কই যাও মাঝির ব্যাটা?
হন হন করে হেটে যাওয়া মাঝির ব্যাটার দিকে তাকায়া হাক ছাড়ে হালিমবয়াতি
নিজের গোস্বা মাটির উপর ঝাড়ো ক্যান মিয়া ?
থমকে দাড়ায় মাঝি, উবু হয়ে বয়াতির পাশে গিয়ে বসে, তুমি না চউক্ষে দেখোনা বয়াতি, কেমনে বুঝো আমি যাই?
এক সময়ের ভয়ংকর ডাকাত সরদার হালিম মুখটা তুলে স্মিত হাসি দেয়, বল্লমের খোচায় নষ্ট হওয়া চোখ গুলো থেকে সবসময় ঝড়তে থাকা পানি ফতুয়ার ঝুলন্ত আস্তিন দিয়ে মুছতে মুছতে ,বয়াতির হাসি আরো রহস্যময় হয়। চউক্ষের পর্দা বন্ধ হইলেও দেহের সব জানলা আমার খোলা রে মাঝি !!
এত রাগ কার উপর তোর?
জানিনা বয়াতি ...., নিম গাছে হেলান দিয়ে মাঝি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে।পুবের বন্ধের হু..হু হাওয়া আমের মুকুলের সুবাস নিয়ে মাঝিরে ঘিরে ধরে।
টুং..টুং করে দোতারায় সূর তোলা হালিম বয়াতির হাতের দিকে তাকায় মাঝি। একসময়ের দায়ের কোপে প্রায় আলগা হয়ে যাওয়া কবজি দিয়ে কি মমতায় বয়াতি এখন তারে হাত বুলায়।
একটা গান ধরো বয়াতি !
হুম..কোন এক গভীর ঘোর থেকে যেন বয়াতি সাড়া দেয়। দোতারায় আংগুলের চাপ বাড়ে। বাতাসে দুলতে থাকা আংড়া তুলে বয়াতি দোতারায় সুর তোলে..
আমার হয় না রে সে মনের মত মন ।।
কিসে জানবো সেই রাগের কারণ
আমি জানবো কি সে রাগের কারণ
আমার হয় না রে সে মনের মত মন ।।
পড়ে রিপু ইন্দ্রিয় ভোলে
মন বেড়ায় রে ডালে আলে ।।
দুই মনে এক মন হইলে ।।
এড়াই শমন ।।
হয় না রে সে মনের মত মন ।
আমার হয় না রে সে মনের মত মন ।
রসিক ভক্ত যারা মনে মন মিশালো তারা ।।
শাসন করে তিনটি ধারা ।।
পেল রতন
তারা পেল রতন
হয় না রে সে মনের মত মন ।
আমার হয় না রে সে মনের মত মন ।
কবে হবে নাগিনী বস সাধবো কবে অমৃত-রস ।।
দরবেশ সিরাজ সাঁই কয়, বিষে বিনাশ ।।
হলি লালন ।।
হয় না রে সে মনের মত মন ।
আমার হয় না রে সে মনের মত মন ।
কিসে জানবো সেই রাগের কারণ
ও কিসে জানবো সেই রাগের কারণ
হয় না রে সে মনের মত মন ।
আমার হয় না রে সে মনের মত মন ...............................।
কি দরদ যে তুমি দাও বয়াতি, ক্যামনে গাও ??
তুমি যেমনে নাউ বাউ ,
আমার নাউ বাওয়া আর তোমার দোতারা বাজানি কি এক হইলো বয়াতি ?
এক রে এক....
মন থ্যাইকা করলে সবই এক।
বাড়ি যাও মাঝি ।
আরেকটু থাহি হালিম ভাই।
তাড়া না থাকলে থাহো, তয় একটা বিড়ি ধোরাও মাঝির পো ।
হাওয়া বাচিয়ে মাঝি বিড়ি ধরায়, বিড়ির আগুন থেকে আরেক টা বিড়ি ধরিয়ে বায়াতির হাতে গুজে দেয়।
লম্বা সুখ টান দিয়ে বয়াতি দম ছাড়ে, বলকে বলকে ধোয়া উড়ে হাওয়ায়।
বুঝলা মাঝি মন হইলো পাগলা ঘোড়া , অনেকই সওয়ারি হইবো মন ঘোড়ায় । চড়বো ঘুরবো তারপর নাইমা যাইবো। সওয়ারিও তোমারে ভুইলা যাইবো, ঘোড়াও সওয়ারি রে ভুইলা যাইবো।
কিন্তু সাবধান মাঝি !!
