মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিন্তু কবি জসিমউদ্দিনও একটা কবিতার বই লিখেছিলেন , খুব সম্ভবত "ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে" ছিল বইয়ের নামটা । শুনেছিস কখনো ? কেমন বাঙ্গালি হলি রে ! বাংলাদেশ শব্দটাই তো ঠিকমত মুখে আসে না তোদের । ঠিকই তো , তোরা কি আর বাঙ্গালি ? কিরে নাতনি , গীতাঞ্জলী পড়েছিস ? আহ , পড়বি কেন ! তোদের সাহিত্য তো বুলেট ফর মাই ভ্যালেন্টাইনের !
আলম সাহেব একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন । তার বিদেশ ফেরত নাতি-নাতনিরা এসবের মাথামুন্ডু কিচ্ছু চাওর করতে পেরেছে বলে মনে হয় না । তারা বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে । জসিমউদ্দিনটা আবার কে ? গীতাঞ্জলীও কারো নাম হতে পারে ? বিদ্রোহী নজরুলের নাম হয়তো তারা কদাচিত্ শুনেছে । রবীন্দ্রনাথ লোকটার যা বড় বড় দাড়ি !
দাদা , বাদ দাও তো । ওসবের টাইম নেই আমাদের । উই বর্ন টু বি মডার্ন ! এবার তোমাকে আর দাদুকে শিকাগো নিয়ে যাবই । বাবা আর ছোটচাচু বলে দিয়েছে , আর এক্সিউজ চলবে না । একা একা তোমরা থাকো কি করে ? কারেন্ট নেই , এসি নেই , জাস্ট হেইট ইট !
এদেশের ৯০ ভাগ প্রবাসীরা তাদের মা-বাবাদের বিদেশে নিয়ে যায় নিজেরা দ্রুততর সময়ে নাগরিকত্ব পাবার জন্য , তাদের একাকিত্ব ঘোচানো জন্য কিংবা দেশবিদেশ ভ্রমণের স্বপ্ন পূরণে নয় । আলম সাহেবের বড়ছেলে ডিভি পেয়ে আমেরিকা গিয়েছিল সেই ২০০৪ সালে । সেখানকার এক কলকাতা প্রবাসিনীকে বিয়ে করে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন তার সুখের সংসার । আমেরিকার সে একজন বৈধ সিটিজেন । আলম সাহেবের অন্যছেলেরাও আমেরিকা যেতে উদগ্রীব । তাদের বৃদ্ধ মা-বাবা আমেরিকার গ্রীনকার্ড পেয়ে গেলেই তাদের পথ সুগম । বড় ভাইয়ের পথ ধরে একে একে সবাই পাড়ি জমাবে স্বপ্নের দেশে । এই নোংরা বাংলাদেশ থেকে তাদের এখন রুঁচি উঠে গেছে । যে দেশের রাস্তায় রাস্তায় মাছির দল খেলা করে ফেরে , যে দেশের লক্ষজনতা দুবেলা অন্নের যোগানে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেয় সেদেশের আবার ভবিষ্যত কিসের ? আলম সাহেব একা একা এসব নিয়ে ভাবেন । কিন্তু টোকিও , নিউইর্য়েক যে ভয়ংকর জ্যাম পড়ে তা চারআনাও তো এই ঢাকায় পড়ে না । ইউরোপ-আমেরিকার সমস্যাও সুখ , আর এই বাংলার স্বাধিকারও ফেলনা । অনেকের মাঝে ব্যাতিক্রম হয়ে কি নিজের মত বাঁচা যায় ? বাঁচতে হয় খাঁচায় , বন্দি টিয়ার মত নিঃশব্দে , অচেনা কোলাহলে ।
আলম সাহেবের বিদেশী বাঙ্গালি ছেলে আর বউরা ব্রেকফাস্টে ব্রেড এন্ড বাটার খায় ।আলম সাহেব ওসব পছন্দ করেন না , রুটি-ভাজি না হয় চিড়া খেয়েই নাস্তা সারেন ।তার ছেলেরাও একসময় এসব খেত , অথচ এখন চিড়া দেখলেই নাক কুঁচকায় ।সবই অভ্যাসের ফসল , ওদেশের কালচারের সাথে চিড়া-মুড়ি খাপ খায় না ।ওটা বার্গার-বিয়ারের দেশ। আলম সাহেবের হঠাত্ হঠাত্ পান্তা খাওয়ার শখ হয়।কিন্তু ছেলেরা দেখলে আপত্তি করে।ছোটবেলার নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দিনগুলোতে একলোকমা ভাতের জন্য কত হাহাকার ছিল ।এক মালশা ভাতের ফেনার জন্য ভাই ভাইয়ের মাথা ফাটিয়েছে । অনাহারী সন্তানদের আহাজারি সইতে না পেরে কত মা গলায় দড়ি দিয়েছে । সেসব দিন বদলে গেছে । এখন ক্ষমতার জন্য জঘন্য রক্তারক্তি হয় , ক্ষমতা থাকলে জীবন এমনিতেই হাসবে ।
