আগের রাতে ঘুম বেশ ভাল হল । প্রচণ্ড গরমের ঢাকা থেকে ঘুরে এসে মীরসরাইরের এক পশলা বৃষ্টি বেশ শান্তি দিয়েছিল । সকাল সকাল ফুফুর বাসায় নাস্তা করলাম গরুর কলিজা দিয়ে পরোটা । বেশ ভাল লেগেছিল, হেহে । তারপর কোনরকমে তৈয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়ি মহামায়ার উদ্দেশ্যে । রাবার ড্যামটা দেখা হয় নাই । তবে এখনকার সংরক্ষিত বনভূমিটা দেখা হয়েছিল । নৌকায় উঠতে মন চেয়েছিল, তবে পকেটে কুলোয় নি । দুজনকে দেখে আরও বেশি চেয়ে বসেছিল বোধহয় । মহামায়ার লেকে যদি না যাওয়া যায় তবে গিয়ে কোন লাভ নেই । আসলে পুরোটা বিনা কষ্টে দেখতে চাইলে লেকটা খুব সহজ উপায় । সমস্যা হল বেশ খরচ করতে হয় । খরচটাও বেশি না, আমাদের কাছে ছিল না । আগেও বলেছি আমার চেয়ে ফারহানের পকেট খুব বেশি ভারি ছিল না । যদিও সে ফুফুর দেয়া টাকাটা চাইলেই খরচ করতে পারত । নোয়াখাইল্যা তোহ, করে নাই । ফুফুর কথা মনে পড়তে আরেকটা কথা না বললেই না: আমার আসার সময় খুব করে বলছিলেন আরেকটা দিন থেকে যাইতে । ফারহানদের খুব আদর করেন বোঝা যায় । উনার কান্নাভেজা বিদায়টা সেদিনকার উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা । উনি আর উনার পরিবার ভাল থাকুক, এটা আমি একেবারে মন থেকে চাই ।
মহামায়ার পর আমাদের উদ্দেশ্য হল ,! এই সীতাকুণ্ডের কথা শুনে আমরা এসেছি ঢাকা থেকে । চন্দ্রনাথের মন্দিরে যাব এই আশায় এসেছি । মীরসরাইয়ে ফুফা থেকে শুরু করে বাসে করে সীতাকুণ্ডের পথে যতজন পেয়েছি কেউ যেতে পারব বলে বলেনি । শতভাগ ভোট পড়েছিল না যাওয়ার পক্ষে ! বাস থেকে নেমে রিকশার করে সীতাকুণ্ড ইকো পার্কে যাওয়া । টিকিট কাউণ্টারেও এক কথা । যাওয়া যাবে না । বলে বড় ঝর্ণা পর্যন্ত নিরাপত্তারক্ষী আছে । এরপর নাই । আমরা তারপরও না থামতে প্রশ্ন করে বসল হিন্দু নাকি । নেতিবাচক উত্তর পেয়ে বলেই বসল "তাহলে আর কী লাভ? একটা মন্দিরই তো !" আমরা ঠিক করলাম তাহলে আর যাব না । ব্যাগে আধা বোতল পানি নিয়ে ঝর্ণার উদ্দেশ্যে সিএনজি নিয়ে যাত্রা । ২.৮ কিলোমিটারের রাস্তা । সিএনজি চালক মামার মুখেও এক কথা ! "যাইয়েন না । ডাকাত পড়ে । সবকিছু নিয়ে যাবে । মেরেও ফেলতে পারে ! " আমরা ততক্ষণে ঠিক করেই ফেলেছি, যাব না আর থাক ! কী হবে চন্দ্রনাথের মন্দির না দেখলে ! পৌঁছালাম ঝর্ণার ওখানে । একহাজার ফুট নিচে ঝর্ণা ! সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে । সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নামতে হবে । একটু বসে জিরোচ্ছি । কিন্তু ঐ যে বলেছিলাম পাহাড় ডাকে ! সত্যিই ডাকে । ওদিকে ফারহানও কিছু বলছে না । বুঝতে অসুবিধে হয় নি যে ও যেতে চায় । বলেই বসলাম, "চল যাই!" ঠিক করা হল আগে যাব বিমান বাহিনীর ক্যাম্প পর্যন্ত যেটা ওখান থেকে ২০০ মিটার হাঁটা পথ ।
