মুক্ত সফটওয়্যার আন্দেলনের প্রবক্তা ও ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড স্টলম্যানের আলোচিত প্রবন্ধ 'হোয়াই স্কুল শুড এঙ্ক্লুসিভলি ইউজ ফ্রি সফটওয়্যার' বাংলায় রূপান্তর করেছেন ফেরদৌস আহমেদ তানিন
সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের নানা কারণে মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ সফটওয়্যারের ব্যবহার একজন ব্যবহারকারীকে তার কম্পিউটারকে নিজের ইচ্ছামতো ব্যবহার করার স্বাধীনতা প্রদান করে যা স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে কখনোই সম্ভব নয়। স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যারে কাজ করে তার মালিক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছামতো, ব্যবহারকারীর ইচ্ছামতো নয়। মুক্ত সফটওয়্যার একজন ব্যবহারকারীকে তার বন্ধু ও প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করতে শেখায়। একটি সুন্দর জীবন গড়ার জন্য এটা খুবই দরকার। স্কুলের বেলায় এটি আরও বেশি প্রযোজ্য যেমনটি তা সবার জন্য প্রযোজ্য। স্কুলে মানুষ পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। তবে স্কুলগুলোয় মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারের কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এই প্রবন্ধে সেগুলো আমরা তুলে ধরছি।
প্রথমতো, মুক্ত সফটওয়্যার একটি স্কুলের কম্পিউটার খাতের খরচ অনেক কমিয়ে আনতে পারে। এমনকি ধনী দেশের স্কুলগুলোতেও ফান্ড কম। ফলে এসব স্কুলে মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করা হলে স্কুলের খরচ অনেক কমে আসবে। মুক্ত সফটওয়্যার কপি এবং পুনরায় বিতরণ করা যায়। ফলে স্কুলের সিস্টেমের সব কম্পিউটারে সহজেই মুক্ত সফটওয়্যার ইনস্টল করতে পারে। গরিব দেশগুলোতে এর মাধ্যমে ডিজিটাল বৈষম্য কমানো যেতে পারে।
এই যুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও অর্থসাশ্রয়ই একমাত্র কারণ নয়। এটা অবশ্যই ঠিক যে, প্রোপাইটরি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান সহজেই এ সমস্যার সমধান করতে পারে স্কুলগুলোতে বিনামূল্যে সফটওয়্যার প্রদান করে। তবে মনে রাখতে হবে, এ রকম বিনামূল্যের সফটওয়্যার পরবর্তী সময়ে হালনাগাদ করতে গেলে টাকা খরচ করতে হবে। কাজেই আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবা দরকার।
স্কুলে শিক্ষার্থীদের এমন শিক্ষা দেওয়া দরকার যা সমাজের উপকারে আসে। যেভাবে তাদের রিসাইক্লিং শেখানো হয় সেভাবে তাদের মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য প্ররোচিত করা দরকার। স্কুলগুলো যদি শিক্ষার্থীদের মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করতে শেখায় তবে তারা পরবর্তী জীবনেও মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করবে। এটি সমাজকে বড় বড় বহুজাতিক করপোরেশনের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবে। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের সফটওয়্যার স্কুলগুলোতে যে কারণে দান করে সেই একই কারণে সিগারেট কোম্পানিগুলো বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের সিগারেট দান করে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে আসক্তি সৃষ্টি করা। একজন আসক্তি সৃষ্টি করে সফটওয়্যারের মাধ্যমে, অন্যজন করে সিগারেটের মাধ্যমে। তবে উদ্দেশ্য কিন্তু একই এবং পরবর্তীকালে তাদের কেউ-ই কিন্তু আর বিনামূল্যে এসব সামগ্রী প্রদান করে না।
মুক্ত সফটওয়্যার একজন শিক্ষার্থীকে একটি সফটওয়্যার কীভাবে কাজ করে তা জানার ও বোঝার সুযোগ দেয়। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা তাদের কম্পিউটার সিস্টেম এবং এর সফটওয়্যার সম্পর্কে সবকিছু জানতে উৎসুক থাকে। পরবর্তী সময়ে ভালো প্রোগ্রামার হতে হলে এই বয়স থেকেই তাদের শিক্ষা শুরু হওয়া দরকার। ভালো প্রোগ্রামার হতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে অনেক প্রোগ্রামিং সংকেত পড়তে হবে এবং অনেক প্রোগ্রামিং সংকেত লিখতে হবে। যেসব প্রোগ্রাম মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে তাদের অব্যশই সেসব প্রোগ্রামের প্রোগ্রামিং সংকেত পড়তে এবং বুঝতে হবে। তাহলে তারা শিখবে কীভাবে? তারা স্বভাবতই বিভিন্ন সফটওয়্যারের সোর্স কোড সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হবে যা তারা প্রতিদিন ব্যবহার করে। স্বত্বাধিকারী সফটওয়্যার তাদের এই জানার তৃষ্ণাকে নষ্ট করে দেয়। তারা বলে 'তুমি যে জ্ঞান পেতে চাও সেটি গোপনীয়_জ্ঞান অন্বেষণ নিষিদ্ধ।' মুক্ত সফটওয়্যার সবাইকে জ্ঞান আহরণের জন্য উৎসাহিত করে। মুক্ত সফটওয়্যার প্রযুক্তিকে পুরোহিতদের কবল থেকে মুক্ত করেছে, যেখানে সাধারণ মানুষকে প্রযুক্তির খুঁটিনাটি জানতে অনুৎসাহিত করে। আমরা যেকোনো বয়সের শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করি প্রোগ্রামিং সংকেত পড়তে এবং এর থেকে যা সে শিখতে চায় তা শিখতে। যেসব স্কুলে মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় তারা আপনাআপনি তাদের স্কুল থেকে অসাধারণ মানের প্রোগ্রামার পাবে।
পরের কারণটি আরও গভীরতর। আমরা আশা করি স্কুল একটা শিশুকে মৌলিক তথ্য ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা শিক্ষা দেবে কিন্তু এটাই তাদের একমাত্র কাজ নয়। স্কুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো তার শিক্ষার্থীদের সমাজের এবং আশপাশের মানুষের প্রতি দায়িত্বের ব্যাপারগুলো শেখানো। তাদের আশপাশে যাদের সাহায্যের প্রয়োজন তাদের সাহায্য করা। কম্পিউটারের বেলায় এটা বলা যায়, তারা যেন আশপাশের মানুষের সঙ্গে সফটওয়্যার বিনিময় করে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষা দেয়া দরকার_ 'তুমি স্কুলে যে সফটওয়্যার আনবে তা তুমি অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করবে'। স্কুল অবশ্য যা বলবে তা নিজেকে প্র্যাকটিস করতে হবে। অর্থাৎ স্কুলে যেসব সফটওয়্যার ব্যবহূত হবে, সেগুলো শিক্ষার্থীরা কপি করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করা এবং মুক্ত সফটওয়্যারে যোগ দিতে উৎসাহিত করা হলো প্রকারান্তরে তাদের একটি সুন্দর সমাজের জন্য তৈরি করা। এর মাধ্যমে তারা বড় বড় মুনাফাখোরের পরিবর্তে সমাজের অনুকরণীয় চরিত্রগুলো সম্পর্কে জানতে পারে। সব ধরনের স্কুলেই তাই মুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করা উচিত।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত।