অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসা বালিকে হত্যার দায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের দুটি, ধর্মান্তরিত করার একটি এবং লুটপাট, অগ্নিসংযোগ নির্যাতনের তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তবে এগুলোর জন্য আলাদা কোন দণ্ড প্রদান করা হয়নি। রায় ঘোষণার ২৯ দিনের মাথায় ২৮ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল দায়ের করে। সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও দণ্ড না দেওয়ায় ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে, সাঈদীকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ২১(৪) ধারা অনুযায়ী আপিল দাখিল করার ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এই ৬০ দিনের সময়সীমা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে তা ১৯৭৩ সালের আইনে স্পষ্ট নয়। ফলে টানা ৬০ দিন নাকি ৬০ কার্যদিবস, সেই বিতর্ক রয়েছে। ২৮ মার্চ থেকে টানা হিসাব করলে ২৭ মে ৬০ দিনের সময় পার হয়েছে।
দ্য সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপিলেট ডিভিশন) রুলস ১৯৮৮ এর Order I, Rule 5 অনুযায়ী – ‘Where any particular number of days is prescribed by these Rules, or is fixed by an order of the Court, in computing the same, the day from which the said period is to be reckoned shall be excluded and, if the last day expires on a day when the office of the Court is closed, that day and any succeeding days on which the office of the Court remains closed shall also be excluded.’
এই বিধিতে অবশ্য কোর্টের আদেশের অধীনে ঠিক করা দিন কিংবা সুপ্রীম কোর্ট (আপিল বিভাগ) রুলের অধীনে নির্ধারণ করা দিন গণনা সম্পর্কে বলা হয়েছে। দিন গণনার ক্ষেত্রে প্রথম দিন বাদ যাবে, শেষ দিন ছুটির দিন হলে সেটিও বাদ যাবে এবং কোর্ট বন্ধের দিনগুলো বাদ যাবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে কার্যদিবস বিবেচনায় নেওয়া হবে। এটিই বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের প্র্যাকটিস। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আপিলের ক্ষেত্রে দিন গণনা কীভাবে হবে তা স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া না হলেও ধরে নেয়া যায় আপিল বিভাগ নিজেদের রুল (১৯৮৮ সালের) অনুসরণ করছেন। সেক্ষেত্রে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে রায় আসার কথা।
কিন্তু ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে কি সাঈদীর মামলায় আপিলের রায় প্রদান সম্ভব? শুক্র ও শনিবার কোর্ট বন্ধ থাকে। সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও কোর্ট বন্ধ থাকে। তাহলে মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসের কার্যদিবসগুলো নিম্নরূপ-
মার্চ – ৩১
এপ্রিল – ১, ২, ৩, ৪, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৮, ২৯, ৩০
মে – ২, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০
জুন – ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২৩, ২৪, ২৫
তার মানে ২৫ জুন সাঈদী মামলায় আপিলের ৬০ কার্যদিবস পূর্তি হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত সাঈদীর মামলায় আপিলের যে অগ্রগতি হয়েছে তা দেখে নেওয়া যাক।
২৮ মার্চ – রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আপিল। আপিল নম্বর ৩৯/২০১৩ ও ৪০/২০১৩। রায় প্রদানের ২৯ দিনের মাথায় আপিল করা হয়।
১৭ এপ্রিল – শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য আবেদন করা হয়। চেম্বার বিচারপতি বিষয়টির ১৮ এপ্রিলে শুনানির জন্য নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন।
১৮ এপ্রিল – আপিলের শুনানির তারিখ ২ মে ধার্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
২ মে ২০১৩, বৃহস্পতিবার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ৩১ নম্বর কার্যতালিকায় (সি বেঞ্চ) থাকলেও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।
৫ মে ২০১৩, রোববার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ৪২ নম্বর কার্যতালিকায় (বি বেঞ্চ) থাকলেও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।
৬ মে ২০১৩, সোমবার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ৪২ নম্বর কার্যতালিকায় (এ বেঞ্চ) থাকলেও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।
৭ মে ২০১৩, মঙ্গলবার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ৬ নম্বর কার্যতালিকায় (সি বেঞ্চ) ছিল। শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদেশ প্রদানের জন্য পরবর্তী দিন নির্ধারিত থাকে।
৮ মে ২০১৩, বুধবার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ১ নম্বর কার্যতালিকায় (এ বেঞ্চ) থাকলেও শুনানি পাস ওভার (Pass over) করা হয়।
৯ মে ২০১৩, বৃহস্পতিবার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ১ নম্বর কার্যতালিকায় (এ বেঞ্চ) থাকলেও শুনানি পাস ওভার (Pass over) করা হয়।
১২ মে ২০১৩, রোববার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ২ নম্বর কার্যতালিকায় (এ বেঞ্চ) থাকলেও শুনানি পাস ওভার (Pass over) করা হয়।
১৩ মে ২০১৩, সোমবার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ১ নম্বর কার্যতালিকায় (এ বেঞ্চ) ছিল। আপিলের সারসংক্ষেপ ২২ মের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। (In Criminal Appeal No. 40 of 2013, Respondent is directed to file concise statement by 22nd May, 2013.)