হাঁটতে যাব শুরুতেই দেখি গাছ কেটে রাস্তা ব্লক করে রাখা । যেতে যে দিবে না সেজন্য । আমরা তোহ আরও হতাশ ! কিন্তু মন কিছুতেই মানছে না । হাঁটলাম দুইশ মিটার । দেখা হল বিমান বাহিনীর এক কর্মকর্তার সাথে । নাম ওয়াহিদ । কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার । উনি বলল "যাও তোমরা । আমার নাম্বার নিয়ে যাও । কিছু হইলে একটা ফোন দিবা । দেখেশুনে যাও । " দিলাম রওনা । সাহস পেলাম কিছুটা । পথটা বড় তিন কিলোমিটারের বেশি । তারউপর আমার স্বাস্থ্য তো বুঝেনই । তিন কিলোমিটার সমস্যা না । আমি আর শাকিল প্রায়ই মহাখালী থেকে মিরপুর হেঁটে আসি । পথটা তিন কিলোমিটার থেকে বেশি । সমস্যা হচ্ছে পাহাড় বেয়ে উঠতে যে হয় সেটা । পাহাড়ি রাস্তায় তিন কিলোমিটার অনেক লম্বা পথ । তারউপর মাথার উপর সব শক্তির সূর্য ! মাঝে মাঝে যে বাতাস ছিল না সেটা নয় । পথটাই আমাদের দুজনের মাথায় একটাই চিন্তা ডাকাত পড়লে কী করব! কী বলব । ফারহান আবার ঝোপ ঝাড়ের দিকে নজর রাখতে বলে ভয় আরও বাড়িয়ে দিল । দুজনেই যা পারছি বকছি । শুধু চিন্তাটাকে ডাকাতি থেকে সরিয়ে নিতে ।কোথা থেকে একটা লাঠি যোগাড় করে হাতে নিয়ে হাঁটছে ফারহান । আর আমি বারবার বলছি হিরোগিরি করার কিছু নাই । ট্যুরে প্রথমবারের মত মনে হচ্ছিল আরও কয়েকজন থাকলে বেশ হত । ডাকাতরা আক্রমণ করার আগে ভাবত একবার । প্রথম এক কিলোমিটার আমরা এতটাই ভয়ে ছিলাম ডাকাতের যে সাপ দেখেও ভয় পাই নি ! পথটা কঠিনই ছিল প্রথম এক কিলোর । তারপর যা হয় আর কি! ভয়টা গা সওয়া হয়ে গেল । আমরা জীবনের উত্থান পতন নিয়ে কথা শুরু করে দিলাম । এমনিতে আমি বেশি কথা বললেও এ অংশে ফারহান ভাইয়া বলেছে ভালই । এই পাহাড় বেয়ে উঠতে আর নামতে গিয়েই শুধু বান্দা ফোনে কথা বলে নাই । নাহলে সব সময় কানে হেডফোন ছিলই । যা হোক পানি নেইনি কেন সে জন্য নিজেদের শাপশাপান্ত করতে করতে প্রায় চলেই গেলাম উপরে । কিন্তু শরীর ততক্ষণে অবাধ্য হতে শুরু করেছে । আর পারছিলাম না । তখন দেখি মন্দির দেখা যায় । হাঁটার একটা কারণ পেলাম । শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম মন্দিরের নীচে । তারপর আরও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে । শরীরে কুলোচ্ছিল না তাই একটা বিশাল গাছের নীচে বসে জিরোচ্ছি । গাছটা সিঁড়ির একদম দোরদোড়ায় । সে কী বাতাস । হাতের ঘাম শুকিয়ে গেল কিন্তু পানির অভাবটা গেল না । তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছিল । যা হোক, সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, মন্দিরের পথে সবথেকে কঠিন অংশ এটা । পা ভেঙে পড়ছিল । টেনে ধরছিল । তারউপর সিড়িতে ধরার কিছু নেই । পা হাত সব অবশ হয়ে গেছিল ! অনেক কষ্টে মন্দিরে পৌঁছালাম । আচ্ছা ভুলে গেছি বলতে নীচে