মত প্রকাশ ও লেখালেখির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ব্লগ। সাইবার পরিসর মিথস্ক্রিয়ার যে সুযোগ করে দিয়েছে তারই সফল প্রয়োগ ঘটেছে ব্লগে। নিজের মতো করে লেখার স্বাধীনতা তৈরিতে ব্লগের অবদান স্বীকার করতেই হবে। ব্লগের জনপ্রিয়তা খুব পুরনো কিছু নয়। ব্লগ বিষয়টি মূলত এই শতাব্দীতে এসে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেল ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার পরবর্তীতে ব্লগ জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্লগের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ে। লক্ষ্য করা যাক, ব্লগের উত্থান ও জনপ্রিয়তা পর্বের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বর্তমান বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা। ব্লগ তার জন্মগত বিষয়াবলীর চরিত্র ধরে রেখেছে। ফলে এখনও নানা বৈশ্বিক ঘটনায় ব্লগ কমিউনিটি আন্দোলিত হয়, ব্লগারদের মতামত প্রদানের পরিমান বেড়ে যায়। বাংলা ভাষায় ব্লগ শুরু হয়েছে ২০০৪ সালে। ইউনিকোড ফন্ট ও ব্লগস্পটের মতো ফ্রি ওয়েবসাইটের কল্যানে শুরুর দিকে বাংলা ব্লগিং যাত্রা শুরু করে। তবে তখনও ইউনিকোডে লেখা বা ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা ব্লগ চালানো সহজ ছিল না। লক্ষ্যনীয় বাংলা ব্লগ যাত্রা শুরু করে ব্যক্তিগত ব্লগিং থেকে। যদি শুরুর দুই বছর বাংলা ব্লগিং সমন্ধে বেশিরভাগ মানুষ এমনকি অন্তর্জালের মানুষরাও জানতো না। বর্তমানে আমরা যে আকারে বাংলা ব্লগকে দেখছি তার যাত্রা শুরু ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে। এখন বাংলা ব্লগ বলতেই আমরা শুরুতে বুঝি কমিউনিটি/স্যোশাল বাংলা ব্লগ। বাংলাদেশে ব্লগ এখন জনপ্রিয় মাধ্যম। এরইমধ্যে বাংলাভাষী ব্লগারের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
ব্লগ কী?
ব্লগকে আমরা বাংলাভাষী ব্লগাররা চিনেছি ইচ্ছামতো লেখালেখির সাইট হিসেবে। প্রথম বাংলা কমিউনিটি ব্লগের নির্মাতারাও ব্লগকে ইচ্ছামতো লেখালেখির সাইট হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মূলত ব্লগ ধারণা এর চর্চার মাধ্যমে পরিণত রূপ লাভ করেছে। শুরুর দিকে কাগজের দিনলিপির অনলাইন সংস্করণ হিসেবে ব্লগ যাত্রা শুরু করে। ইংরেজি শব্দ blog এর কোন বাংলা করা হয়নি। বাংলায় শব্দ হিসেবে ব্লগকেই গ্রহণ করা হয়েছে। Web log এর সংক্ষিপ্ত রূপ blog,যার মাধ্যমে অনলাইন জার্নাল বা অনলাইন দিনলিপি বুঝানো হয়। তবে যে ধারণার উপর ভিত্তি করে ব্লগের সূচনা বহুমুখী চর্চার মাধ্যমে সেই ধারণা থেকে অনেকটুকুই সরে এসেছে ব্লগার কমিউনিটি। যারা ব্লগ লেখেন (পোস্ট করেন) তাদের ব্লগার বলা হয়। এখন ব্লগ কেবল দিনলিপি লেখার জায়গা না, এটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবে বিকল্প গণমাধ্যম, পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
ব্লগের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যোগাযোগের তাৎক্ষনিকতা ও দ্বিমাত্রিকতা। এখানে যোগাযোগ দ্বিমাত্রিক। একজন ব্লগার একইসাথে লেখক, সমালোচক ও পাঠক। ফলে ব্লগারকে নিজের লেখায় আসা মন্তব্যের জবাব দিতে হয় আবার সহ ব্লগারদের লেখার মন্তব্য করতে হয়। এইটা ব্লগ চর্চার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। যার ফলে ব্লগে ব্লগারদের মন্তব্য আদান প্রদান ঘটছে। ব্লগে লেখে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য জানা সম্ভব হচ্ছে।
