একটা কথা ব্লগারদের খুব বলতে শোনা যায়। বিশেষ করে পুরনো ব্লগাররা এটি বেশি ব্যবহার করেন। তা হলো, ব্লগ পলিটিক্সের কারণে ব্লগ আর ভালো লাগে না। কিংবা কেউ কেউ বলেন, ‘সামুতে ব্লগ পলিটিক্স দেখে টায়ার্ড হয়ে গেছি’। ব্লগ পলিটিক্স ব্লগের বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলোর একটি। অতি ব্যবহারে শব্দযুগল সাধারণ মাত্রার শব্দ হয়ে গেছে। আদতে ব্লগ পলিটিক্স বা ব্লগ রাজনীতি বলতে কী বুঝায় তাই এখন সহজভাবে বোধগম্য নয়। সাধারণ বিবেচনায় অফিসে যেমন অফিস রাজনীতি রয়েছে, ঠিক তেমন ব্লগেও রয়েছে ব্লগ রাজনীতি। অফিস রাজনীতির ব্যাপারটি মাথায় রাখলে ব্লগ রাজনীতিকে বুঝা সহজ হবে। অফিস রাজনীতির মাধ্যমে অফিসের বড় কর্তাকে খুশি রাখার ব্যাপার থাকে, সহকর্মীদের নিয়ে গ্রুপিং করার ঘটনা থাকে, কারও নামে বদনাম করে তাকে পেছনে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা থাকে, আবার তোষামোদ করে কাজ হাসিল করার ব্যাপারও থাকে। ব্লগ পলিটিক্সের ব্যাপারটি অনেক এইরকম। এইখানে ব্লগের মালিকপক্ষকে খুশি রাখার ব্যাপার আছে, নিজেদের গোষ্ঠী তৈরি করে ব্লগ দখলের চর্চা আছে, কাউকে নোংরাভাবে আক্রমনের মাধ্যমে পেছনে ফেলে দেওয়ার প্রবণতাও আছে।
লক্ষ্য করা যাক, ব্লগাররা শব্দ হিসেবে ব্লগ রাজনীতি খুব একটা ব্যবহার করেন না। তারা ব্যবহার করেন ব্লগ পলিটিক্স। এর কারণ বিশ্লেষণ করা যায় বাংলা ব্লগে ব্লগারদের শব্দের ব্যবহারের ব্যঞ্জনা বিশ্লেষণ করে। পলিটিক্স শব্দটি ব্লগগুলোতে বেশিরভাগ অর্থেই নেতিবাচক ভাবে ব্যবহৃত হয়। এমনিতেই পলিটিক্সের প্রতি বর্তমান প্রজন্মের এক ধরনের বিতৃষ্ণা রয়েছে। সেই প্রভাব ব্লগেও পড়েছে। তবে এই আলোচনার জন্য আমি রাজনীতি শব্দটিকেই বেছে নিলাম।
ব্লগ রাজনীতি কি বাংলা ব্লগের শুরু থেকেই ছিল? এর উত্তর না। রাজনীতির উদ্ভব হয় একটি কমিউনিটিতে। ব্লগের শুরুর দিকে ব্লগ কমিউনিটিই দাড়ায়নি। ব্লগ কমিউনিটি পরিপূর্ণতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই উদ্ভব হয় ব্লগ রাজনীতির। বাংলা ব্লগ রাজনীতির উদ্ভব জনপ্রিয়তার পিছনে ছুটতে গিয়ে। ব্লগ বিকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারও কারও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলো, পাশাপাশি গোষ্ঠীবদ্ধতাও তৈরি হলো। এই গোষ্ঠীবদ্ধতার মাধ্যমেই ব্লগ রাজনীতি শুরু হয়েছে। বাংলা ব্লগিংয়ের আদি ব্লগ হিসেবে সামহ্যোয়ারইন ব্লগের অনেক পোস্ট এই ব্লগ রাজনীতির প্রমাণ ধরে রেখেছে। ব্লগ রাজনীতির বর্তমান যে রূপ আমরা দেখছি তাতে নতুন কোন ব্লগার আসলেই তার লেখার চেয়ে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ব্লগের গোষ্ঠীবদ্ধ অবস্থানের কথা বিবেচনা করা হয়। এই ব্লগ রাজনীতির জন্যই এক ধরনের বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় নতুন