শেষ বিকেলের নরম রোদে চক্রাকারে উড়তে উড়তে চিলটা আরও উপরে উঠে গেল। চিলটাকে দেখে সবুজের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। সে গাঢ় স্বরে কবিতার লাইনগুলো আবৃত্তি করতে শুরু করল-
“হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!”
পুরো কবিতাটাই হয়তো আবৃত্তি করতো সে, কিন্তু মাঝ পথে মিতিকে মনে পড়ে যাওয়ায় বিমর্ষ হয়ে পড়ল। তাই আবৃত্তিটা আর এগিয়ে নেয়া গেল না।
মিতি মানে জ্যামিতি বা পরিমিতি নয়; এই মিতি হল পরীমিতি। রূপকথার বইয়ে পরীদের যেসব বর্ণনা থাকে ঠিক সেরকম। শুধু এর দুটি ডানা নেই। মিতি দেখতে পরীর মত সুন্দর বলে সবুজ তার নাম দিয়েছে পরীমিতি। এই কবিতাটা মুখস্থ করেছিল মিতিকে শোনানোর জন্যে। আবৃত্তিটা সবুজ ভালোই করে। তবে সমস্যা হল সে কবিতা মুখস্থ করতে পারে না। তাকে দেখে দেখে আবৃত্তি করতে হয়। কষ্ট করে মুখস্থ করলেও সেটার অবস্থা হয় খারাপ। ছোটবেলায় কোন ক্লাসেই সে কবিতায় ভালো নম্বর পেত না। মিতি কবিতা-পাগল। হঠাত হঠাত ফোন করে বলত, একটা কবিতা শোনাও না। কিন্তু কবিতার বই ঘেঁটে কবিতা বের করতে যে সময় লাগত ততক্ষণে সে টুক করে লাইন কেটে দিত। তাছাড়া বাইরে কোথাও গেলে তো আর সব সময় কবিতার বই সংগে নেয়া যায় না। তাই সে বেশ কিছু কবিতা কষ্টে-সৃষ্টে মুখস্থ করে রেখেছিল। মিতির স্মৃতি জড়িয়ে আছে এরকম যে কোন কাজেই তার মিতিকে মনে পড়ে যায়। সবুজ প্রাণপণ চেষ্টা করে মেয়েটাকে ভুলে থাকতে, কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন দৈনিক অসংখ্যবার করে বিভিন্ন প্রসঙ্গে সে এসে পড়ে। এ এক যন্ত্রণা বটে।
চিলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সবুজ ভাবলো, একটা কঠিন কাজ পেলে ভালো হত। সারাদিন কাজের জটিলতায় আটকে থাকলে যখন তখন মিতি হানা দিতে পারতো না। কিন্তু কঠিন কাজ কে দেবে তাকে? তার মাথা ইদানিং ঠিকমত কাজ করছে না। আগের চাকরীটাই তো চলে গেল। সেখানেও মিতি। ঘটনাটা এরকম-
বস তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তৈরি করতে দিয়েছিলেন। সবুজ খুব মনযোগ দিয়েই ফাইলটি তৈরি করল। বসের কাছে ফাইলটি জমা দিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে আসার পর আবার ডাক পড়ল। বসের ঘরে গিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম প্রশ্ন,
‘মিস্টার সবুজ, আর ইউ ওকে?’
‘ইয়েস স্যার, হান্ড্রেড পারসেন্ট।’
‘আর ইউ শিওর?’
‘শিওর স্যার।’
তখন বস একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হোয়াট ইজ ইট?’
সবুজ দেখল, পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে অসংখ্যবার টাইপ করা- মিতি মিতি মিতি মিতি মিতি মিতি মিতি...................................................
যদিও ফাইলটি সবুজ একাই তৈরি করেছে, তবু তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এতো বড় একটি ভুল তাকে দিয়ে হয়েছে।
বস বললেন, ‘ইউ আর টোটালি এবসেন্ট মাইন্ডেড অর মেন্টালি ইল। সরি, ইউ আর নট ফিট ফর দিস ইম্পরট্যান্ট পোস্ট।’
সবুজ বিনা বাক্য ব্যয়ে ছাঁটাইপত্র নিয়ে বাসায় চলে এলো। সে ভাবতে পর্যন্ত পারছিল না, একটা মেয়ের চিন্তা তাকে এতটা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
মিতির চিন্তা মাথা থেকে সরাতে একটা ধাঁধা নিয়ে ভাবতে বসল সে। ধাঁধাঁটি দিয়েছে তার ভাগ্নে ফাহিয়েন।
“চলিতে চলিতে তার মাথা হল ভার
মাথাটি কাটিয়া দিলে চলিবে আবার। কী জিনিস?”
