লেখাটা শুরু করার আগে কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই।
ঘটনা-১
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম তখন আমার এক ক্লাসমেটের বোনের বিয়ে হয়। বিয়ের ঘটনা বর্ননা দিতে গিয়ে এক সময় বলে ফেলে যে, “জানিস বাসর রাতে দুলাভাই আপাকে বলেছে যে মোহরানা মাফ না করে দিলে দুলাভাই নাকি আপাকে ছুবে না”। আমি বললাম, “কেনো? এইটা আবার কি কথা! তারপর তোর আপা কি করলো?” সে বলল, “কি আর করবে,মাফ করে দিল”।
ঘটনা-২
আমার এক কলিগের বিয়ে। বিয়ের সময় বৌ এর জন্য সৌদি আরব থেকে লেটেস্ট ডিজাইনের গহনা আনিয়েছে। গলার-কানের সেট। চুড়ি আনাতে চেয়েছিল কিন্তু সম্ভব হয়নি। বিয়ের সময় তার বড় ভাবীর দুটো চুড়ি আর নতুন কেনা গহনার সেট বৌকে দেয়। কাবিনে উল্লেখ করে যে, গহনা দিয়ে মোহরানা উসুল করা হলো। বিয়ের এক সপ্তাহ পরে বলল, “চুড়ি দুটো দিয়ে দাও।
চুড়ি দুটো ভাবীর। তোমাকে পরে সুযোগ মত বানিয়ে দিব”।নতুন
বৌ দিবে না। আর এদিকে ভাবীও তার চুড়ি না নিয়ে যাবে না। শেষে নতুন বৌ পরাজিত হলো।
ঘটনা-৩
আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু। দেশের বাইরে থাকতো। বিয়ে করতে দেশে এসেছে। বিয়ের পর দেশেই থাকবে। মেয়ে পছন্দ হয়েছে। তো কথাবার্তা সব ঠিকঠাক। কাবিন নিয়ে কথা বলার সময় বিয়ে প্রায় ভেঙ্গে যায় অবস্থা। কেনো? কারন ছেলের কথা হলো যে, সে তার সামর্থের বাইরে মেয়েকে মোহরানা দিতে পারবে না। মেয়েরা বলছে তিন লাখ টাকা দিতে হবে। ছেলে বলছে ৫০০ ডলারের বেশী দিতে পারবে না। যাই হোক, শেষে সেখানেই বিয়ে হলো। বিয়ের সাথে সাথেই মেয়ের হাতে ৫০০ ডলার দিয়ে দিল।
ঘটনা-৪
কিছুদিন আগে আমার পরিচিত এক মেয়ের বিয়ে হলো।ছেলে ভালোই চাকরি করে।তো সেই মেয়ের কাবিন হলো ১৪ লাখ টাকা। ভালো চাকরি করার পরও এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ছেলের নেই। কিন্তু মেয়েরা নাছোরবান্দা। কম টাকার মোহরানা হলে আত্মীয় স্বজনের কাছে নাকি তারা মুখ দেখাতে পারবে না। এক পর্যায়ে মেয়ে পক্ষের কথাই মানতে হলো। গহনা দিয়ে কিছু উসুল করলো এবং বাকিটা পরে দেওয়া হবে বললো।
ঘটনা-৫
আমার এক পরিচিত ব্যাক্তি বিয়ের সময় মোহরানা ধার্য করলো ৫ লাখ টাকা। উসুল দেখানো হলো গহনা দিয়ে ৩ লাখ টাকা। বলা হলো পরে দু’লাখ দেওয়া হবে। বিয়ের দশ বছর পর কোন এক কারনে জানা গেলো যে গহনা যা দেওয়া হয়েছিল তা তিন লাখ টাকার না। আরো কম। বাকী দ’লাখ টাকার কথা স্বামী ভুলে গিয়েছে।
