somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বইমেলার দ্বিতীয় গল্প (নিম্ন- মধ্যবিত্ত পর্ব)

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গতকাল রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে পূর্বপরিকল্পিত বাসনা চরিতার্থ করতে বইমেলাতে ঢুকলাম। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ, উছ্বাস আর উত্তেজনায় হাতের তালু ঘামছে, লোলুপ চোখের মণি চকচকে হয়ে উঠেছে ষ্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

প্রথমেই বাংলা একাডেমীর মাঠটাতে একটা ঘুল্লি দিয়েই ছুটলাম সরওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যেখানে বসেছে এবার মূল মেলাটা। ছুট দিতেই কানে আসলো মাইকে কোন একটা মেয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নাকাটি করছে; ছুট থামিয়ে উৎসাহী আর সমবেদনাযুক্ত মন নিয়ে দৌড়ালাম কান্না লক্ষ্য করে, কিন্তু নিরাশ চোখে দেখলাম কান্নাকাটির কোন বিষয় নয় কেউ একজন অবিশ্বাস্য বড় একটা লাল টিপ কপালে চাপড়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতের চৌদ্দগুষ্ঠি করছে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ছুটলাম মূল মেলার দিকে, চোখ আবার চকচকে হয়ে উঠলো। একটা বই-ও না কিনে পুরো মেলাটা প্রায় ঘুরে শেষ করে এসেছি হঠাৎ বাম পা-টা ভীষণ হালকা বোধ হলো, তাকিয়ে দেখি বাম পায়ের জুতোর তলাটা নাই! অসহায়ের মত চারিপাশটা একবার দেখে আবার বাম পায়ের দিকে তাকালাম আর দ্রুত হিসেব করে ফেললাম নতুন একটা জুতো মানে মেলা টাকার মামলা আর এদিকে পছন্দ করা বইগুলোর অমোঘ হাতছানি তাই সময় নষ্ট না-করে জুতোর-তলাটা খুঁজতে শুরু করলাম এবং অবিশ্বাস্যভাবে খুব দ্রুত পেয়েও গেলাম, আসলেই গরীবের সাথে জুতার মতো জিনিস বিট্রে করলেও আল্লাহ সাথেই থাকেন। একটু মোচড়া মুচড়ি করে জুতারতলাটা হাতে নিয়ে নাক বরাবর সোজা হাঁটা ধরলাম। এখন টার্গেট একটাই, দ্রুত একটা বই কিনে বইয়ের প্যাকেটের ভিতরে তলাটা চালান করে দেয়া।

একপায়ের জুতার তলা না থাকায় হাঁটাটা বিটকেলে দেখাচ্ছিলো, তার উপর হাতে ছিলো খুলে যাওয়া তলাটা। মানুষগুলো আমার দিকে নতুন সব দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। কারো দৃষ্টি অবাক হওয়া, কারোটা সন্দেহ ভরা, কেউ কেউ-তো আবার করুণার দৃষ্টিতেও তাকাচ্ছিল যেন বলতে চায় ‘আহারে বেচারা ল্যংড়া’; এইসব দেখে দেরি না করে তাড়াতাড়ি পূর্বপছন্দ করা একটা ষ্টলে ঢুঁকে অনেকদিন থেকে কিনতে চাওয়া এডওয়ার্ড সাইদের ‘ওরিয়েণ্টালিজম’ বইটা কিনে ফেললাম। প্রিয় এক বড় ভাইয়ের কাছে শুনেছি, সাইদের প্রিয় বিষয় পোষ্ট-কলোনালিজমের উপর অসাধারণ একটা বই এটা তাই ধর তকটা মার পেরেক। কিন্তু এত সুন্দর বই বিক্রেতা আপুটা ভীষণ কিপটা টাইপ, আমার বিপদের কথাটা বলে এমনকি আমার হাতে থাকা প্রমাণ প্রদর্শন পূর্বক একটা অতিরিক্ত ব্যাগ চাইলাম কিন্তু সে ফিচকে একটা হাসি দিয়ে সর্যি বলে দিল। আমি বিমর্ষ হয়ে নতুন কেনা বইটা হাতে নিয়ে জুতার তলাটা ব্যাগে চালান করে দিয়ে ফুল-কনফিডেন্স নিয়ে সামনে আগালাম। পরবর্তী গন্তব্য প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বই কেনা আর তাই চলে আসলাম অন্য প্রকাশের ষ্টলে। অনন্য সাধারণ, সুন্দর একটা ষ্টল করেছে অন্য প্রকাশ। হুমায়ূন আহমেদের খোলা জানালায় দাঁড়ানো প্রায় জীবন্ত একটা ছবি তাদের ষ্টলের সর্ব-উপরে যা আমার মত হয়তো অনেকেরই চোখকে ঝাঁঝাঁলো পানিতে সাময়িক ঝাপসা করে দিয়ে স্বরণ করিয়ে দিয়েছে এই অসাধারণ শিল্প স্রষ্টাকে। অন্যপ্রকাশ থেকে কিনে নিলাম ‘সেই সময়ের’ ৮২৫ পৃষ্ঠার প্রতি পৃষ্ঠায় জড়ানো লেখকের অমোঘ দৃষ্টিতে দেখা ১৯০১ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালকে। স্টলটার চারপাশে ছড়ানো হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো আমাকে মানুষে ঠেসে থাকা প্রচন্ড ভিড়ের ভেতরও সম্মোহিত করে ফেলেছিলো, সম্মোহনটা কেটে গেল কোন এক ভদ্রমহিলার কাক তাড়ানো চিৎকারে। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে আমার হিমুর খালা-ফুপুদের কল্পিত মুখগুলো বাস্তব হয়ে উঠছিলো। ভদ্রমহিলার সাইজ ঢাকায় গদিনশিন কোন ভন্ড-পীরের তুলনায় কম নয় আর তার সাথে আছে তার লাগসই চুলের বাহার। উফফঃ তার চুলগুলো সত্যিই ইউনিক; তিনি কোন এক অসাধারণ ক্ষমতা বলে তার চুলগুলো শলার ঝাড়ুর মতো করে ফেলেছেন আর সেই চুলগুলো আবার অস্বাভাবিক কোন কারনে তার মুখমন্ডলের চারপাশে দিক নির্দেশনা করছে, যা দেখলে ছোট বেলায় আঁকানো সূর্যের কথা মনে আসে যে সূর্য থেকে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে সূর্যরশ্নি ছুটে পালাচ্ছে। মহিলার চিৎকারের কারণ তার ভাষায় কেউ তার ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে গেছে। আমিতো শুনে তাড়াতাড়ি আমার পেছনে হাত দিলাম আর মানিব্যাগটা আছে দেখে সটান হাঁটা দিলাম, যদি এই মহিলার ব্যাগ নেয়ার মতো কোন সাহসী এখানে থেকে থাকে তবে আমার ব্যাগ হাপিস করা তার কাছে হাত ধোঁয়ার চেয়ে সহজ।
যাহোক, তলাবিহীন একপাটি জুতা পড়ে ল্যামচাতে ল্যামচাতে আবৃত্তি নামের কবিতার ষ্টলের সামনে দুইপাটি দন্ত বিকশিত করে দাঁড়ালাম, ষ্টলের পূর্বপরিচিত মহানুভব ভাইটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল আর আমি তাকে আমার ফাকা পেন-ড্রাইভটা বাড়িয়ে দিলাম। অনেক দেখে শুনে ‘নূপুর’ নামে কবিতার এক অডিও সিডি কিনলাম, সাথে পেন-ড্রাইভে ভরে নিলাম অনেকগুলো কবিতা। হাসি মুখে সামনের ষ্টলে এগিয়ে গেলাম অনেক নেড়েচেড়ে আরও একটা বই পছন্দ হয়ে গেল কিন্তু মানিব্যাগে হাত দিতেই বুঝলাম ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফিরতি পথে পা দিতেই মনে দুলে উঠলো তলাহীন জুতার সাথে নতুন জুতা কেনার চিন্তাটা। অসহায়বোধ করলাম ভীষণ। মুচির কাছে নিয়ে তলাটা লাগিয়ে নিলাম, মুচিটাকে অন্তর থেকে দাদা বলে ডেকে ছিলাম বলেই হয়তো খুব যত্ন করে মেরামত হলো জুতাটার; মনে মনে ভাবলাম, ‘যাক বাবা বাঁচা গেল, হিসাবের বাইরে আজকের এই পকেট পাতলা হবার পর সামনের মাসে অন্তত জুতা কেনার ঝক্কিটা আসছেনা’। খুশিমনে দুইপায়ে সমান তালে বাসায় ফিরলাম। নতুন বই আর কবিতার সিডি আমার ঘরের সৌন্দর্য কয়েক’শ গুণ বাড়িয়ে নিজ প্রভায় শোভা পাচ্ছে; আমি শুধু মাঝে মাঝে কৃপণের মতো একটু শুঁকে দেখচ্ছি, এখনি পড়বোনা। আমার রক্ত পানি করা টাকা দিয়ে কেনা অমূল্য বইগুলোকে ভীষণ তরিয়ে তরিয়ে পড়লে তবেই না স্বার্থকতা পাবে। বই আর কবিতার সিডিগুলো সামনে বিছিয়ে নিয়ে ভাবছিলাম, “মধ্যবিত্ত হওয়া সংগ্রামের কিন্তু কিছু অনন্য সাধারণ আনন্দ থাকলেও নিম্নমধ্যবিত্ত হওয়া রীতিমত সবসময় হেরে যাওয়ার ভয়ে থাকা যুদ্ধের সামিল”।


১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এনসিপিকে আমাদের দেশের তরুণ-যুবা'রা ক্ষমতায় দেখতে চায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১২:৪৫

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধে পাড়া-মহল্লায় জনতার আদালত গঠনের ডাক দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি তথা এনসিপি। দেশের বৃহত্তম ইসলামী দল 'ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ' তথা চর মোনাইয়ের পীর সাহেবের দল এনসিপিকে আগে থেকেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাতৃ ভাণ্ডার

লিখেছেন ঠাকুরমাহমুদ, ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ৩:২৬



আমাদের দেশে মিষ্টি পছন্দ করেন না এমন মানুষ পাওয়া বিরল ব্যাপার। ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে যারা যাতায়াত করেন মাতৃ ভাণ্ডারের সাথে পরিচিত নন এমন মানুষও মনে হয় খুব বেশি নেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

এনসিপি জামায়াতের শাখা, এই ভুল ধারণা ত্যাগ করতে হবে

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ সকাল ১০:৪৪

প্রিয় রাজীব ভাই,
আপনি আমার আগের পোস্টে কমেন্ট করেছেন যে, এনসিপি জামায়াতের শাখা। আপনার এনালাইসিস ভুল! ওরা জামায়াতের শাখা নয়। এনসিপি-কে বুঝতে হলে, আপনাকে জামায়াতকে জানতে হবে। আমি একটু বিস্তারিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

ছবি কৃতজ্ঞতা এআই।

ভূমিকা

নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন শুরু হয় ১৮শ শতকের শেষভাগে, যার ফলশ্রুতিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি স্মার্ট জাতির অন্তঃসারশূন্য আত্মজৈবনিক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪


একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×