আলম সাহেবের তার নাতি-নাতনী জন্য কষ্ট হয় । ওরা গ্রাম দেখলো না , দেখলো না পুকুরে জেলের মাছধরা । আদুলপায়ে কুয়াসাসিক্ত ঘাস কিংবা গ্রাম্য মাটির নিবিড় স্পর্শ তারা পায়নি । পায়নি নদীর জলে দাপাদাপির আনন্দ ।
সেই অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসেছেন আলম সাহেব । বহুকষ্টে লেখাপড়া চালিয়েছেন । সরকারী কর্মকর্তার পদ থেকে অবসর নিয়েছেন ১২ বছর হলো । ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন । খুব দুঃখ লাগে যখন ভাবেন তার ছেলেরা তাদের বাবা-মাকে আমেরিকান গ্রীনকার্ডের চাবি ভাবে । মা-বাবার ইচ্ছে থাক কিংবা নাই থাক , আমেরিকা তাদের যেতেই হবে । সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এটা তো তাদের কর্তব্য ! একবার গ্রীনকার্ড পেলেই বাজিমাত , বাবা-মা এবার ওখানে থাক না হয় দেশে , দুশ্চিন্তা কিসের ? শুধু শুধু তাদের ওদেশে রাখতে উটকো খরচ । তারা দেশে থাকাই ভালো , দেশের সহায়-সম্পত্তি হেফাজতে থাকবে । যে দেশের লোকেরা বাঙ্গালি নিচু ভাবে অন্নের জন্য তাদের পায়ে পড়ার মানেটা কি ! বিধিবাম , তবুও নিচু হতে হয় । তাদের লক্ষকোটি ঋণের টাকায় চলে এদেশের সিংহভাগ উন্নয়ন প্রকল্প । তাদের খুশি-অখুশির নির্ভর করে সরকারের ভাগ্য ।
আলম সাহেবের নির্জন দুপুরগুলো কাটে এসব আকাশপাতাল ভাবনায় । সবই বোঝেন , তবু কোথায় যেন খটকা লাগে । লাল বেনারসিকে লাল বলতে বিবেকে বাধে । আবেগের দেয়াল সত্যকে ঠেকাতে চায় ।
গত কয়েকদিন ধরেই আলম সাহেবের নাতি-নাতনীরা দুপুরের পর লাউড স্পীকারে ইংরেজি গান বাজিয়ে রাখে । এসব তার সহ্য হয় না । তবুও তিনি আপত্তি করেন না । মাত্র কটা দিনের মেহমান ওরা , চলেই তো যাবে । কানে তুলো গুঁজে আলম সাহেব জানালার পাশে মোড়া পেতে বসে থাকেন । ইজি চেয়ারটা সবসময় তার ভালো লাগে না । কানে তুলো গোঁজা দাদাকে দেখে নাতি-নাতনীরা আনন্দ পায় । আচ্ছা কি লাভ ওদের বিদেশী গান শুনতে মানা করে ? আমেরিকা গিয়ে এভাবে বাংলা গান শুনলে আশপাশের লোকেরা বলবে কি ? এদেশ তো ওদের জন্মভূমি নয় , পিতৃভূমি । ওদের আসল জন্মভূমি প্রাচ্য , বরং এই বাংলাই ওদের জন্য বিদেশ । আলম সাহেবের নাতি-নাতনীদের জন্য ঐ প্রাচ্যে সংস্কৃতির চর্চাই অধিক শ্রেয় ।
আলম সাহেবের বড় ছেলে বাবাকে স্বপ্নপাশ্চাত্যের গল্প শোনায় । সেখানে নাকি শত শত সুউচ্চ দালান । সবগুলো ঘরই এয়ার-কন্ডিশনড । রাস্তাঘাট ঝকঝকে-তকতকে , চাইলে সেখানে পড়েই একদফা ঘুমিয়ে নেয়া যায় । তবে ওদেশের পুলিশগুলো বড্ড বেরসিক । আইনের অনুশাসন এদিক কি ওদিক হবে তো সোজা জেলে । ওখানের শীতে তুষারের আঁচড়ে পত্রপল্লবের মলিন রূপ দেখা যায় না । ঝরে পড়া পাতারা মুখ লুকোয় বরফের রাজ্যে । ওদের পাড়ার মোড়ে কি ভাঁপা পিঠা কিংবা চিতল পিঠা বিক্রি হয় ? বোধহয় ওদের রাস্তার পাশে নিঃস্ব জনতার আগুন পোহাবার দৃশ্যও চোখে পড়ে না । তবে যে যাই বলুক , ঐ প্রাচ্যের মোহে নেশা ধরবেই !!
