হুমায়ুন আজাদের কবিতা : অন্ধকারের পথে আলোকবর্তিকা
তপন বাগচী
বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৭) সৃষ্টিক্ষেত্রের সবচেয়ে কম আলোচিত এলাকার হচ্ছে কবিতা। ষাটের দশকের শেষপাদের একজন কবি হিসেবেই তাঁর উত্থান, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা। পেশাগত জীবনের চাহিদা পূরণের জন্য ভাষাতত্ত্বচর্চা এবং পরে সংবাদপত্রের কলামনিবন্ধকার হিসেবেও তাঁর প্রতিপত্তি তৈরি হয়। গবেষণাগ্রন্থ নারী তাঁকে খ্যাতি ও পরিচিতি দেয়। প্রাবন্ধিক হিসেবেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিশুসাহিত্যেও তাঁর অবদান সুবিদিত। কিন্তু তিনি শেষতক স্থিত হলেন উপন্যাস-রচনায়। তাঁর উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হয়েছিল, একথা মেনে নিয়েও বলা যায় যে, ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আজাদের চেয়ে কবি হুমায়ুন আজাদ ও প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদ বেশি শক্তিমান।
হুমায়ুন আজাদ একসময় বাজারকাটতি উপন্যাসকে বলতেন ‘অপন্যাস’। দুইজন জনপ্রিয় উপন্যাসিককে তিনি অপন্যাসিক বলতেন। কিন্তু একসময় তিনিও বাজারকাটতি উপন্যাসের দিকে ঝুঁকলেন। ভালো কবিতা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি আখ্যান রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লে। আর এই উপন্যাস লেখার কারণেই তাঁকে প্রাণ দিতে হলো। সাহিত্যের জন্য তিনি শহিদ হয়েছেন। আমরা তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
অন্য রচনার তুলনায় হুমায়ুন আজাদের কবিতার সংখ্যা কমÑএ অভিযোগ তাঁর জীবদ্দশায়ও অনেকে করেছেন। ‘কাব্যসংগ্রহ’র ভূমিকায় তিনি এই অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেনÑ‘অজস্র অসংখ্য কবিতা লেখার মনোরম দেশে আমি লিখেছি কমই। অনুরাগীদের দীর্ঘশ্বাসে আমি প্রায়ই কাতর হই যে দিনরাত কবিতা লেখা উচিত ছিলো আমার। অনেক ভুলই হয়তো সংশোধিত হতে পারে; তবে আমার এ-ভুল বা অপরাধ সংশোধন অসাধ্য। অবশ্য মধুর আলস্যে জীবন উপভোগ আমি করিনি; বন্ধুরা যখন ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে উপভোগ করছেন তাঁদের অতীত কীর্তি, সিসিফাসের মতো আমি পাথর ঠেলে চলছি। কবিতার মতো প্রিয় কিছু নেই আমার বলেই বোধ করি, তবে আমি শুধু কবিতার বাহুপাশেই বাধা থাকি নি; কী করেছি হয়তো অনেকেরই অজানা নয়।’ অসমাপ্ত জীবনে অনেক কিছুই করেছেন তিনিÑ এ কথা মানতে কারো বাধা নেই। কবিতাকে তিনি বেশি ভালোবেসেছেন, সেই তথ্যও আমরা জানি। এবং একথা প্রচার করতে চাই যে, ষাটের কবিতায় তিনি অল্পপ্রজ হলেও স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার যোগ্য।
‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩) কাব্যের মাধ্যমে কবি হুমায়ুন আজাদের যাত্রা শুরু। এরপর ‘জ্বলো চিতাবাঘ’ (১৯৮০), ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ (১৯৮৫), ‘যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল’ (১৯৮৭), ‘আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে’ (১৯৮০), ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ (১৯৯৮), ‘পেরোনোর কিছু নেই’ (২০০৪)Ñ এই সাতটি কাব্য ছাড়া আছে কিছু কিশোরকবিতা আর অনুবাদ-কবিতা। খুব বেশি না লিখলেও তাঁর বলার ভঙ্গির জন্য তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন। কবিতায় তিনি তেমন ভাঙচুর করেছেন, এমনটি নয়। তেমনটি হওয়াই জরুরি কোনো বিষয় নয়। তিনি তিরিশের কবিতার উত্তরাধিকার বহন করেই ষাটের কবিতার ভাষাকে নির্মাণ করেছেন। ষাটের কবিতার নিজস্ব ভাষা নির্মাণে যাঁরা নিবেদিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২-২০০৩), শামসুল ইসলাম (১৯৪২-২০০৮৭), রফিক আজাদ (১৯৪৩), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩), আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩), মোহাম্মদ রফিক (১৯৪৩), মহাদেব সাহা (১৯৪৪), নির্মলেন্দু গুণ (১৯৪৫), মুহম্মদ নূরুল হুদা (১৯৪৯), আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫), মাহবুব সাদিক (১৯৪৭), অসীম সাহা (১৯৪৯) প্রমুখের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদের নামও সমমর্যাদায় উচ্চারিত। তাঁরা কেউ কেউ নতুন পথ নির্মাণ করেছেন, কেউ কেউ সিদ্ধির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছেন। কিন্তু কবি হুমায়ুন আজাদ বহুমুখী পথপরিক্রমায় কবিতার সরণি থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছেন। সংখ্যাবিচারে নয়, মানবিচারে হুমায়ুন আজাদের কবিতা উৎকৃষ্ট ও আকর্ষণীয়।
প্রথাবিরোধিতার কথা বললেও হুমায়ুন আজাদ কবিতার প্রকরণে তেমন প্রথাবিরোধিতার ঘোষণা দেননি। কবিতায় তিনি জনপ্রিয় হতে না চাইলেও কবিতার পাঠক তাঁকে ঠিকই চিনে নিয়েছেন। ‘অলৌকিক ইস্টিমার’-এ তিনি প্রথানুসারী ভাষাতেই লিখেছেনÑ
নাচো, নাচো, হে নর্তকী, এই বক্ষে, এই স্টেজে, নাচো চিরদিন।
বাজাও নুপূর ঘন, আবর্তিত হও, শব্দ তোল উদ্ভিদবিদার,
পায়ের আঘাত হোক রক্তবীথি ছিন্নভিন্ন, মাংসরা মলিন,
নাচো, নাচো, হে নর্তকী, এই বক্ষ, এই স্টেজ সর্বদা তোমার।
(স্টেজ, অলৌকিক ইস্টিমার)
কিংবাÑ
চোখের মতোন সেই ইস্টিমার
নীল নক্ষত্র থেকে ছুটে আসছে গাঢ় বেগে
যারা শুয়ে আছে পাটাতনে
প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় বিভিন্ন শ্রেণীতে
তারা আমার গভীর আত্মীয়
(অলৌকিক ইস্টিমার, অলৌকিক ইস্টিমার)
এই দুটি কবিতাংশ থেকেও বোঝা যায় যে, হুমায়ুন আজাদ শুরুতেই শব্দপ্রয়োগে ভিন্নতার অনুসারী ছিলেন। সাধারণ কথাটি তিনি একটু ঘুরিয়ে বলতে পছন্দ করতেন। তাতে তাঁর সরল কথাটিও গভীর হয়ে ফুটে উঠত। আর এখানেই ছিল হুমায়ুন আজাদের কৃতিত্ব।
‘জ্বলো চিতাবাঘ’ কাব্যে তিনি শীলনের ছাপ কাটিয়ে ওঠেন। সরাসরি বলার মধ্য দিয়ে তিনি সৌন্দর্য খোঁজার চেষ্টা করেন। ‘সৌন্দর্য’ নামের কবিতায় তিনি বলেন,
রক্তলাল হৃদপি-ে হলদে ক্ষিপ্রি মৃত্যুপ্রাণ বুলেট প্রবেশ;
অগ্ন্যুৎপাতমগ্ন দ্বীপ, চিতার থাবায় গাঁথা ব্যাধ ও হরিণ।
