরিহিত মানুষটির মাথার কাপড় দ্বারা বুঝানো হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম নির্দেশিত মধ্যপথ। এভাবেই মাথার কাপড় পরিহিতা ব্যাক্তিদের মূলত মধ্যপথ অবলম্বনকারি হিসেবে পরিচায়িত করা হয়। একইভাবে সিন্ধু সভ্যতার সীলমোহরে ৯ জন মহিলার হদিস মিলে যাদের মাথাতেও একই ধরনের কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল।তাছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবেত্তাদের দ্বারা যেহেতু বৌদ্ধ সাহিত্য ও বুদ্ধের শারীরিক প্রতীকের কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হয় নি, তাই এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে পাওয়া মুদ্রা, সীলমোহর এবং অন্যান্য শিলালিপিতে দেখতে পাওয়া প্রতীকগুলো নিয়ে দেওয়া বর্ণনাগুলোকে অনেক সময় কল্পনা ও ব্যাখ্যার ভুল হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
কুষাণ সাম্রাজ্যের সম্রাট কণিষ্কের মুদ্রা, যার বিপরীতে বুদ্ধের প্রতীক দেখা যায় যেখানে বুদ্ধের নাম গ্রীক ভাষায় বোড্ডো লেখা হয়েছে।
মহাযানের উত্থানের সময় সীমা
বেশ কয়েকজন পন্ডিতদের মতে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় বসবাসরত মহাসাংঘিক নামক এক প্রাচীন আদি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের আবির্ভাব হয়েছিল যা প্রাচীন মহাযানের সূত্রগুলোর মধ্যে একটি।প্রাচীন মহাযান সূত্র হতে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের প্রথম দিককার সংস্করণের যে উল্লেখ পাওয়া যায় তাতে অক্ষোভ্য বুদ্ধের পরিচয় মিলে যেটি খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকেই রচিত হয়েছিল। তাছাড়াও বিখ্যাত ভারতবিদ্যা বিশারদ এ কে ওয়ার্ডও এই অভিমত ব্যাক্ত করেন যে বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার উত্থান দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের তৎকালীন অন্ধ্রদেশেই উত্থান ঘটেছিল।পন্ডিত অ্যান্থোনি বার্বার এবং শ্রী পদ্মও একই অভিমত ব্যক্ত করেন যে নাগার্জুন, দিগ্নাগ, চন্দ্রকীর্তি, আর্যদেব, ভাববিবেক এর মতো যেসব বৌদ্ধ পন্ডিতরা মহাযান শাখায় ভূমিকা রেখেছিল তাদের সবারই বসবাস ছিল বর্তমান দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে। আর মহাযান শাখার উত্থানের জায়গাগুলো মূলত অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা উপত্যকার নিচু ভূমি সম্বলিত গুন্টুর জেলার অমরাবতী, নাগার্জুনকোন্ডা, জগ্গয়াপেতা এর মতো অঞ্চলে অবস্থিত। জাপানী ইতিহাসবেত্তা আকিরা হিরাকাওয়াও বলেন বিভিন্ন প্রামাণিক দলিলসমূহ এটাই বলে যে প্রাচীন মহাযান গ্রন্থগুলো দক্ষিণ ভারতেই সম্ভূত।
খৃষ্ট পরবর্তী প্রথম শতাব্দিতে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপ্তি এবং ব্যবসায় বাণিজ্যের যাত্রাপথ।
দ্বি-চতুর্থাংশ মহাসঙ্গীতি
চতুর্থ মহাসঙ্গীতির উদ্ভব হয় খৃষ্ট পরবর্তী ১০০ শতকে কুষাণ সাম্রাজ্যের সম্রাট কণিষ্কের তত্ত্বাবধানে। ধারণা করা হয় যেখানে চতুর্থ মহাসঙ্গীতির উত্থান হয়, সেটি বর্তমানে কাশ্মীরের জলান্ধার নামক জায়গা। থেরবাদ বৌদ্ধ শাখা প্রায় ৪০০ বছর আগে শ্রীলঙ্কাতে পালি ভাষায় তাদের চতুর্থ মহাসঙ্গীতির আয়োজন করেছিল। তাই চতুর্থ মহাসঙ্গীতি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায় যার চারভাগের দুই ভাগ শ্রীলংকাতে আর বাকি দুই ভাগ কাশ্মীরে।অভিধর্ম নামক বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে এটা জানা যায় যে সম্রাট কণিষ্ক বসুমিত্রের নেতৃত্বে ৫০০ জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দ্বারা এই চতুর্থ মহাসঙ্গীতির আয়োজন করেন। সেখান থেকে জানা যায় যে সেই মহাসঙ্গীতিতে তিন লক্ষ শ্লোক এবং নয় মিলিয়ন বক্তব্য সংরক্ষণ করা হয়। এই মহাসঙ্গীতির ফলে সবচেয়ে যে বড় ফলাফল পাওয়া যায় তা হলো মহা বিভাষা নামক গ্রন্থের সংকলন এবং সর্বস্তিবধিন অভিধর্মের সারসংক্ষেপণ রচনা।
বিভিন্ন ভাষাবিদরা এটাও অভিমত করেন যে এই মহাসঙ্গীতির ফলে সর্বস্তিবধিন অভিধর্ম গ্রন্থের ভাষারূপের পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল যেখানে প্রাকৃত ভাষা থেকে এটিকে সংস্কৃত ভাষায় পরিবর্তন করা হয়েছিল। ভাষারূপের পরিবর্তন সাধিত হলেও ধর্মীয় গ্রন্থটির মূল উপজীব্য হারিয়ে যায় নি।তাছাড়াও তৎকালীন ভারতে উচ্চ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ও প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক এবং চিন্তাবিদদের ভাষা সংস্কৃত হওয়ায় সর্বস্তিবধিন অভিধর্ম গ্রন্থটি ভাষা রূপান্তরে আলাদা তাৎপর্য পায়। আর এইভাবে ভাষারূপের পরিবর্তন সাধন করে সর্বস্তিবধিন অভিধর্ম গ্রন্থটি ভারতের বহু চিন্তাবিদ এবং মানুষদের মধ্যে পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। আর ঠিক এই কারণেই বহু বৌদ্ধ পন্ডিতদের মধ্যে তাদের অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থের শ্লোক ও বক্তব্যগুলো সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করার ঝোঁক বেড়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যান্য শাখা ধর্মী গ্রন্থ অনুবাদে ব্যস্থ হয় পরলেও থেরবাদ শাখা কিন্তু সে দিকে পা বাড়ায় নি। কারণ জীবিত অবস্থায় বৌদ্ধ স্পষ্টভাবে বারণ করে গিয়েছিল তার দেয়া বাণীসমূহ কোন বিশেষ ধর্মের উচ্চমার্গের ভাষায় যেন লিপিবদ্ধ করা না হয়,বরং তা যেন কোন স্থানীয় নিচুমার্গের ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এতো কিছুর পরেও থেরবাদ শাখায় ধর্মীয় গ্রন্থগুলো যে নিচু শ্রেণীর যে পালি ভাষায় রচিত হয়েছিল, সেই পালি ভাষা কালক্রমে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ৯:৫৯