প্রায়ই আলম সাহেবের দুশ্চিন্তা হয় , তিনি আমেরিকা পাড়ি জমালে তার এই বাড়িটা কে দেখবে ? তার ছোট্ট খরগোশ দুটি , মিষ্টি টিয়াপাখিটা আর হাঁসগুলোর কি হবে ? কোয়েলগুলো একটানা এতদিন খাঁচায় থাকতে পারবে তো ? ছোট ছেলেটা তো ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না ! খোদা না করুক যদি এমন হয় তিনি মৃত্যুর আগে বাংলাদেশে আর ফিরে আসতে পারলেন না ? কে জানে , হয়তো অহেতুক খরচের ভয়ে ছেলেরা লাশটা সেখানেই মাটি দেবে । দুটি বছর যে কোন খারাপ কিছু ঘটার জন্য অনেক সময় ।
অবশ্য আলম সাহেবের স্ত্রীর এসব নিয়ে মাথাব্যাথা নেই । বুড়োটা শুধু শুধু টেনশন করে । ছেলেরা তাদের মা-বাবাকে ভালোবাসে বলেই তো নিজেদের কাছে রাখতে চায় । এই নিয়ে আবার আপত্তি কিসের ? আমেরিকা দেশটা অনেক সুন্দর । জীবনের শেষ কয়েকটা দিন প্রাচ্যুর্যের মধ্যে কাটাতে এত দ্বিধা কিসের ? সন্তানদের খুশিতেই তো মায়ের খুশি ।
ম্যাগাজিন-পত্রিকায় প্রায়ই লেখালেখি হয় , আমেরিকা-ইউরোপের বহু শিক্ষিত-সচেতন লোক নাকি এখনো বর্ণবৈষম্যে বিশ্বাস করে । আলম সাহেব আয়নায় নিজের মুখটা বারবার করে দেখেন । গায়ের রঙের কৃষ্ণতার জন্য নিজেকে তার আগের চেয়ে বেশি হীন মনে হয় । কেন যেন বরফের দেশের মানুষরা একটু বেশিই ফর্সা হয় । তাদের তুলনায় এই বাঙ্গালী জাতটা নেহাত কালোই বটে ।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আলম সাহেব শুনলেন তার এবং তার স্ত্রীর ভিসা-পাসপোর্ট ইস্যু হয়ে গেছে । এখন শুধু বিমানের টিকেট কনফার্ম করা বাকি । পরিস্থিতি এমন যে , যারা যাবে তাদের চেয়ে অন্যেরা বেশি খুশি । বাকি পুত্রদের আমেরিকার পথ সুগম করার জন্য হয়তো প্রথমে মায়ের যাওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল । তবে আলম সাহেবের বড় ছেলে এতটা হৃদয়হীন হতে পারেনি । বাবার আপত্তি সত্ত্বেও এই ব্যাপারে তার জোর প্রচেষ্টা । আলম সাহেবের নাতি-নাতনীরাও তাদের দাদা-দাদিকে পেয়ে দারুন খুশি । দাদা-দাদি তাদের কত আদর করে , দাদি কত মজার পিঠা-পায়েস রেঁধে খাওয়ায় । কই তাদের মা'রা তো সচরাচর এসব বানিয়ে দেয় না ! সরিষার ভর্তা দিয়ে চিতল পিঠা আর খেজুরের গুড়ের ভাঁপা এবং গোটা পিঠা স্বাদে অমৃত । ঐসব বিয়ার-সোডার চেয়ে ডাবের পানিই বা কম কিসের ? ভাগ্যিস দেশে বেড়াতে এসেছিল , তা না হল এসব পেত কোথায় !
আমেরিকার প্রায় সব ঘরগুলোই ইনসুলেটেড । তীব্র শীতে ফায়ারপ্লেস আর হিটারই ঘর গরম রাখে । তীব্র গরমে ঘর ঠান্ডা রাখে এসি । বাংলাদেশের মত ঐ দেশে চাইলেই জানালায় শীতের মিষ্টি কুসুম রোদ আর কুয়াশার ছোঁয়া পাওয়া যায় না । সেখানকার শীত মানেই তিক্ত বরফের চাদর । আলম সাহেবের দুপুরগুলো কিভাবে কাটবে সে বন্দী দুনিয়ায় ? বড় ছেলের ১০ তলা ফ্ল্যাটের নীরব জানালার পাশে মোড়া পেতে বসে হয়তো মাটিও দেখা হবে না । বিলীন হবে শীতলপাটির নরম বিকেলঘুম । ডাবের পানির বদলে তৃষ্ণা মেটাবে দামী এলকোহল । ব্যস্ত প্রাচ্যের নিরেট থাইগ্লাসে মাথা ঠুকে ঠুকে কারো কারো মোটা ফ্রেমের চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আসবে । তবুও জীবন চলবে নিজের নিয়মে । একমুঠো স্বাধীনতার নিয়তির তরে সময় কাটবে সংজ্ঞাহীন ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:২৪