সবুজ দাবাগ্নিদগ্ধ ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের নষ্টভ্রষ্ট দেশ,
শল্যটেবিলে শোয়া সঙ্গমসংযুক্ত ছাতা আর শেলাইমেশিন।
(সৌন্দর্য, জ্বলো চিতাবাঘ)
মনে হচ্ছে সরাসরি, কিন্তু প্রতীকের ভেতর দিয়ে বলার এই কৌশলটি বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। এখানে চিতা, ব্যাধ, হরিণ, ছাতা, সেলাইমেশিন প্রতিটি অনুষঙ্গ চমৎকার প্রতীকরূপে ব্যবহৃত। গোটা কাব্যেই তিনি সৌন্দয্যের সন্ধান করেছেন। গ্রন্থের শুরুর কবিতার নাম ‘সৌন্দর্য’ আর শেষের কবিতাটিও সৌন্দর্যবিষয়ক। Ñ
যখন ছিলাম প্রিয় প্রতিভাসৌন্দর্যপ্রেমে ভ’লোকে ছিলো না কেউ আমার সমান।
তখন শালের মতো এই দেহÑ ঝকঝকে, নীলছোঁয়া, প্রোজ্জ্বল, নির্মেদÑ
দুচোখ জ্যোতিষ্কদীপ্র, কণ্ঠস্বরে লক্ষ লক্ষ ইস্পাহানি গোলাপের ঘ্রাণ,
তোমার প্রশংসাধন্য ছিলো এমনকি লোমকূপে-জমে-থাকা সংগোপন স্বেদ।
....
তুমিই সৌন্দর্য আজো দুই চোখে, তোমার ধ্যানের মগ্ন আছি অহর্নিশ
পরিমাপ করে যাই অনন্ত দ্রাক্ষার উৎস ঢালতে পারে কতোখানি বিষ।
(এক বছর, জ্বলো চিতাবাঘ)
‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কাব্যে হুমায়ুন আজাদ প্রকৃত কাব্যলক্ষ্মীর সন্ধান পেয়েছেন। আগের দুই কাব্যকে বলা যেতে পারে তাঁর উত্থানপর্বের স্মারক। এই কাব্য তাঁর সংহত হওয়ার প্রমাণবহ। আশির দশকের মাঝামঝি সময়ে প্রকাশিত এই কাব্যে তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিল্পিত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ‘যতোই গভীরে যাই মধূ, যতোই ওপরে যাই নীল’ কাব্যে কবি হুমায়ুন আজাদ আরো বেশি শিল্পসুষশা সৃষ্টি করেছেন। ‘আমি বেঁচে ছিলাম অনদের সময়ে’ কাব্যে তিনি গীভর জীবনদর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ কাব্যগ্রন্থ শোক ও স্মৃতিকাতরতায় ভরা অনুপম সৌন্দর্যের কবিতা। শেষ কাব্য ‘পেরোনোর কিছু নেই’-তে এসে তিনি একেবারেই অন্য মানুষ, ভিন্ন কবি হয়ে উঠেছেন। কবিতাকে তিনি নিয়ে এসেছেন হাতের মুঠোয়। কবিতাকে নিয়ে তিনি খেলতে চেয়েছেন। কিন্তু এমনই এক সময়ে মৃত্যু এসে তাঁকে নিয়ে যায়।
হুমায়ুন আজাদ আপাদমস্তক কবি। তাঁর জীবনযাপন জুড়ে ছিল কবিতার আভাষ। তিনি উপন্যাস লিখতে গেলেও ভাষাকে কবিতাগন্ধী করে তুলেছেন। তাঁর প্রবন্ধের ভাষাও সুললিত। সর্বতোবিবেচনায় কবি, বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় এই মানুষটি সমাজের অনেক ক্ষতকে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন। তাই সমাজের জন্য যারা ক্ষতিকর, তারা হুমায়ুন আজাদের মতো সত্যবাদী কবিকে সহ্য করার কথা নয়। আমরা হয়তো একজন হুমায়ন আজাদকে ফিরে পাব না, কিন্তু তাঁর কবিতা থাকবে অন্ধকারের পথে আলোকবর্তিকা হয়ে।
.........
ড. তপন বাগচী : উপপরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
হুমায়ুন আজাদের কবিতা : অন্ধকারের পথে আলোকবর্তিকা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন
টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।