কিছুক্ষণ চিন্তা করে তার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেল। হয়তো উত্তরটা খুব সহজ, কিন্তু তার মাথা কাজ করছে না। মিতি আবার ধাঁধাঁর উত্তর বের করতে ওস্তাদ। সবুজ কখনোই কোন ধাঁধাঁ দিয়ে তাকে আটকাতে পারতো না।
মিতির পার্সোনাল কনট্যাক্ট নম্বরটি বন্ধ। না হলে তাকে ফোন করে জেনে নেয়া যেত। বাসার ল্যান্ড ফোনে কল্ করা যেতে পারে, কিন্তু কল্ টা হয়তো মিতি রিসিভ করবে না এই ভেবে বিরত থাকল। এর আগে একদিন ফোন করে ধাক্কা খেয়েছিল। কল্ রিসিভ করেছিলেন মিতির বাবা। গমগমে কণ্ঠে বললেন-
‘হ্যালো, আতাহার আলী বলছি। আপনি কে বলছেন?’
সবুজ এম্নিতেই ভীতু প্রকৃতির। তার কনফিডেন্স লেভেল একেবারে শূণ্যের কোঠায়। তারপর আবার মিতির বাবাকে সে ভয় পায়। ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ শুনলেই কেন জানি গলা শুকিয়ে যায়। তা না হলে সেদিন বলতো,
‘আংকেল, আমি সবুজ।’
জবাবে তিনি হয়তো বলতেন, ‘সবুজ কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি যে বললেই চিনে যাব?’
তখন সে বলতো, ‘আমি সবুজ। আমি আপনার মেয়ে মিতিকে ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালোবাসে। আমরা বিয়ে করতে চাই।’
‘তোমার কী যোগ্যতা আছে?’
‘আমার ভালোবাসা আছে।’
‘জীবন তো সিনেমা নয় যে শুধু ভালোবাসা দিয়েই সব মধুর করে ফেলা যাবে।’
‘হান্ড্রেড পারসেন্ট ভালোবাসা থাকলে যেটুকু তেতো থাকে তার অর্ধেক মিষ্টি করে নেয়া যায়। আর বাকীটা সয়ে নেয়া যায়।’
‘বাজে কথা বলবে না। বাস্তবতা সামনে রেখে কথা বল।’
‘বেশ। তাহলে আমি বলব জীবন একটা টক-ঝাল-মিষ্টি চাটনী, যেখানে তিতকুটে স্বাদও থাকে। সেটুকু থাকতে দেয়া উচিত।’
এগুলো সবুজের কল্পনা। কিন্তু বাস্তব হোলো, সেদিন মিতির বাবার প্রশ্নের উত্তরে সবুজ বলেছিল,
‘আমি ধামরাই সেনেটারী মার্ট থেকে বলছি। আপনারা কি একশ’ পিস টাইলস অর্ডার করেছিলেন?’
সবুজের শুধু যে অমনোযোগীতার সমস্যা হচ্ছে না তাই নয়, তার আরও একটা সমস্যা হচ্ছে। হঠাত হঠাত সে কাউকে কাউকে চিনতে পারে না। সেদিন পাশের বাসার সুবর্ণা এসেছিল এক বাটি দুধ চিতই পিঠা নিয়ে। পুরো পনেরো মিনিট গল্প করার পরও সে মেয়েটাকে চিনতে পারলো না। শেষে বলেই ফেলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনি যেন কে?’
