সাদমানের হাতের ছাতাটা অনেক কসরত করেও বন্ধ করতে পারছে না। একেতো জুতা ভর্তি কাদা তার উপর এই ফুটন্ত ছাতা লিফটম্যান বোতামে আংগুল চেপে রেখে বারবার তারদিকে তাকাচ্ছে। বেগুনী ছাতার গায়ে গোলাপি রঙের ফুল ফুটে থাকা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারে এটা একটা মেয়েদের ছাতা।
আজ বাসা থেকে বের হবার সময় থেকে নানা ধরণের ঝামেলা শুরু হয়েছে। অফিস যাবার উদ্দেশ্যে সাদমান কেবল বাসার গেট থেকে পা বাইরে রেখেছে অমনি তিনতালা থেকে পিছু ডেকে তার বউ চিৎকার করলো, "এই টিভি'র রিমোট কোথায়?"
সাদমান কোনমতে রাগ চেপে বললো, "রিমোট আমার পকেটে, ওটাকে অফিসে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছি। তুমিও যাবে?"
"আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও, শুধু শুধু রাগ করো কেন তুমি?"
অনেকক্ষণ ধরে আসি আসি করতে থাকা বৃষ্টিটা এবার আকাশ ভেংগে নামলো। সারা বাসায় খুঁজেও তার ছাতাটা না পেয়ে বউয়ের রঙচংয়ে ভরা ছাতাটা নিয়ে রওনা হয়েছিল সে। বৃষ্টির দিন এমনিতেই রিকশাওয়ালাদের মুড এসে থাকে, কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে তাদের উদাশীন মনোভাব ঋশিদেরও হার মানায় তার উপর এই বাহারি ছাতা মাথায় নিয়ে আজ যে রিকশাওয়ালাকেই সে জিজ্ঞাসা করে 'ভাই যাবেন?' সে একবার ছাতাটার দিকে তাকিয়ে মুখ বেকিয়ে বলে, 'নাহ যামুনাহ'
'ভাড়াটা বাড়াই নিয়েন'
'নাহ ঐদিক যামুনাহ'।
বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে সাদমান তার বহুবার কাজে দেয়া পুরাতন টেকনিকটাই কাজে লাগালো। এই টেকনিকের নাম সে দিয়েছে, ৯৯৯ টেকনিক। জরুরি অবস্থায় যেমন ৯৯৯-এ কল করা হয় তেমনি একটা ফোন কলের মাধ্যমে ব্যবস্থা আর কি।
টেকনিকের ধারা অনুযায়ী খুব উত্তেজিতভাবে মোবাইলে কথা বলতে বলতে দৌড়ে একটা খালি রিকশায় চেপে বসলোভসে আর মোবাইলে বলতে থাকলো, "হাজতে যেন না নেয়, থানার বেঞ্চিতে টাইট হয়া বসে থাকতে বল, ওসি সাহেব রে তোরা ম্যানেজ করতে পারবি না, যা বলার আমি এসে বলবো, তোরা সাব-ইন্সেপেক্টার সাহেবকে ম্যানেজ কর।" কথাবার্তার এই পর্যায়ে রিকশাওয়ালা পেছনে একবার তাকায়ে কষে প্যাডেল মারে।
তার অফিস একটা পুলিশ থানার পাশে। সে থানার সামনে রিকশা থেকে নেমে যায়। কোন এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক কারণে রিকশাওয়ালারা পুলিশের হাতে ধরা খাওয়া মানুষের প্রতি অতি সহানুভূতিপ্রবণ হয়। বহুবার বহুজন এই নকল বাক্যলাপ শুনে নানান এক্সপার্ট আ্যডভাইসও দিয়েছে, যেমন "ভাই উডানোর সময় মাইর দিছে কি? দিলে ভালো, তাইলে এখন আর মারবো না অথবা থানা হাজত হইলো টাকার খেল বা বড় ন্যাতা কেউ জানা থাকলে অক্ষণি ফুন লাগান, দ্যাখবেন পানি কাটার লাহান চ্যালচ্যালায় বাড়াই আইবো।" তবে কেউ যখন বলে, "মামা টাইট হয়া বসেন আর আল্লাহ খোদার নাম করেন, কোন চিন্তা নাই উইড়া যামু, আপনার প্যারেশানি দেইখ্যা পেট পুড়ে" তখন সরল মধ্যবিত্ত মনটায় খচখচানি উঠে।
প্রতিবারের মতো টেকনিকটা আজও কাযে দিয়েছিল। কিন্তু একটা মিথ্যা দিয়ে দিন শুরু করাতে মনের খঁচখঁচানিটা থেকে গেল। আর্থিকভাবে দূর্বল হলে মানুষকে বাঁচার তাগিদে নানান ধরণের ফন্দি-ফিকির অর্থাৎ টেকনিক জানতে হয়। মনের খঁচখঁচানি ভাব দূর করারও তার একটা টেকনিক আছে। এই টেকনিকের নাম, 'দিলখুশ টেকনিক'। সে তার মনটাকে তার শৈশবের ছুটির দিনগুলোতে নিয়ে যাই। যেখানে বাবার হাত ধরে সকালে হাঁটতে বের হয়, পানিতে ফুটে থাকা শাপলাগুলোকে সূর্যের আলো পড়ায় বুঁজে যেতে দেখে অবাক হয়ে, মায়ের আঁচলের শুভ্র গন্ধ শুষে নেয় বুক ভরে, পাটি বিছিয়ে খড়ের উপর শুয়ে থাকে শীতের নরম রোদে, ভাই-বোনদের সাথে বিকেল বেলা দাঁড়িয়াবান্ধা খেলে। তারপর চোখের কোণায় হালকা একটা ঝিকিমিকি আর জ্বালা তারপর-ই দিলখুশ।
দিলখুশ ফুরফুরে মেজাজটা নিয়ে লিফটের সামনে এসে এই ছাতা যন্ত্রটার যন্ত্রণায় কিছুটা বেসামাল সে বর্তমানে। লিফটের তিনধাপ পেরিয়ে বসের নাকের ডগায় চশমা নিয়ে তাকিয়ে থাকা শ্যেন দৃষ্টি, ডেস্কে জমে নানান জটিলতায় ভরা নথি, অফিস পলিটিক্সের মারপ্যাচ হঠাৎ সবকিছু যেন বড় গোলমেলে মনে হলো তার। গোলাপি ফুল ফুটে থাকা ছাতাটা মাথায় নিয়ে সে ফিরে চললো নিজের বাড়ীর পথে। বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে সিরিয়াস মুখ করে বউকে বললো, "তোমার টিভি'র রিমোটটা ফেরত দিতে আসলাম।"
সাদমানের এই টেকনিকটার নাম "মনে মনে মিষ্টি"। সে প্রতিদিন অফিসে ঢোকার আগে মনে মনে মিষ্টি খেয়ে ফেলে, ভেবে নেয় এমন-ই কোন একটা হতে পারতো সুন্দর দিনের কথা। তারপর ঝাঁপ দিয়ে ঢুকে পড়ে অফিসের দরজা পেরিয়ে, সকালের মনে মনে খাওয়া মিষ্টিটুকু সারাদিনের গরল পান করাটা অনেক সহজ করে দেয় তখন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:২০