গত রোববার জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) (সংশোধন) বিল-২০১৩ পাস হয়েছে। সোমবার এই বিলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেছেন। এর কার্যকারিতা ২০০৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে প্রযোজ্য হবে। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। মূলত সরকার ও বাদীপক্ষের আপিলের সমান সুযোগ রাখার জন্যই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যুদ্ধকালীন অপরাধের (যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ইত্যাদি) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কতদিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করবেন তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সংশোধিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, আপিল দায়েরের ৪৫ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে। প্রয়োজনে আরও ১৫ দিন সময় বেশি নেওয়া যাবে। তবে অবশ্যই ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে। সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইনের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে তা হলো, যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে সংগঠনগুলোর বিচার। এখানে উল্লেখ্য, সংগঠনগুলোর বিচার কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যই হবে না। চিহ্নিত রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩ ধারার সংজ্ঞা অনুযায়ী একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার সঙ্গে দলগতভাবে যুক্ত ছিল।
আইনের সংশোধনের ফলে ব্যক্তির পাশাপাশি দল ও সংগঠনের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। অবশ্য এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে 'বা অন্য কোন ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন' শব্দগুলো যুক্ত করা হয়। এর ফলে ২০১৩ সালে এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৩ নম্বর ধারায় যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করার বিধান যুক্ত করা সহজেই সম্ভব হয়েছে।
যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে সংগঠনের বিচার কেমন হতে পারে? কীভাবে সেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে? এ সম্পর্কিত কোনো নজির রয়েছে কি-না? বিচারের পর শাস্তি কী হবে? শাস্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা যাবে কি-না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই এই লেখা। যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে সংগঠনের বিচারের নজির রয়েছে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে। ১৯৪৫ সালের ২০ অক্টোবর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের বিচারকাজ শুরু হয়। এতে অভিযোগকারী পক্ষ ২৪ জন প্রধান যুদ্ধাপরাধী ও ৭টি সংগঠনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনাল ৭টি সংগঠনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগই আমলে নেয়। সংগঠনগুলো হলো_ ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (নাৎসি পার্টি), রাইখ ক্যাবিনেট, এসএস, এসএ, এসডি বাহিনী, গেস্টাপো এবং জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চতর নেতৃত্ব। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল নাৎসি পার্টি, এসএস, এসডি, গেস্টাপো বাহিনীকে 'অপরাধী সংগঠন' হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে রায় প্রদান করে। ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়া অপরাধী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একই অপরাধে বিচারের পথ তখন উন্মুক্ত হয়। অপরাধী সংগঠন হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়। এই দলের সদস্যদের একই উদ্দেশ্যে (কমন পারপাস) কাজ করার বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে। দলের সদস্যদের দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্র (ক্রিমিনাল কনসপিরেসি) প্রমাণ করতে হবে। ন্যুরেমবার্গ চার্টারে সংগঠনের শাস্তির কথা আলাদা করে বলা হয়নি। চার্টারের ৯ ও ১০ অনুচ্ছেদে সংগঠনের বিচারের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী_ যে কোন গোষ্ঠী বা সংগঠনের একজন সদস্যের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা গোষ্ঠীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। ১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অপরাধী সংগঠন হিসেবে সাব্যস্ত হওয়া সংগঠনগুলোর সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে। বিচারের সময় সংগঠনের অপরাধমূলক প্রকৃতি প্রমাণিত বলে ধরে নেওয়া হবে এবং তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে সংগঠনগুলোর বিচারের ক্ষেত্রে জাজমেন্ট হিসেবে কেবল এগুলোকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের একই অপরাধে যুক্ত থাকায় শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে সংগঠনের বিচারের ক্ষেত্রে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের নজির বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। কীভাবে সংগঠনগুলোকে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দু'ভাবে দেওয়া সম্ভব। প্রথমত, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালকে অনুসরণ করেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তির বিচারের সময় সংশ্লিষ্ট সংগঠনকে 'অপরাধী সংগঠন' হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার কাজ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে আবারও পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থাৎ ন্যুরেমবার্গ চার্টারের ৯ অনুচ্ছেদের মতো একটি ধারা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে যুক্ত করতে হবে। যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে সংগঠনকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা এবং এসব সংগঠনের সদস্যদের শাস্তি প্রদানের এখতিয়ার প্রদান করতে হবে ট্রাইব্যুনালকে। দ্বিতীয়ত, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের নজির অনুসরণ করে পরিবর্তিতরূপে বিচারকাজ করা সম্ভব। একটি মামলার ভেতরেই সবগুলো সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারে রাষ্ট্রপক্ষ। সেই মামলার ভিত্তিতেই যুদ্ধকালীন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সকল সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব। কোনো সংগঠনকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের নজির গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধন করে সংগঠনের শাস্তির বিধান যুক্ত করা জরুরি। কারণ বর্তমান আইনে সংগঠনের বিচারের পর শাস্তি কী হবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। যদিও আইনের ২০(২) ধারার লিবারেল ব্যাখ্যা করে ট্রাইব্যুনাল চাইলে বিদ্যমান আইনের মধ্যে থেকেই দোষী সংগঠনের শাস্তি প্রদান করতে পারে। তবে ২০ ধারায় সংশোধন এনে সংগঠনের শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট করে নেওয়াই ভালো। শাস্তি হিসেবে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতো সংগঠনগুলোকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। পাশাপাশি এসব সংগঠনকে নিষিদ্ধ ও সংগঠনের যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধান থাকতে পারে আইনে। সংগঠনের সদস্যদের ক্ষেত্রে 'যুক্ত থাকার অপরাধেরই' শাস্তি প্রদান সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে না পারে সেই বিধানও যুক্ত হতে পারে।
সংগঠনের বিচারের ক্ষেত্রে আলোচনায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) নাম। শাহবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। যুদ্ধকালীন অপরাধের মামলায় বিচার করে এসব রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা যাবে কি? এক কথায় উত্তর_ সম্ভব হবে। তবে সেক্ষেত্রে জাতীয় সংসদকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে নাৎসি পার্টিকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। নাৎসি পার্টির কর্মকাণ্ড ১৯৪৫ সালের মে মাসেই শেষ হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নাৎসি পার্টি বিলুপ্ত হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্রদ্ব ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের এবং ফ্রান্সের প্রভিশনাল সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাৎসি পার্টিকে বিলুপ্ত ও বেআইনি ঘোষণা করা যায়। নিষিদ্ধের এই আদেশ জার্মানিতে এখনও বহাল আছে। তবে পরে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের রায়ে নাৎসি পার্টি অপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় চুক্তির ৩৮ অনুচ্ছেদের লিগ্যালিটি শক্ত অবস্থান পায়। যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে অপরাধী সংগঠন হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সংগঠনটি চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের নজির বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘকে যুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য নিষিদ্ধ করতে হলে জাতীয় সংসদকে ভূমিকা রাখতে হবে। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসেবে ৫টি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। এগুলো হলো_ জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, পাকিস্তান নেজামে ইসলাম ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি। কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। সেই ইতিহাস বিবেচনায় রাখা জরুরি। প্রথম পর্যায়ে, যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে বিচার করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘকে (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) ট্রাইব্যুনাল অপরাধী সংগঠন হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে এবং নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ জারি করতে পারে। দ্বিতীয় পর্যায়ে, জাতীয় সংসদকেই ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে এ বিষয়ে আইন পাস করতে হবে। নির্বাচন কমিশন তখন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়ার আইনি ধাপগুলো অনুসরণ করা জরুরি। না হলে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আবারও জামায়াতের পুনর্বাসনের সুযোগ তৈরি হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর সংশোধনের মাধ্যমে যুদ্ধকালীন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর বিচার করার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি বাহিনীর বিচার করতে হবে। পাশাপাশি এই সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে ব্যক্তির বিচারও করতে হবে। উল্লেখ্য, বাচ্চু রাজাকারের মামলার রায়ে গণহত্যার সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
যুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে সংগঠনকে বিচারের মুখোমুখি করতে হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের আরও একটি সংশোধনী আনা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আইনে সংশোধনী এলেই রাষ্ট্রপক্ষ সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের উদ্যোগ নিতে পারে। আইনি দীর্ঘসূত্রতা এড়াতে সবগুলো দায়ী সংগঠনকে একই মামলার অধীনে এনে বিচার করা যেতে পারে।