সবুজ মজা করছে ভেবে সুবর্ণা হাসতে হাসতে চলে গেল। একই ঘটনা ঘটল তার নিজের বড় ভাইয়ের ক্ষেত্রে। বড় ভাই এসেছিলেন গ্রাম থেকে। বড় ভাইয়ের সাথে পুরো এক ঘন্টা সময় কাটিয়েও তার সন্দেহ হচ্ছিল আসলে উনিই তার বড় ভাই কিনা। সবুজ খুবই আপসেট হয়ে পড়লো। কথার এক পর্যায়ে বড় ভাই একটা মেয়ের ছবি বের করে বললেন, ‘মেয়েটাকে পছন্দ হয় কিনা দেখ তো।’
সবুজ অনাগ্রহের সাথে ছবিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলো। মেয়েটা পুরোপুরি মিতির মত দেখতে। মিতি নয় তো? কিন্তু নিজের মনকে বোঝাল, সেটা আর সম্ভব নয়। কারন- মিতির অন্য কারো সাথে বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। গল্প-উপন্যাস-নাটক-সিনেমায় বিয়ের আসর থেকেও মিতিরা ফিরে আসে। কিন্তু বাস্তবের মিতিরা কখনো ফিরে আসে না। তাদের ধনী পরিবারের কোন একটি ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। একটা সময় তারা সুখী স্ত্রী কিংবা সুখী মাতা হয়। তাদের কোলে বাচ্চা দেখলে প্রেমিকেরা ঈর্ষায় কাতর হয়। মনে মনে ভাবে, ‘সে তো আমারও হতে পারতো।’
‘কিরে, কিছু বললি না তো। মেয়েটার সাথে কথা বলবি?’
সবুজ অন্যমনস্ক থেকেই উত্তর দিল, ‘হু।’
মেয়েটির নাম পুষ্প। রেস্টুরেন্টে তারা দুজন মুখোমুখি বসে আছে। সবুজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। নাহ, মিতির কোন ছাপ নেই এর চেহারায়। ছবিতে মিতিকে দেখাটা তার মাথার সমস্যা ছিল। তার মনে হোল, যদি কোনদিন মিতি ফিরেই আসে, সেদিন সবুজ তাকে চিনতে পারবে তো? যদি না পারে? যদি সে মিতিকে জিজ্ঞেস করে বসে, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনি যেন কে?’, তাহলে কি সে তাকে ছেড়ে আবার চলে যাবে? নাকি ‘তুমি পারো বটে’ বলে হেসে নাকটা টিপে দিবে? আবার মনে হোল, যদি এই মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হয় তাহলে কেমন হবে? এই মেয়েটি কি মিতির মতো হবে? একে ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করে কি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাওয়া যাবে? পুরো কথাটি শেষ করার আগেই কি মেয়েটা বুঝতে পারবে সে কী বলতে চায়? এই মেয়েটা কি হঠাত হঠাত আবৃত্তি শোনার জন্য বায়না করবে? উথাল-পাথাল জোছনায় কি মদির গলায় গান ধরবে-চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে...? এই মেয়েটার দিকে তাকালে কি বুকের ধুকপুকুনি দশ গুন বেড়ে যাবে? একে পেলে কি চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করবে-আমি তাকে পেয়েছি, তাকে পেয়েছি? এমন কি আর কেউ কোনদিন হবে? সবুজের বুকের ভেতর এক সাথে একশ’ একটা বেহালা কেঁদে উঠল।
পুষ্প মেয়েটির কোন দোষ ছিল না। কিন্তু সে বড় ভাইকে বলে দিল সে এখন বিয়ে করবে না। বলল তার চাকরী নেই। কাজেই সে বউ পালতে পারবে না।
বসন্তের শেষ দিকে এক বিকেলে কেউ একজন ভীষণ অস্থির হয়ে সবুজদের ডোরবেল চাপতে লাগল। মনে হচ্ছিল তার ভয়ংকর তাড়া। এক্ষুণি, এক্ষুণি দরজা না খুললে পৃথিবী রসাতলে চলে যাবে। ঠিক এরকম করে মিতি বেল বাজাত। সবুজের প্রচন্ড জ্বর। জ্বর নিয়েই সে মোহ গ্রস্তের মত দরোজার দিকে এগিয়ে গেল। সবুজের মনে হোল, জীবন কি মিলনাত্মক গল্প হয় না? মিতির কি বিয়ে ভেঙে যেতে পারে না? ওপাশের মানুষটি কি তার পরীমিতি হতে পারে না? আগন্তুক ডোরবেল হতে আঙ্গুল সরাচ্ছিল না।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:২৭