লেখাটা আরো আগে লেখা উচিৎ ছিল, কিন্তু নানা ঝামেলা আর ব্যস্ততার কারণে দেরী হয়েই গেল। ইদানিং পত্র-পত্রিকা আর গণ-মাধ্যমে সরকারী হাসপাতালগুলোর নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর গাফিলতির কথা জানতে পারছিলাম কিন্তু আমাকে যে সেই অব্যবস্থাপনা আর গাফিলতির চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে তা ভাবতে পারিনি। গত ১৫ মার্চ রাতে খবর পেলাম আমার শ্বশুর ব্রেইন স্ট্রোক করে পাবনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ১৬ তারিখ ঢাকা থেকে স্বপরিবারে পাবনা রওনা হলাম। এখন দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি, যদি বৃহষ্পতি বা রবিবারে ছুটি মিলে যায় তবে ঈদের ভিড় হয় বাসে। ১৭ তারিখ ছুটি থাকায় সেই অবস্থায় পড়তে হলো। অগত্যা বাসের সর্বশেষ সীটে বারোভাজার ঝাকুনী হজম করতে করতে পাবনা পৌঁছালাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, সাধারণ ওয়ার্ডের জনাকীর্ণ হলরুমে ব্রেইন স্ট্রোকে অচেতন রোগীর জায়গা হয়েছে। চারিদিকে হৈ চৈ, চিৎকার, কোলাহল।
রোগীর অবস্থা ক্রমাবনতি হচ্ছিল। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছি, রোগী ঐ হাসপাতালেরই সদ্য বদলীকৃত ডাক্তার হাসান (নাম পরিবর্তীত) এর আত্মীয়। সেজন্য রোগী বিশেষ (??!!) সুবিধা পাচ্ছিলেন। চিকিৎসারত ডাক্তাররা ডাঃ হাসানের বন্ধু অথবা কলিগ, নার্সরা ডাঃ হাসান বলতে অজ্ঞান। একদিন পর ডাঃ হাসানও ঢাকা থেকে পাবনা গিয়ে পৌঁছালেন। ইতোমধ্যে কপালগুণে আমরা হাসপাতালের চারটা কেবিনের মধ্যে একটা ম্যানেজ করতে পারলাম। রোগী স্থানান্তরিত হলো কেবিনে।
১৮ মার্চ দিবাগত রাতে আমি রোগীর কাছেই ছিলাম। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রোগীর জ্বর পৌণে চার, সাপোজিটরে কাজ হয়নি। নার্সদের বলে এলাম, বলল অপেক্ষা করেন কমে যাবে। রাত ২টার দিকে আবার গেলাম, সব নার্স ঘুমে, একজন জেগে, বললাম “রোগীর পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, জ্বর কমেনি, একটু দেখবেন?” নার্স বললো, “কয়েক দিন হাঁটাচলা করেনি তো তাই পায়ে রক্ত চলাচল না হওয়াতে পা ঠান্ডা হয়ে গেছে, একটু সেক দেন আর ম্যাসাজ করে দেন, আমি ডাক্তারকে খবর পাঠাচ্ছি।”আমি বললাম, “আমি ইতোমধ্যে ম্যাসাজ করেছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না।” বলে চলে আসলাম।
রাত তিনটার দিকে রোগীর অবস্থার আরো অবনতি হওয়াতে আমার স্ত্রীকে থার্মোমিটার সহ নার্সদের কাছে পাঠালাম, তখন জ্বর চার। নার্স ওকে বলে পাঠালো, ডাক্তার আসছেন। রাত চারটায় রোগীর শ্বাসকষ্ট বোঝা যাচ্ছিল এবং অবস্থা সুবিধাজনক মনে না হওয়াতে আমি আমার স্ত্রীকে আবার পাঠালাম, ও দেখে এলো নার্সদের রুম ভিতর থেকে বন্ধ। আমি ডাঃ হাসানের মোবাইলে রিং দিলাম, মোবাইল বন্ধ (ডাক্তাররা বোধ হয় ঝামেলা এড়ানোর জন্য মোবাইল বন্ধ করে ঘুমায়)। নিজেকে কি যে অসহায় লাগছিল বলে বোঝাতে পারবো না, চোখের সামনে আমার শ্বশুর একটু একটু করে মৃত্যুর দোড়গোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, অথচ আমরা শেষ চেষ্টাটুকুও করতে পারছি না।
এবারে আমার স্ত্রীর ভাবী গিয়ে নার্সদের রুমের দরজায় প্রচন্ড লাথি কষলেন, কাজ হলো। দৌড়াদৌড়ি, অবশেষে কর্তব্যরত চিকিৎসক এলেন কিন্ত ততক্ষণে রোগী মারা গিয়েছেন (ইন্নালিল্লাহি……..)। স্কুলে ইংরেজী গ্রামার শিখতে গিয়ে পাস্ট পারফেক্ট টেন্স এর উদাহরণে ছিল – ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল। সেটা আমাকে বাস্তবে অবলোকন করতে হলো। ডাক্তার বিপি, পালস চেক করছিলেন, আমার স্ত্রী হাসপাতালের গাফিলতিতে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। ডাক্তার বললেন, “আপনারা ডাঃ হাসানের আত্মীয়, আপনাদের এরকম উত্তেজিত হওয়া মানায় না।”সত্যিই তো,আমরা ডাক্তারের আত্মীয় হয়েই সে সেবা পেলাম, আত্মীয় না হলে যে কি হতো………………ভাবতেই আমার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষঃ মৃতদেহ নিয়ে বের হবার সময় আবিষ্কার করলাম, কে যেন আমার জুতোজোড়া রুমের মধ্যে থেকে হাপিস করে দিয়েছে। সত্যি, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে বিবেক দিয়েছেন, আর তাতেই আমরা হয়েছি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, জানোয়ারের চেয়ে উত্তম। কিন্তু সদ্য পরলোকগত রোগীর রুমে থাকা জুতো চুরি করা বিবেকসমৃদ্ধ জীবকে কী মানুষ বলা যাবে????????
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১১ সকাল ১০:৩৪