এক লোকের সাথে দেখা জিজ্ঞাসা কিছু করতেই কিছু না বলে চলে গেল ! আমরা ভয় পেলাম ভেবে যে কিছু দোষের করলাম না তোহ ! সিঁড়ি থেকে উঠার সময় সুদূর সন্দ্বীপ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম । সত্যি বলতে দেশটা বড্ড সুন্দর আমার । হাঁটতে হাঁটতেই দেখেছি উপর থেকে এত ভাল লাগে! পাহাড়, নদী, গাছ আর অসাধারণ মানুষের মিশেলে চাটগাঁটা অনন্য ! ওখানে গিয়ে পেলাম এক বান্দা যে বসে আছে, জিগেস করলাম যে পানির কোন ব্যবস্থা আছে নাকি । বলে পেছনে নাকি দোকান । ভেবে দেখেছেন? মাটি থেকে ছয় সাত কিলো উপরে যেখানে কিনা মানুষ যায় না ভয়ে সেখানে দোকান আছে । দোকানে যাওয়ার আগে আমি মন্দিরের বারান্দায় শুয়ে গেছিলাম । এতটা ক্লান্তি অনেকদিন আমার হয়নি । দোকানে জিনিস আছে কিন্তু কোন মানুষ নাই !
মানুষ আছে কিনা দেখতে পাশে ঘর মতন একটা আছে । ওতে উঁকি মারতে গিয়ে দেখি অন্ধকারে পুরোহিত মশায় বসে আছেন । খুবই কাকতাল কিন্তু আমি তার দিকে তাকাতেই তিনি চোখ খুলে তাকালেন । বললেন সামনেই পুলিশ আছে আর তারাই দোকানদার । আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি । হয়ত সবাই এই একই প্রশ্ন করে । পুলিশ মহাশয়কে ডাকলাম, চিৎকার করে । "কেউ আছেন" এর উত্তরে এল "নামাজটা পড়েই আসছি।" পাহাড়ে তো পাশাপাশি প্রার্থনা করছে তারা । আমরা সমতলে কেন খুন করি? অবশ্য সেটাই পাহাড়ের একমাত্র চিত্র নয় !
জিনিস কিনে টাকা দিচ্ছি এমন সময় ছয় জনের একটা দল বলতে গেলে পাহাড় ফুঁড়ে উঠে এলেন ! মাথায় (লাল) তিলক নিয়ে আসা লোকগুলোর কোন ক্লান্তি ছিল না । একটা পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাও দেখি দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে । পাহাড় বেয়ে উঠে আসা লোকগুলো মোবাইলে একটা গান মতন কিছু ছেড়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন । শিব মন্দিরে প্রার্থনা বোধ হয় একটু ভিন্ন । অথবা তারা খুবই মগ্ন ছিলেন । বাইরে থেকে দেখে একটু ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক না । আমরা মানে আমি আর ফারহান অবাক চোখে দেখছি তখন দেখি জনা তিনেক আমাদের মতন বয়সী ছেলে আসল কোথা থেকে । ভীষণ দর্শন চেহারা, ব্যবহারও খুব সুবিধের না । প্রার্থনাও করেনা, দেখেও না । চোখগুলো মনে হল কোন যেন আমাদের ব্যাগের উপর ! শুনে আসা ডাকাতদের কাহিনিটা এবার মনে পড়তে লাগল । বলতে গেলে তাড়াহুড়োর মধ্যেই নেমে এলাম । নেমে আবার ঐ গাছটার নীচে বসলাম । এতক্ষণ বাতাস না থাকা অবস্থাটা আবার বদলে গেল । গাছটার নীচে অনেক বাতাস ! ফারহানের মতে গাছটার অলৌকিক মতন কিছু আছে নাহলে শুধু ঐ গাছটার নীচেই কেন বাতাস থাকবে । কাকতাল বলে উড়িয়ে দেয়া যায় নিশ্চিত আর ঘটনাটা ঘটেছে মোটে দু'বার । তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি ওখানে আমার মতন মানুষও জিনিসটাকে অন্তত অস্বীকার করি নি ।
