মিরপুরের ওভার ব্রীজটা আজকে বেশ ব্যাস্ত । ফার্মগেটে ভীর বেশি থাকে বলে ওদিকে যায়না চন্দ্রা । অবশ্য ভিরের মধ্যেই কাস্টমার পাওয়া সহজ । বেশি মানুষ দেখলে নিজেকে তাদের সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে করে চন্দ্রার । আর মানুষের সাথে তুলনা করলে নিজেকে শুন্য মনে হয় । অবশ্য চন্দ্রিমা উদ্যান, বোট্যানিক্যাল, বলধা গার্ডেন কিংবা রমনা পার্কেও কাস্টমার সহজেই পাওয়া যায়, কিন্তু অন্ধকার চন্দ্রার কাছে দুঃস্বপ্নের মত লাগে । তার উপর পাতিনেতা, পুলিশ ও চাটুকারদের আনাগোনা বেশি ঐদিকটায় । কাজ সারতে পারলে টাকা না দিয়েই চম্পট দেয় ! শালা !
ছোট্ট একটা দীঃর্ঘশ্বাস হজম করে চন্দ্রা । দুঃস্বপ্নের সেই প্রথম রাত তার স্মৃতিপটে এখোনো ভাসে ।
ঢাকা ছিলো তার স্বপ্নের শহর । গ্রামের পরিবেশ, মা-বাবার চাপ, সারাদিন নানান কাজ করেও ক্ষুধার কষ্ট ! বিপরিতে সে দেখতে শুরু করেছিলো রঙ্গিন স্বপ্ন । অজানা অচেনা একজন স্বপ্নের তুলিতে রং লাগাতো প্রতিদিন । অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষনের ডাক এলো ।
হ্যা । মোবাইলেই জয়ের সাথে ওর পরিচয় । জয় ? নাকি অন্যকোনো নাম আছে ওর ? কে জানে ! ওর কাছে পরিচয় দিয়েছিলো অফিসের এক কর্মকর্তা হিসেবে । একজন মানুষ যে লাগাতার সবগুলো কথা মিথ্যা বলতে পারে এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি না হলে সে জীবনেও ভাবতে পারতো না ! এখন অবশ্য নিজের দোষও খুজে পেয়েছে চন্দ্রা । একজন মানুষকে একদমই না জেনে এতোটা বিশ্বাস করা শুধু ভুলই নয়, মস্ত অপরাধও বটে । সেই অপরাধের শাস্তি সে পাচ্ছে ।
পদ্মা তীরের কোনো এক ছোট্ট গ্রামে তার নিবাস ছিলো । জয় বলেছিলো লঞ্চ ঘাটে আসলেই যেনো পারুল লঞ্চে উঠে পরে । রঙ্গিন স্বপ্নে মোহাচ্ছন্ন পারুল একবারও ভাবেন বৃদ্ধা মা বাবা কিংবা ছোট বোনের কথা ।
নদীর মাঝে সূর্য্য হারিয়ে যাবার পরই তার দুঃস্বপ্নের শুরু । যেনো সূর্যের সাথে তার রঙ্গিন স্বপ্নগুলোও ডুব দিয়েছে নদীতে । পরেরদিন ভোরে পূর্বাকাশে সূর্য ঠিকই উঠেছিলো, কিন্তু তার স্বপ্ন আর ফিরে আসেনি । লঞ্চের কেবিনে জয় জোড়াজোরি শুরু করলে কিছুক্ষন ধস্তাধস্তির পর হাল ছেড়ে দিয়েছিলো পারুল । জয়ের সেই ভয়ংকর রুপ তার কলিজায় কাপন ধরিয়ে দিয়ে ছিলো । কিন্তু তখনও সে কল্পনাও করেনি এরচেয়ে হাজারগুন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন তার জন্য অপেক্ষা করছে ! ঢাকায় এসে সদরঘাটের কোনো এক বডিংয়ে ওঠার পর একবারের জন্যও বাইরে বেড়োতে দেয়নি জয় । তার শরীরের উপর জয়ের অনধিকার চর্চাটা একসময় স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলো । একসপ্তাহ এভাবে কাটার পর জয় অফিসে যাওয়ার কথা বলে বেড়োলো । বলেছিলো ফিরতে দেরী হবে ।সেই দেরী এতো লম্বা হলো যে তার ফেরার সময়টা আর আসলো না । একদিন, দুদিন, তিনদিন ! নাহ ! জয় চম্পট দিয়েছে । হোটেলের লোক তার কাছে আসলো টাকার জন্য । পারুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো । তার কাছে থাকা জয়ের একমাত্র মোবাইল নম্বরটি চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো । কিন্তু তার কান্নায় অ্যাতোটুকু মন গলেনি হোটেল ম্যানেজারের । দুদিন উপর্যপূরি ধর্ষন শেষে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বেড় করে দিয়েছিলো সে ।
ভেবেছিলো সুইসাইড করবে । কিন্তু কিভাবে করবে ভাবতে গিয়ে আবিস্কার করলো নিজেকে হত্যা করার সাহসটুকু এখোনো অর্জন করা হয়নি ! রাস্তায় উশকো খুশকো অবস্থায় হাটতে ছিলো । কেউ একজন বারবার তার গায়ে ধাক্কা দিছিলো কোনো কারন ছাড়াই । পারুল অসহায় চোখে তার দিকে তাকালে সে জিজ্ঞেস করেছিলো রেট কতো ?
মাথাটা ম্যাজিকের মতো চক্কর দিয়ে উঠলো । দুদিনে তেমন কিছু পেটে পড়েনি পারুলের । আর যে সম্ভ্রম ইতোমধ্যে হাড়িয়েছে তার জন্য মায়া করে লাভ কী ?
