রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার রাতে সরকারের এক তথ্য বিবরণীর মাধ্যমে এই তথ্য জানা গেছে।
তথ্য বিবরণী (নম্বর- ১২৭৯) অনুযায়ী, “প্রধানমন্ত্রী Rules of Business 1996-এর rule 3(iv)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানপূর্বক দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেছেন।”
সরকার থেকে জারী করা তথ্য বিবরণীটির বিশ্লেষণ করা যাক। তথ্য বিবরণীতে তারিখ উল্লেখ আছে- ‘ঢাকা, ৪ বৈশাখ (১৭ এপ্রিল)’। তথ্য বিবরণীর কয়েকটি দিক-
১. প্রধানমন্ত্রী Rules of Business 1996-এর rule 3(iv)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে
২. রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত
৩. সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদানপূর্বক
৪. দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেছেন
উল্লেখিত পয়েন্টগুলো আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা যাক। প্রথমেই দেখে নেই কী আছে রুলস অব বিজনেস (কার্যবিধি) ১৯৯৬ এর রুল ৩(৪) তে।
3. Allocation of Business.⎯ (iv) The Prime Minister may assign a Division or a Ministry or more than one Division or one Ministry to the charge of the Prime Minister, a Minister or a Minister of State :
Provided that a Division or Ministry not so assigned shall be in direct charge of the Prime Minister.
এই রুল অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারেন।
এবার তথ্য বিবরণীর ২ নং পয়েন্টের দিকে লক্ষ করা যাক। তথ্য বিবরণীতে পরিস্কারভাবে লেখা আছে ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত’। তার মানে ১৭ এপ্রিল রাত পর্যন্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। অথচ ১৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অব্যহতি নেওয়ার কথা জানান সুরঞ্জিত। সংবাদ সম্মেলনে দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, “অনেকেই মনে করেন, আমি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলে এই তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। সুতরাং এই ব্যাপারে গণতন্ত্রের মাত্রাকে সৃদৃঢ় করার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতি টেনে, গণতন্ত্রের মধ্যে আজকে আমি সেটুকু অবদান রেখেই বলতে চাই, আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও যেহেতু রেলের সমস্ত সফলতা আমার ওপর বর্তায়, ব্যর্থতাও আমার ওপর বর্তায়। সে কারণে এই ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নিয়ে আমি রেলের মন্ত্রী হিসেবে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে পারি এবং সেই লক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার পত্র আমি প্রেরণ করব।” তিনি আরও বলেন, “রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেশবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে আমি রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার মধ্য দিয়ে তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা, সংশয়, সন্দেহের অবসান ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।” তিনি বলেছিলেন, “এই তদন্তের মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারব।”
একদিন যেতেই প্রমাণ হলো এসবই ছিল নাটক। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, রেলমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগপত্র প্রদাণ করলেও প্রধানমন্ত্রী ওই পদত্যাগ সরাসরি গ্রহণ না করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দপ্তর ছাড়া মন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত নেন। সবগুলো সংবাদমাধ্যমে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদত্যাগের খবর প্রচার/প্রকাশ করা হয়। আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা সুরঞ্জিতের ‘পদত্যাগের’ প্রশংসাও করেন।
মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগের পদ্ধতি সংবিধানের ৫৮(১)(ক) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। সে অনুযায়ী- “৫৮। (১) প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি- (ক) তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।” ফলে সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদ শূন্য হওয়ার কথা। অথচ সরকারের ১৭ এপ্রিলের তথ্য বিবরণীতে ১৬ এপ্রিল পদত্যাগ করা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে ১৭ এপ্রিল তারিখেও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী দেখানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অব্যহতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গতকাল মন্ত্রণালয় থেকে পতাকবিহীন গাড়িতে করে ফিরে যান। এতে বোঝা যায় তিনি মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করার মানসিক প্রস্তুতি সম্পন করেছিলেন। রুলস অব বিজনেস এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী কে কোন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকবে তা কেবল নির্ধারণ করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কেবল রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে অব্যহতি নিয়ে মন্ত্রী হিসেবে থাকতে পারেন না, পদত্যাগ/ অব্যহতি নিতে হলে মন্ত্রী হিসেবেই নিতে হবে।
সুতরাং বলা যায় সরকার থেকে জারী করা তথ্য বিবরণীটি আইনের কিছু বিষয় মেনে প্রকাশ করা হয়নি। তাছাড়া ১৬ এপ্রিল পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর (সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী) ১৭ এপ্রিল রাতে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার প্রক্রিয়াটি সংবিধানের ৫৮(১) (ক) অনুচ্ছেদের লংঘন।
প্রধানমন্ত্রী রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ এর রুল ৩(৪) অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পুনঃরায় মন্ত্রী (দপ্তরবিহীন) করতে পারেন, সেক্ষেত্রে সেটি হবে নতুন নিয়োগ। তাহলে সংবিধানের ১৪৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে আরেকবার শপথ নেওয়া উচিত।
১৪৮। (১) তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত যে কোন পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যভার গ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল-অনুযায়ী শপথগ্রহণ বা ঘোষণা (এই অনুচ্ছেদে "শপথ" বলিয়া অভিহিত) করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করিবেন।
এর আগেও সোহেল তাজকে নিয়ে একই ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র পাঠানো হলেও এখনও তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে।