আজকের দিনটা আমার জন্য ঘটনাবহুল। একসাথে দুই দুইটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে গেছে। একটা ঘটনা বলতে তো কেমন জানি ইয়ে ইয়ে বোধ-ও হচ্ছে। যাহোক শঙ্কা আর জড়তা ত্যাগ করেই লিখতে শুরু করছি।
অফিসের দিনগুলিতে সাধারণত সকাল ৭.৩০ থেকে ৭.৪৫ মিনিটের ভেতর বাসা থেকে বের হই, আজও যথারীতি বের হলাম। কিন্তু আজকের দিনটা অন্য একটু অন্যরকম ছিল কারণ অন্যদিন অফিসের পোষাকে পুরো প্যাকেট হয়ে যায় কিন্তু আজ আমাদের অফিসের বিশেষ অনুষ্ঠান থাকায় আমার বস বলেছিলেন পোষাকের ব্যাপারে আজ বেশ কিছুটা অমনোযোগী হলেও সমস্যা নাই। আমিতো খুশিতে বাকবাকুম, আমার ভীষণ ইচ্ছা জিন্স আর টি-শার্ট পড়ে অফিসে আসার আজ তা পূরণ হতে চলেছে। যা-হোক রঙ্গিলা পোষাক পড়ে ফুরফুরা মনে বাসের লাইনে দাঁড়ালাম। বাংলামোটর যাব, বেশ কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু বাসের কোন পাত্তা নাই হঠাত পেছন থেকে একটা মেয়ে কন্ঠের প্রশ্ন ভেসে আসলো, ‘ভাইয়া এটা কি বিহঙ্গ বাসের লাইন?’ আমি ‘জ্বি আপু’ বলে পেছনে ফিরে দীর্ঘদেহী এক পুরুষকে দেখে বাসের আগমন পথের দিকে মনযোগ দিলাম। লাইনে দাঁড়ানোর প্রায় ৩০ মিনিট পর বাস আসলে তাতে চড়ে বসলাম। ঢাকার বাসের আসনগুলো বানানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ কিপটামো করা হয় তাই বাসে আমার পাশের সহযাত্রী হিসেবে আমি সবসময় রোগা-পাতলা বেছে নিয়ে থাকি। সেদিন বাসে যেতে যেতে খবরের কাগজে পড়ছিলাম যে গ্রিনিজ রেকর্ড বুকে সবচেয়ে পাতলা জাতির নাম বাঙালি জাতি, খবরটা পড়ে যারপর নাই আহ্লাদিত হলাম। তো-যাহোক, আজ আমার ভাগ্য খারাপ তাই আমার পার্শ্বযাত্রী হলেন আমার পেছনে থাকা সেই বিশালদেহের অধিকারী ব্যক্তি। তার পার্শ্ব চাপের চোটে ভুলে গেলাম যে আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে পাতলা জাতি। পরের ষ্টপেজে বাসভর্তি করে যাত্রী উঠালো, একেতো অসহ্য ভ্যাপসা গরমে বাসভর্তি যাত্রী, ভীষণ পার্শ্বচাপ এর মধ্যে হঠাত সেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকন্ঠের নিবেদন, ‘ভাইয়া একটু চেপে বসবেন, প্লিজ’; চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে বসে আছি এরপর চাপতে হলে বাসের জানালার বাইরে বসতে হবে যেই আগুন গরম চোখ এই কথাটা বলতে যাব তখন পাশে তাকিয়ে টাশকিত হয়ে আবিস্কার করলাম সেই দীর্ঘদেহী ব্যক্তিকে। আমার চোখে নিশ্চয় এমন কিছু ছিল যা লোকটাকে আবার কথা বলতে বাধ্য করলো আর বিস্ময়ের সাথে দেখলাম লোকটির গলার স্বর একদম মেয়েদের মতো। আমি বাসে সাধারণত কারো সাথে আলাপ জমাইনা কিন্তু লোকটার অস্বাভাবিক স্বর আমাকে তার সাথে কথা বলতে প্ররচিত করলো। জানলাম ব্যক্তিটি একটি এনজিও-তে কাজ করে, আগে কলাবাগান থাকতেন এখন মিরপুরে থাকেন; হঠাত লোকটি আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আমার পূর্ব-পুরুষেরা কাশ্মির থেকে এসেছে কিনা, আমি না বলাতে সে আমাকে ভাল করে খোঁজ নিতে বলল তারপর থেকে সে ইনিয়ে বিনিয়ে আমার রুপের নানা প্রশংসা শুরু করলো। চাপা এমন জিনিস যা মিথ্যা জেনেও অনেক সময় শুনতে ভাল লাগে আর তারই ফলস্বরুপ আমি কিছুটা আহ্লাদিত হয়ে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। গল্পতে গল্পতে বাস বিজয় স্বরনীর জ্যামে এসে আটকে গেল, হঠাত-ই লোকটা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আচ্ছা ‘আমাকে আপনার কেমন লাগলো?’, আমি বললাম, ‘বেশ ভালো, চমৎকার মানুষ আপনি’, আমার সাদা মনের সাদা উত্তরে লোকটি বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে চোখটা যেন কেমন করে বলল ‘আপনার মতো সুপুরুষদেরও আমার ভীষণ পছন্দ, এত কাছাকাছি আমরা থাকি, একটা ছুটির দিন আসেন আমার ওখানে, রাত কাটিয়ে দেখবেন কতো মজা পান।’ আমার চোখটা বোধহয় আর একটু হলে বের হয়েই আসতো, আমি কোনমতে শুধু ‘মানে কি?’ টুকু বলতে পারলাম, আর তার প্রতি উত্তরে লোকটি জ্বিভ ভিজিয়ে যে হাসিটা দিল তা দেখে বাংলামোটর আসার আগেই বাসের ভংকর মানব প্রাচীর ভেঙ্গে ফার্মগেটে নেমে পড়লাম। লোকটাকে পেটানোর অসম্ভব অবদমিত ইচ্ছা আর ঘেন্নায় সারা শরীর কাঁপছিল। কিন্তু নেমে ফিরে তাকাতে-ই বাসের জানালায় লোকটার লোভাতুর হতাশ চোখ দেখে কলিজা শুকায়ে গেল; আল্লাহ-র কাছে বারবার প্রার্থনা করলাম আর কখনো যেন এই লোকের সাথে দেখা না হয়।
ফার্মগেট নেমে-ই বুঝলাম আমার জন্য আজ দিনটা খারাপ। কোন বাসে উঠার মতো জায়গা নাই আর রিক্সা সিএনজি কিছু নাই। অবশেষে অনেক কষ্টে, অর্ধেক পথ আমি-ই চালিয়ে নিয়ে যাব টাইপ অনুরোধ করে ৫০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকায় ঠিক করে একটা রিক্সা ম্যানেজ করলাম। বাংলামোটর এসে দেখি গলাটা আমার সাহারা মরুভূমি হয়ে আছে, কাছেই একটা ভ্যানে ডাব বিক্রি করছে দেখে দৌড়ে গিয়ে ডাবওয়ালাকে বললাম একটা ডাব দিতে। ডাব খেয়ে ১০০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলাম ডাবওয়ালার দিকে, সে পকেট থেকে অনেক গুলো নোট বের করলো আর সেখান থেকে আমাকে ২০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিল; আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ডাবের দাম কতো? সে বলে ৮০ টাকা, মেজাজতো গরম ছিল, ডাব খেয়ে যাও বা একটু ঠান্ডা হয়েছিল ডাবের দাম শুনে মেজাজ আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। খিঁচায় একটা ঝাড়ি দিতেই ৮০ টাকার ডাব ৫০ টাকায় চলে আসলো, আরো একটা ঝাড়ি দিতেই আরো ১০ টাকা এগিয়ে দিয়ে বলল, আর চাইয়েন না মামা। আমি সব ভুলে আবার সেই রঙ্গিলা পোষাকের ফুরফুরা মেজাজে রওনা হলাম। কিন্তু মিটিংয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গায় পৌচ্ছে আমার সম্পূর্ণ বজ্রাহত পরিস্থিতি, সবাই কমপ্লিট ফুলবাবু হয়ে ব্লেজার-টাই পড়ে গম্ভীর মুখ করে ঘুরাফিরা করছে আর আমি ক্যাজুয়াল ড্রেস পড়ে হ্যাবলা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেরি না করে বস-কে খোঁজা শুরু করলাম কিন্তু কোথাও খুঁজে না পেয়ে যখন বাহির গেটের দিকে আগাচ্ছি তখন দেখি বস পেঙ্গুইন সেজে হাঁপাতে হাঁপাতে গাড়ি থেকে নামছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘স্যার এটা কি হলো? আমাকে ক্যাজুয়াল ড্রেসে আসতে বলে আপনি ফরমাল ড্রেসে?’ বস চোখটা করুণ করে বললো, ‘ ইয়ে একটা ভুল হয়ে গেছে, আমি এইমাত্র বাসা থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে আসলাম আর তুমিও বরং এমডি স্যারের কাছে বড়সড় একটা ঝাড়ি খাবার আগেই প্রস্থান করো , বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব।’ আমিতো প্যানপ্যানানি মার্কা বকবক শোনার হাত থেকে নিস্তার পেয়ে ভেতরে ভেতরে খুশিতে বাকবাকুম করছি কিন্তু তবুও মুখটা করুণ করে বললাম, ‘স্যার এতো গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো মিস করা কি ঠিক হবে, তারচেয়ে আমি না হয় পেছনে গিয়ে বসি’। বস আতঙ্কে না জাতীয় যে শব্দ করলেন তা শোনার পর আমার দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হবে বলে মনে হলো না। প্রপার ইউনিফ্রম না-থাকায় স্কুল থেকে বের করে দিলে যেমন ফূর্তি হয় আমি ঠিক সেই রকম ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে নিলাম। শুরুটা মন্দ হলেও দিনের শেষটা খারাপ ছিল না।