এরপর অনেক জল গড়িয়েছে যমুনায় । এই শহর তাকে শিখিয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তবতা । প্রথম কদিন রাস্তায় পার্কে থাকতে হতো রাতে । বলাই বাহুল্য সেটা মোটেও স্বস্তির ছিলো না । কিন্তু ততদিনে ওটাকে কিছু মনে করতো না সে । পরে বস্তির একটা ছোট্ট রুম ভারা নিয়েছিলো কমলাপুরে ।
তিন বছর আগের কথা । যখন ওভারব্রীজে ছেলেগুলো একটা আরেকটাকে বলতো 'ওই দ্যাখ ! একটা মাগী' কষ্টে বুক ফেটে যেতো পারুলের । এখন সেই কষ্টের উপর পাথরের পাহার চাপা দিয়েছে । মা বাবার দেয়া পারুল নামটাও ছুরে ফেলে দিয়েছে । ওই নামে কেউ ডাকলেই মায়ের কথা মনে পড়ে । মা তাকে দিনে হাজারবার ঐ নামে ডাকতো ।
গ্রামের সমাজ, তার পরিবার ও আত্বীয়দের কথা ভেবে এই তিন বছরে তার ঘরে ফেরার কথা মনে হয়নি একবারও । কিন্তু ঘর বাঁধার যে রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে সে ঘর ছেরেছিলো সেই স্বপ্নের প্রেতাত্বা তাকে তাড়িয়ে বেরায় প্রতি মুহুর্তে ।
গাড়ির হুইসেলের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গলো চন্দ্রার । চন্দ্রা ? হ্যা ! এখন ত সে চন্দ্রাই !
রাস্তার ঐ পাড়ে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে । গত কয়েক মাস আগে । মিরপুরে আসার পরথেকেই মাঝে মাঝে লোকটা তাকে ফলো করতো । তিন কোটি লোকের এই ঢাকা । এখানে মেয়েদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার দায়িত্বে বিভিন্ন বয়সের বহু পুরুষ নিজেকে নিয়োযিত রাখে । তাই প্রথমে গা করেনি চন্দ্রা । একদিন কথা বলতে আসলো । কিন্তু (হয়তো লজ্জায়) কথাই বলতে পারছিলো না । চন্দ্রাই সাহসী হয়ে জিজ্ঞেস করছিলো কিছু লাগবে কিনা !
এই প্রশ্নের জবাবে অনেকেই ন্যাকার মত প্রশ্ন করে 'কী ?' যেনো ফিডার খায় ! কিন্তু সে জিজ্ঞেস করেনি । সরাসরিই জানতে চাইছে রেট কতো ? স্বাধারনত চালাক ক্লায়েন্টরা অল্প কিছু দিয়ে কেটে পড়ে । কিন্তু রেট জানতে চাওয়ায় চন্দ্রা এক হাজার হাকিয়ে বসলো । লোকটা আর বাক্যবায় করেনি । এরপর প্রায়ই আসে লোকটা । টাকা দিয়ে কাজ সেরে চলে যায় । আজ লোকটা ঘুড়ঘুর করছে । কাছে আসছে না । আঁড় চোখে তাকিয়ে দেখছে ।
চন্দ্রা এগিয়ে গেলো । 'ক্যামন আছেন'
'ভালো' লোকটির সংক্ষীপ্ত জবাব ।
'এদিকে ঘোড়াঘুড়ি করছেন ? কোনো কাজ আছে নিশ্চয়ই !'
'না মানে , হ্যা ! একটা কাজ ছিলো !'
চন্দ্রা বুঝতে পারছে লোকটা তার সাথে কথা বলতে চাইছে , কিন্তু কথা খুজে পাচ্ছে না ।
'আপনার তারা না থাকলে চলুন কোথাও বসে গল্প করি !'
লোকটি জানতে চাইলো কোথায় !
'স্টোডিয়ামে যাওয়া যেতে পারে'
লোকটা গাঁই গুঁই করছিলো । চন্দ্রা এক প্রকারের জোর করেই নিয়ে গেলো ।
আগে এমনটা কখোনো করেনি । লোকটার কাছ থেকে বেশি টাকা নেয়ার কারনে তার প্রতি একধরেন দূর্বলতা অনুভব করছিলো চন্দ্রা ।
কথা বার্তায় লোকটা একদমই আনাড়ি । চন্দ্রা অল্পতেই বুঝে ফেললো পকেট খালি হওয়া সত্বেও তাকে দেখতেই লোকটির গোলচত্বরে আসা । চন্দ্রা সাত পাচ না ভেবেই এক প্রকারের জোর করেই তাকে রুমে নিয়ে গেলো । শেষ মুহুর্তে লোকটি বলেই ফেললো তার কাছে টাকা নেই !
'মিরপুর এসেছিলেন ক্যানো?'
লোকটি মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইলো ।
'ওভারব্রীজে ওরকম করে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন ক্যানো ?'
এবারও নিরব তিনি । তার অসহায়ত্ব দেখে চন্দ্রা হেসে ফেললো । 'চলুন , আজকে টাকা লাগবে না !'
লোকটি অবাক চোখে ওর দিকে তাকালো । চন্দ্রা বললো 'আপনি আমাকে মনে করে দেখতে এসেছেন, এটাই আজকে আমার বিনিময় !'
পরেরদিন চন্দ্রা মিরপুরে দাড়িয়ে ছিলো । শুধু পরেরদিন নয় ! পরেরদিনগুলো । প্রান আকুতি করে চাইছিলো লোকটি আবার কবে আসবে ।
কিন্তু তারপর আর তাকে মিরপুর ওভারব্রীজে দেখা যায়নি ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৫