ব্লগারদের। বাছাই প্রক্রিয়ায় ঠিক করা হয় পক্ষের বা বিপক্ষের লোক। নতুন ব্লগারকে পক্ষের লোক মনে হলে তার ব্লগে কমেন্ট করা যাবে আবার বিপক্ষের লোক হলে তার ব্লগে কমেন্ট করা যাবে না। ব্লগার হয়ে উঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গে এই ব্লগ পলিটিক্সের সম্পর্ক রয়েছে। কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্লগার হয়ে উঠার পাশাপাশি অনেকেই হয়ে উঠেন ব্লগ পলিটিশিয়ান। বাংলা ব্লগ পলিটিক্সে গোষ্ঠীবদ্ধতার চর্চাই বেশি হয়। ফলে নতুন ব্লগারদের ব্লগে টিকে থাকতে হলে কোন একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মেলাতে হয়।
ব্লগ রাজনীতির কয়েকটি ধাপ লক্ষ করা যাক। প্রথমত আদর্শগত দ্বন্ধ, দ্বিতীয়ত গোষ্ঠীবদ্ধতার চর্চা, তৃতীয়ত জনপ্রিয়তা অর্জনের চোরাপথ হিসেবেও ব্লগ-রাজনীতির ব্যবহার এবং চতুর্থত ব্লগ দখলের রাজনীতি। সুমন রহমান তার ‘সামহোয়ারনামা’য় বর্গী নিক সমাজের কথা বলেছেন। তিনি লেখেছেন- “বর্গী নিকসমাজের কথা বলছিলাম, এরা এদের মতাদর্শ দিয়ে পরিচিত। এভাবে একদঙ্গল নিকের বিরূদ্ধে আরেক দঙ্গল নিক, ইডিওলজি ওয়ারফেয়ার। এরা হাঙরের মত দল বেঁধে চলে, ঝাঁকে ঝাঁকে মাইনাস দেয়, জুতা রেটিং করে, গালির তুবড়ি ছোটায়। এটা শত্রুশিবিরে। আর মিত্রশিবিরে এরা মিষ্টভাষী অনুমোদক, অনলবর্ষী সমর্থক, মিত্রশিবিরের আকাশে এরা পুষ্পকরথ সমেত টহল দিয়ে বেড়ায়। ক্ষণে ক্ষণে পুষ্পবৃষ্টি ঘটায়। পাড়ায় যে নতুন, তাকে এরা নানান প্রক্রিয়ায় যাচাই বাছাই করে। তাদের বাছাই পদ্ধতি দ্বিমাত্রিক: ফলে দুইমাত্রার বাইরের কেউ হলে তার ভয়াবহ বিপদ। হয় মাত্রা রিডিউস করতে হবে, না হয় দুই শিবিরেরই সন্দেহভাজন এবং অপ্রিয়ভাজন হয়ে থাকতে হবে। (সুমন রহমান, সামহোয়ারনামা, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, মার্চ ২০০৯)। ব্লগ রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ‘বর্গী নিক সমাজের’ বেশ ভূমিকা রয়েছে। নিক চর্চার নেতিবাচক দিকও এটি। নিক চর্চার মাধ্যমে নোংরাভাবে ব্লগীয় রাজনীতি হয়েছে। যার ফলে অনেক নিয়মিত ব্লগারকে ব্লগ ছেড়ে দিতে হয়েছে।
ব্লগাররা ব্লগ রাজনীতির পেছনে বিভিন্ন কারণ খুঁজে পেয়েছেন। কেউ দায়ী করছেন গ্রুপিংকে, কেউ দায়ী করছেন মতাদর্শিক দ্বন্ধকে, কেউবা আবার দায়ী করছেন দলীয় প্রোপাগান্ডাকে। ব্লগার জামাল ভাস্কর লেখেছেন, “বাংলা ব্লগিং'এর দুইটা অভিজ্ঞতা থেইকা দেখতেছি ব্লগিং'এর সাথে গ্রুপিং কাহিনীটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়াইয়া গেছে। যেই কারনে শোভন দূরত্ব তৈরীর প্রসঙ্গ তুইলা ফেলেন ব্লগারের সাথে অনেকেই, সেই ব্লগারের ব্লগিংয়ের সাথে নয়।” (জামাল ভাস্কর, সচলায়তন, জুলাই ২০০৭)। বাংলা ব্লগে গ্রুপিংয়ের প্রভাব বেশ প্রকট। কেউ কেউ একে সিন্ডিকেট ব্লগিং নামেও অভিহিত করে থাকেন। ব্লগার কালপুরুষ ব্লগ রাজনীতি সম্পর্কে লেখেছেন, “ব্লগে পছন্দের বা অপছন্দের ব্লগার নির্ধারিত যতটা না লেখার মধ্যে দিয়ে তার চেয়ে বরং ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং নিজস্ব পছন্দ বা অপছন্দের মাধ্যমে। তাই যে যার পছন্দের ব্লগারের সাথেই মত বা মন্তব্য বিনিময়ে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। আর যারা সুশীল ব্লগার তারা যে কোন ধরণের ব্লগারের কাছ থেকেই মন্তব্য পেয়ে থাকেন এবং একটা মধ্যবর্তী অবস্থানে থেকে যান। তারা কোন বিতর্কিত লেখাতে তেমন কোন মতামত দিতে চাননা বা দিতে অস্বস্তিবোধ করেন। তবে ব্লগীয় সম্পর্ক যদি কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ছাড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে যারা এই সম্পর্কের বাইরে থাকেন বা যারা সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারেন না তাদের অনেকের কাছেই ব্যাপারটা ঈর্ষা বা নিজের ব্যক্তিগত অপারগতা বা দুর্বলতার কারণ হিসেবে দেখেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোন ব্লগারের বিপুল জনপ্রিয়তা বা ব্লগীয় গন্ডির বাইরে ব্লগারদের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক বা সখ্যতা অনেকের কাছে ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই কারণেই একজন ব্লগার কারো অপছন্দের তালিকায় চলে আসতে পারেন।” (কালপুরুষ, প্রথম আলো ব্লগ, নভেম্বর ২০০৯)। ব্লগার কালপুরুষ ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতিকে ব্লগ রাজনীতির জন্য দায়ী করেছেন। অন্যদিকে ব্লগার পারভেজ ব্লগ রাজনীতি সম্পর্কে লেখেছেন, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে পারস্পরিক মতবিরোধ, দলাদলি, নৈতিক ভিন্নতার লিখিত বহিঃপ্রকাশ।”
তবে ফাহমিদুল হক ব্লগ রাজনীতির বিষয়টিকে ভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বাংলা ‘ব্লগরাজনীতি’র তিনটি দিক উল্লেখ করেছেন। এক. বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জামায়াতবিরোধিতা, দুই. গণতন্ত্রের জন্য তৎপরতা এবং তিন. ব্লগাভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই। (ফাহমিদুল হক, বাংলা ব্লগ কমিউনিটি : মতপ্রকাশ, ভার্চুয়াল প্রতিরোধ অথবা বিচ্ছিন্ন মানুষের কমিউনিটি গড়ার ক্ষুধা, যোগাযোগ, ডিসেম্বর ২০১০)। তবে ফাহমিদুল হকের উল্লেখ করা প্রথম দুইটি ‘ব্লগরাজনীতি’র দিক আদতে বাংলা ব্লগের সংস্কৃতি। এদুটিকে ব্লগ সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করাই অধিকতর য়ৌক্তিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জামায়াতবিরোধিতা ব্লগের গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। অন্যদিকে গণতন্ত্রের