আবার হাঁটা । সেই মাইল তিনেক পথ । এবারে পথটাকে অত কঠিন মনে হয় নি ! জলদি নেমেছি । ছবি তুলেছি । সাপের খোঁপ দেখেছি । রাস্তার ধারে কাঁদানগুলো কে খায় এটা নিয়ে ভেবেছি । আর একটা ঘটনা এবারে সাথে পানি ছিল, তাই শরীরও খুব অমান্য করে নাই । আবার বিমান বাহিনীর ক্যাম্পে বসে জিরিয়ে নেয়া । ঢাকার লোকজন কী করে আছে ওখানে সে গল্প শোনা । গোটা তিনেক কুকুর আছে ওদের নাম জানা । কুকুরগুলো আবার আমাদের খুব পছন্দ করেছিল । খাবার দিয়েছিলাম সেকারণেই হয়ত । এবারে বাকি ঝর্ণায় গোসল । তর সইছিল না গা ছেড়ে একটু ভেসে থাকতে ।
নামটা বোধহয় সুপ্তধারা । ঠিক মনে নেই । হাজার ফুট নীচে । নেমে যেতে বুঝলাম শরীরের উপর দিয়ে গেছে অনেক আজ । ঝর্ণায় নেমে মনটা ভাল হয়ে গেল । কেউ নেই । বান্দা বলতে আমরা দুজন । পারিবারিক রিসোর্ট মনে হচ্ছিল । ফারহানের মা ফোন গিয়েছিলেন পথিমধ্যেই । কথা বলা শেষ করে নেমে যাওয়া ঝর্ণায় ! সাঁতার কাটা । ভেসে থাকা । গোসল করা । জীবন নিয়ে যত না বলা কথা । কয়েক বছর পর এরকম সব থাকবে কিনা কতকিছু নিয়ে ভাবা । মাঝে বোধহয় কথা বলা হয় নি আমাদের মিনিট দশেক । ওটাও হয়ত দরকার ছিল । কোনফাঁকে যে ঘণ্টা দেড়েক কেটে গেল বোঝার কোন উপায়ই নেই । প্রকৃতি আমাদের টানে, আমরাও প্রকৃতিকে ভালবাসি । এটা যে কী দরকার ছিল বলে বোঝানো যাবে না ।
উঠতে গিয়ে খেয়াল হল যে পেটে ভাত পড়েনি । খুবই খিদে দুজনের এবং প্রচণ্ড ক্লান্ত । বলে রাখি, হাজার ফুট নামতে যত সহজ উঠতে ঠিক ততটা নয় । এরমধ্যে সফরসঙ্গী যদি ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাহলে তো কথাই নেই । বল্লভের অভাবটা টের পেয়েছি ভাল । উঠে দরদাম না করেই সিএনজিতে উঠে পড়া আর বাইরে গিয়ে টের পাওয়া যে টাকা নেই পকেটে ! এই সমস্যা আমাদের । খরচ করার সাধ্য কম, বলতে গেলে নেই-ই । তবে সাধ অনেক । যা হোক, বিকাশের দোকানটা ছিল বলে রক্ষা । টাকা তুলে গেলাম সীতাকুণ্ড বাজার উল্টোপথে । একটাই কারণ - পেটপুজো । অনেকদিন এত সাধ করে খাই নি । আমরা পরের দুইদিন ঐ এক আহারের জন্য স্বাভাবিক খেতে পারি নি । এত খেয়েছি ! বিলটা সাধ্যের মধ্যেই ছিল । বের হয়ে পরে কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে বাসে উঠে পড়া । লক্ষ্য চট্টগ্রাম শহর । বন্ধু তাজওয়ার অপেক্ষা করছে । নিমন্ত্রণ রক্ষা তো করতেই হচ্ছে ! হাহা । শহরের মজার বেশি কৃতিত্বটা পাবে খাবার । সে গল্প বলার চেষ্টা থাকবে পরের পর্বে । পুরোটা পথ ক্লান্তি কাটানোর চেষ্টা । আমি তো বসে বসে চাটগাঁ দেখছি । এখনো পুরো কৈশোর হারায় নি ঢাকার মত । আর ফারহান কী করছিল? ঠিক ধরেছেন- ফোনে ! (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ রাত ৮:৪৫