ঘটনাগুলো পড়লেন তো? এখন মূল কথায় আসি। মোহরানা মেয়েদের অধিকার। এটা কোন হেলা ফেলার বিষয় না। স্বামীর কোন করুনা না। বিয়ের পর স্ত্রীকে বাধ্যতামুলক ভাবে তার প্রাপ্য মোহরানা দিতে হবে। নিয়ম হলো বিয়ের সাথে সাথেই মেয়ের হাতে তার মোহরানা দিয়ে দেওয়া। স্ত্রীর কাছে মাফ চাইলে যদি স্ত্রী মাফ করে দেন তাহলে সেটা মাফ হবে না।স্ত্রী যদি স্বামীর ব্যবহারে খুশী হয়ে বা ভালবেসে মাফ করে, তাহলে সেটা মাফ হবে। কেউ যদি অন্যের কাছ থেকে ধার করে এনে মোহরানা দেয় আবার বিয়ের পর সেই মোহরানা স্ত্রীর কাছ থেকে নিয়ে ধার শোধ করে (ঘটনা-২ এর মত), তাহলে সে ক্ষেত্রে বিয়ে কতটুকু হালাল হবে সন্দেহ আছে। অথচ এমন অহরহই ঘটছে। আবার ঘটনা ৫ এর মত ঘটনা দেখা যায়। এখানেও কি বিয়েটা হালাল হবে? অনেক পরিবারে বিশেষ করে উচ্চবিত্তের পরিবার গুলোতে দেখা যায় যে, মোহরানার টাকা যত বেশী হয় ততই তাদের সম্মান বেশী। কয়েকদিন আগে পেপারে পড়লাম চিটাগাং এ একজনের বিয়েতে মোহরানা দিয়েছে ৫০ লাখ টাকা।খুব ভালো হবে যদি তা পরিশোধ করা হয়।নিয়ম হচ্ছে ছেলের সামর্থ অনুযায়ী ছেলে মোহরানা পরিশোধ করবে। সামর্থের বাইরে মোহরানার জন্য জোর করলে সেটাতো জুলুম হবে। আর পরিশোধ করতে না পারলে সংসারে শুরু হবে অশান্তি। যেমনটা ঘটনা ২ এর বেলায় ঘটেছে।এই ঘটনার পাত্র-পাত্রীর বিচ্ছেদ হয় বিয়ের দুই বছরের মাথায় সেই চুড়ির জন্য। আমি আমার আশেপাশের বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি তাদের মোহরানা সম্পর্কে। বেশীরভাগ মহিলারাই এ ব্যাপারে একদম সচেতন না। অনেক শিক্ষিত মহিলারা জানেন না যে মোহরানা দেওয়া স্বামীর জন্য ফরয।আর অনেকে জানলেও সংসারে ঝামেলা এড়ানোর জন্য এ ব্যাপারে কোন কথা বলেন না। আমি কাজের বুয়া এবং তাদের আশেপাশের মানুষের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, সেটা হলো যে তারা শুধু জানে বিয়ের সময় একটা কাবিন ধরা হয় এবং সেটা বিয়ে করার সময় এমনি কাগজে লেখার জন্যই লেখা। তবে এমন পুরুষের সাথে কথা হয়েছে যে কিনা তার মোহরানা অর্ধেক পরিশোধ করেছে আর বাকিটা প্রতি মাসে মাসে দিচ্ছে। আল্লাহ কি বলেছেন মোহরানার ব্যাপারে? সুরা নিসার ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে-“নারীদের তাদের মোহরানার অংক একান্ত খুশি মনে তাদের দিয়ে দাও। অতঃপর তারা যদি নিজেদের মনের খুশিতে এর কিছু অংশ তোমাদের দেয়, তাহলে তোমরা তা খুশি মনে ভোগ করতে পারো”। লক্ষ্য করুন, আয়াতে বলা হয়েছে যে, খুশি মনে মোহরানা দিয়ে দিতে। তার মানে মন খারাপ বা নিমরাজী হয়ে দেওয়া ঠিক না।কিন্তু আজকাল ঘটনা ৪ এর মত এত ঘটনা ঘটছে যে কয়জন ছেলে যে খুশি মনে মোহরানা দেয়, তা আল্লাহই ভালো জানেন। অনেক মহিলার সাথে কথা বলার সময় একটা দীর্ঘনিশ্বাস এবং চাপা দুঃখের হাসি দেখেছি। এমন অবস্থাও হয়েছে যে তারা তাদের হাসি দিয়ে আমাকে বলছে, “এই বেকুব কি বলে? আমার সংসারে কি আগুন লাগাতে চায় নাকি”? না, আমি কারো সংসারে আগুন লাগাতে চাই না। শুধু বলতে চাই যার যেটা প্রাপ্য তার সেটা পাওয়াই উচিত এবং অবশ্যই সেটা সুন্দর সমঝোতার মাধ্যমে। এ ব্যাপারে নারী আন্দোলনকারীদের বলবো, “প্লিজ সম অধিকার নয়, কারন নারী-পুরুষ কখনোই সমান হতে পারবে না, আপনারা নারীর যে প্রাপ্য আছে সেটা আদায়ের জন্য আন্দোলন করুন, মানুষকে সচেতন করুন”।