২২ মে ২০১৩, বুধবার – সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টের ১ নম্বর কার্যতালিকায় (এ বেঞ্চ) থাকলেও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি।
৩০ মে সাঈদীর মামলায় আপিলের ৪২তম কার্যদিবস পার হয়েছে। অথচ এই মামলার ১ দিনের শুনানিও এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা শুনানি উপস্থাপন শুরু করেননি। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় পাঠও হয়নি। মামলার আপিল নিষ্পত্তির জন্য ২০-২৫ দিবসের শুনানি প্রয়োজন। সাঈদীর মামলার ধীরগতি নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা যাক।
এক. কাদের মোল্লার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে ৩ মার্চ এবং আসামিপক্ষ আপিল করে ৪ মার্চ। ৪ মার্চ আপিলের শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য আবেদন দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ১ এপ্রিল থেকে কাদের মোল্লার মামলায় আপিলের শুনানি শুরু হয়। অন্যদিকে ২৮ মার্চ সাঈদীর মামলায় আপিল দাখিল করা হলেও শুনানির দিন নির্ধারনের জন্য আবেদন করা হয় ১৭ এপ্রিল। শুরুতেই ১৩ কার্যদিবস পার হয়ে যায়।
দুই. কাদের মোল্লার মামলার আপিলে ৫০তম কার্যদিবসের মধ্যে (৩০ মে ২০১৩) মোট ২০ দিনের শুনানি হয়েছে। সেখানে সাঈদীর মামলার আপিলে ৪২তম কার্যদিবসের মধ্যে (৩০ মে ২০১৩) ১ দিনের শুনানিও অনুষ্ঠিত হয়নি!
তিন. অনেকগুলো দিনে সাঈদীর মামলায় আপিল শুনানি সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় থাকলেও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। কিছু দিনে শুনানি পাস ওভার করা হয়েছে।
সাঈদী মামলার আপিলে রায় প্রদানের জন্য আর মাত্র ১৮ কার্যদিবস বাকি আছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের ও আসামিপক্ষের শুনানি শেষ করা প্রায় অসম্ভব! এখন প্রায় বলেই দেওয়া যায় যে, সাঈদীর মামলায় আপিলের রায় ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে হচ্ছে না!
এখন অনেক যুক্তি আসছে এবং আসবে। বলা হচ্ছে এবং হবে- ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করার বিধানটি বাধ্যতামূলক নয়, এটা নির্দেশনমূলক। সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে আপিল বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা অনেক। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিল বিভাগ সময় বৃদ্ধি করে শুনানি শুনতে পারে।
কিন্তু একটি মামলার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করার চেষ্টাটাও গুরুত্বপূর্ণ। একটি মামলার ৪২ কার্যদিবস পার হয়ে গেল, কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ শুনানি উপস্থাপন শুরু করতে পারেনি। এটিই দুঃখজনক।