জন্য ব্লগাররা বিভিন্ন সময় তৎপরতা দেখিয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্লগাররা মত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং মানুষকে সচেতন করতে পেরেছে। ব্লগাররা ব্লগ রাজনীতি বলতে যা বুঝেন তা ফাহমিদুল হকের ব্লগ রাজনীতির তৃতীয় দিকটিতে রয়েছে। ব্লগ রাজনীতি হিসেবে ‘ব্লগাভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই’য়ের কথা বলতে গিয়ে ফাহমিদুল হক ‘ট্যাগিং’ এর কথা বলেছেন। তিনি লেখেছেন, “ট্যাগিং ব্লগে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। ভিন্নমতকে দমন করার জন্যও ঐ একই ট্যাগ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ব্লগের বাইরে সমমনা ব্লগাররা ফেসবুক, ইমেইল, মেসেঞ্জার, ফোনালাপ বা ব্লগীয় আড্ডার মাধ্যমে তাদের বন্ধন দৃঢ় করতে থাকেন, আর বিরুদ্ধমতের ব্লগারদের তারা ব্লগময়দানে এসে গালি ও ট্যাগিংয়ের মাধ্যমে দমন করতে থাকেন।”
ব্লগ রাজনীতি ছড়িয়ে পড়েছে এক ব্লগ থেকে অন্য ব্লগে। ফলে এক ব্লগের কোন ঘটনা নিয়ে পোস্ট দেওয়া হয় অন্য ব্লগে। ফেসবুকের মাধ্যমেও অভিযোগনামা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্লগ রাজনীতির উন্নত সংস্করণ হিসেবে বগোস্ফিয়ার দখলের রাজনীতিও শুরু হয়েছে। বগোস্ফিয়ার দখলের রাজনীতির ক্ষেত্রে সামহ্যোয়ারইন ব্লগ ও আমার ব্লগের দ্বন্ধ বেশ প্রকটভাবেই হাজির রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্লগ দিবসের কথা মনে করা যাক। সামহোয়ারইন ব্লগ ১৯ ডিসেম্বরকে বাংলা ব্লগ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমার ব্লগ ১ ফেব্রুয়ারিকে বাংলা ব্লগ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। আলাদা আলাদা দুইটি তারিখে বাংলা ব্লগ দিবস উদযাপন ব্লগ রাজনীতির প্রকাশ। সচলায়তনকে বগোস্ফিয়ার দখলের রাজনীতিতে দেখা যায়নি। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সচলায়তন ব্লগইস্যুতে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে। প্রথম আলো ব্লগকেও এখন পর্যন্ত বগোস্ফিয়ার দখলের রাজনীতিতে দেখা যায়নি।
ব্লগ রাজনীতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ব্লগটির নাম সামহ্যোয়ারইন ব্লগ। ব্লগ রাজনীতির জন্য নানাভাবে ব্লগার হারিয়েছে সামহ্যোয়ারইন ব্লগ। নতুন বেশ কিছু কমিউনিটি ব্লগের সৃষ্টি হয়েছে ‘সামুর ব্লগ পলিটিক্সে বিরক্ত হয়ে’। ব্লগ পলিটিক্স কেবল একটি ব্লগের জন্যই ক্ষতিকর নয়, বাংলা ব্লগ কমিউনিটির জন্যই ক্ষতিকর। তবে ব্লগ এবং ব্লগার যেহেতু আছে, ব্লগ রাজনীতির চর্চাও দেখতে হবে ব্লগারদের।
(ব্লগ রাজনীতি বেশ বিতর্কিত একটি বিষয়। তাড়াহুড়া করে পোস্টটি লেখা হয়েছে। পরবর্তীতে এডিট করা হবে। ব্লগ রাজনীতি নিয়ে আপনাদের মতামত জানতে পারলে ভালো লাগবে।)