অন্য যেকোন সাইট থেকে ব্লগকে আলাদা করা যায় এর প্রাণবন্ত রূপ, বিপরীত ধারাক্রমিক উপস্থাপনা এবং উত্তম পুরুষের প্রাধান্য দেখে (মার্ক ট্রেমায়েন, ব্লগিং, সিটিজেন অ্যান্ড দ্য ফিউচার অব মিডিয়া, ২০০৭)। তবে মার্ক ট্রেমায়েনের এই পর্যবেক্ষনের ফলও ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। ব্লগে উত্তম পুরুষের প্রাধান্য কমছে, সেখানে স্থান করে নিচ্ছে সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণ। সুতরাং ব্লগের একটি সংজ্ঞা দাড় করানো যাক। ব্লগ এমন একটি মাধ্যম যেখানে মুক্তভাবে লেখালেখি করা যায়, যাতে মিথস্ক্রিয়ার চর্চা রয়েছে এবং যাতে যোগাযোগের তাৎক্ষনিকতা ও দ্বিমাত্রিকতা রয়েছে।
বেশিরভাগ ব্লগই কোন বিষয়ে ধারাবিবরণী বা সংবাদ জানায়। এটি আধুনিক ব্লগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে এর মধ্যেও কিছু কিছু ব্লগ ব্যক্তিগত দিনলিপি ঘরাণার। ব্লগের নিয়মমাফিক লেখার ব্যাপার হয়েছে। সাম্প্রতিক মন্তব্য, সর্বাধিক মন্তব্য, সর্বশেষ পোস্ট এই ধরনের ফিচারের উপস্থিতি রয়েছে ব্লগে। এছাড়া ছবি ব্লগ ও ভিডিও ব্লগও হাল আমলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে ব্লগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গটি হলো পাঠকদের মিথষ্ক্রিয়া। ব্লগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিষয়ভিত্তিক ব্লগ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে আর্ট ব্লগ,ফটো ব্লগ, ভিডিও ব্লগ, অডিও ব্লগ, টেক ব্লগ ইত্যাদি। আবার টুইটারের মতো সাইটের জনপ্রিয়তার কারণে মাইক্রোব্লগিং খুবই জনপ্রিয়। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডিসেম্বর, ব্লগ খোঁজারু ইঞ্জিন টেকনোরাট্টি প্রায় এগারো কোটি বার লাখেরও বেশি ব্লগের সন্ধান পেয়েছে।
ব্লগ সম্পর্কে সামহ্যোয়ারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষ লেখেছেন, “ব্লগ হচ্ছে ওয়েবলগের সংক্ষেপ। এটি একধরনের ওয়েবসাইট; একটি অনলাইন জার্নাল বা ডায়েরী। অনেকেই নিজস্ব ওয়েবসাইটের বদলে ব্লগ রাখতে পছন্দ করেন, কারণ এটি সহজেই আপডেট করা যায় ও কোন কারিগরী জ্ঞান দরকার হয় না। ব্লগ একটি খুবই ফ্লেক্সিবল লেখার মাধ্যম যাতে লেখার পাশাপাশি ছবি আর ভিডিও সংযুক্ত করা সম্ভব। এতে আপনি ডায়রী লেখার মত নিজের ভাবনা, অভিজ্ঞতা অপরের সাথে শেয়ার করতে পারবেন। এমনকি অন্যের লেখা বা ছবির উপর আপনার নিজস্ব মতামত রেখে অনেকের সাথে কথোপকথন শুরু করতে পারেন।” (সামহ্যোয়ারইনব্লগ, http://www.somewhereinblog.net/faq)। তবে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে কমিউনিটি বাংলা ব্লগিংয়ের প্রাথমিক পর্বে নোটিশবোর্ড থেকে পোস্ট দিয়ে ব্লগ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী “ সাধারণত ব্লগ বলতে আপনার নিজস্ব একটি স্থান বুঝায় যেখানে আপনি আপনার নিজের কথা প্রকাশ করতে পারেন। আমরা আপনাকে আপনার পৃথক ব্লগ ঠিকানা তৈরী করে দেই। এই ব্লগের ডান পাশে 'আমার পছন্দের লিংক' থেকে আপনি ব্লগ ঠিকানার উপস্থাপনটি দেখতে পারবেন। আপনার ব্লগের ঠিকানা আপনি নিজে পছন্দ করবেন। আপনি মন খুলে আপনার কাছের মানুষদেরকে আপনার এই ব্লগের ব্যাপারে জানাতে পারেন, আপনার ব্লগের তথ্য আপনার উপরে নির্ভর করে। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রফেশনাল ব্লগের প্রতি আগ্রহী, অন্যরা সেথায় একটি ব্লগকে নিজের ডায়ারি কিংবা কবিতার পাতা অথবা নিজের কর্মসূচি হিসেবে মনে করেন।” (নোটিশবোর্ড, ব্লগ বলতে কি বুঝায়, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, ৩০ জানুয়ারি ২০০৬)। তবে ব্লগ ধারণার যে বিবর্তন ঘটেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্লগার আইরিন সুলতানার লেখা থেকে, “ব্লগ এর সংজ্ঞায়নে এখন যথেষ্ট বহুমুখিতা এসেছে। এক সময় ব্লগ বলতে বোঝানো হতো আন্তর্জালিক ডায়েরি। তারপর এর ব্যবহার, প্রচার একে বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে। ক্রমাগত ব্লগ এমন একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠলো যেখানে একই সাথে বিদ্যমান পাওয়া গেল তত্ত্ব, তথ্য এবং সাহিত্য।” (আইরিন সুলতানা, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, ২৪ ডিসেম্বর ২০১০)।
ব্লগের বিকাশ পর্ব
ব্লগ জনপ্রিয় হওয়ার আগে ডিজিটাল গোষ্ঠীগুলোর নানান ধরন ছিল, নানা সাইট প্রচলিত ছিল। সে সময় ছিল ইউজনেট (Usenet), জিনি (GEnie)ও বিক্স (BiX)-এর মতো বাণিজ্যিক অনলাইন সার্ভিস। ১৯৯০ সালের দিকে, ইন্টারনেট ফোরাম সফটওয়্যার ‘থ্রেড’-এর মাধ্যমে কথোপকথন চালানোর ব্যবস্থা শুরু করে। থ্রেড হচ্ছে একটা ভার্চুয়াল মাধ্যম যা বার্তাগুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি করে। সেইসময় জনপ্রিয়তা লাভ করে থ্রেড। এই থ্রেডের আকারেই পরবর্তীতে অনলাইন ফোরামগুলো যাত্রা শুরু করে এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ব্লগের উৎপত্তি ঘটে অনলাইন দিনলিপি থেকে, যেখানে লোকেরা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের বিবরণ রাখতেন। এধরনের বেশিরভাগ লোকেরাই নিজেদের বলতেন ডায়েরিস্টস, জার্নালিস্টস কিংবা জুমালারস। জাস্টিন হল সোয়ার্থমো কলেজের শিক্ষার্থী থাকার সময় ১৯৯৪ সালে অনলাইন দিনলিপি লেখার আকারে ব্লগিং শুরু করেন। তাই তাকে আদি ব্লগার হিসাবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। জেরি পুমেলও কাছাকাছি সময়ে ব্লগিং শুরু করেছেন। তাকেও আদি ব্লগার হিসাবে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে ডেভ উইনানের স্ক্রিপ্টিং নিউজকে সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয় বেশি দিন ধরে চালু থাকা ওয়েবলগ (ব্লগ) বলা হয়। প্রথম দিকের ব্লগগুলোতে তেমনভাবে আলাদা কোন বৈশিষ্ট ছিল। সাধারণ আর দশটা ওয়েবসাইটের মতোই ছিল যাতে ব্যক্তিগত দিনলিপি লেখা হতো। তাছাড়া তখন ব্লগ ব্যবহার প্রক্রিয়াও ছিল বেশ জটিল। ফলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বা প্রযুক্তি দক্ষ লোকেরাই ব্লগের সাথে যুক্ত হয়েছেন শুরুর দিকে। সময়ের সাথে ব্লগ ব্যবহার প্রক্রিয়া সহজ হয়। বিশেষ করে কিছু কিছু ফ্রি ব্লগ সার্ভিস ব্লগিং বেশ সহজ করে দিয়েছে। এখন ব্লগ হোস্ট করার জন্য রয়েছে নির্ধারিত ব্লগ হোস্টিং সার্ভিস। এছাড়াও সেগুলো ব্লগ সফটওয়্যার কিংবা নিয়মিত ওয়েব হোস্টিং সার্ভিস ব্যবহার করেও ব্লগ চালানো যায়। ১৯৯৭ সালের দিকে একটি দল ছোট ব্লগ কমিউনিটির মতো গড়ে তুলেছিল। এরা দ্য মিস্যানথ্রোপিক বিচ নামে পরিচিত। তারা নিজেদের অনলাইন উপস্থিতির নাম দিয়েছিল জাইন (zine)। তবে তাদের সেই নামকরণ জনপ্রিয়তা পায়নি।
১৯৯৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জর্ন বার্জার প্রথম ‘ওয়েবলগ’ শব্দ ব্যবহার করেন। ১৯৯৯ সালের এপ্রিল বা মে মাসের দিকে পিটার মেরহোলজ তার ব্লগ পিটারমে ডট কম (PeterMe.com)-এর সাইডবারে ওয়েবলগ (weblog) শব্দটা ভেঙে উই ব্লগ (we blog) হিসেবে লেখেন। একটা পর্যায়ে ওয়েবলগের সংক্ষিপ্ত রূপ হয়ে যায় ব্লগ। ইভান উইলিয়ামস ‘ব্লগ’ শব্দটা বিশেষ্য এবং ক্রিয়া দুটো হিসেবেই ব্যবহার করা শুরু করেন (ব্লগ করা মানে দাঁড়ায় ওয়েবলগ সম্পাদনা করা বা ওয়েবলগে লেখা দেওয়া")।
[একুশে বইমেলা ২০১২ তে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত 'বাংলা ব্লগের ইতিবৃত্ত' বই থেকে]