লাগাম দিওনা কারো হাতে ...! লাগাম পাওয়া সওয়ারি বড় ভয়ংকর হইতে পারে । ছর্রা মাইরা ঘোড়ার গায়ে দাগন দিবো, সেই দাগ তুমি কোনদিন ভুলতে পারবানা রে মাঝির ব্যাটা..কোনদিন না...., একদিন দেখবা লাগাম ছুইড়া তোমারে ছাইড়া দিছে অচেনা কোন রাস্তায়।
পথ হারা পথিক হইয়া গোস্বা লইয়া হাটবা তখন।
মনের ঘোরে মাঝির তখন উথাল পাথাল ঝড়। তোর দুরে সরে যাওয়া, ভ্রুকুটি, আর চুপ থাকায় মাঝির কষ্ট বাড়ে আর তুই থাকিস নির্বিকার। বড্ড নির্মম তুই...
তোর সব দিয়ে সব কেড়ে নেয়ায় দরকার তো ছিলোনা। নিজের মনে শুধায় মাঝি। তোর চোখের গভীরতার আজ আর প্রান্তিক বিলের টলটলে পানি না, তোর স্বপ্নে আর আজ আর খেলা করেনা প্রান্তিক বিলের শাপলা শালুক,পুবের বন্ধের রাতের কথা তুই ভুলে গেছিস বেমালুম। আগুন লাগা দ্বীপ আর চাদনী নির্ঘুম পসর রাতের কথা তুই ভুলে গেছিস সেই কবে...
মাঝি আমরা জন্মেছি আত্নার আত্না হয়ে,তোরেই মুখে প্রথম শুনেছিলাম।
তুই ই বলেছিলি, আমার কলিজা তুই...।
হালিম বয়াতির কথায় মাঝির ঘোর ভাংগে। মাঝির ব্যাটা চুপ ক্যান ?
না বয়াতি চুপ না, তোমার কওয়া কথাই ভাবতেছিলাম। ভুল সওয়ারীর হাতে লাগাম দিছিলাম বয়াতি, ভুল সওয়ারির হাতে !!!
আহ ! এই জন্যই লালন বলে পড়শী চেনো, বুঝলা মাঝির ব্যাটা পড়শি চেনো ।বয়াতির দোতারা আবার বেজে উঠে...মাথা ঝুকিয়ে বয়াতি গেয়ে উঠে..
বাড়ির কাছে আরশীনগর
সেথায় এক পড়শী বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে ।।
… গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে,
বাঞ্ছা করি দেখব তারে
কেমনে সে গাঁয় যাই রে ।।
কি বলব সে পড়শীর কথা,
হস্তপদ স্কন্ধ-মাথা নাইরে
ক্ষণেক ভাসে শূন্যের উপর
ক্ষণেক ভাসে নীড়ে ।।
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো,
যম যাতনা সকল যেতো দূরে
সে আর লালন একখানে রয়
লক্ষ যোজন ফাঁক রে
মাঝে লক্ষ যোজন ফাঁক রে ।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে.... ক্ষীণ স্বরে মাঝিও গেয়ে উঠে।
হঠাৎ করে মাঝি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়ায়। বয়াতি আমি যাই। বয়াতি মাথা দোলায়া বিদায় জানায়।
হন হন করে মাঝি হাটতে থাকে বিলের দিকে ..
মাঝি মনস্থির করে ফেলছে সে চলে যাবে ,দুরে চলে যাবে। এই গ্রাম, প্রান্তিক বিল, পূর্বের বনধ, সব ফেলে মাঝি চলে যাবে।
বিলের ঐ পাড়ে গন্জ। সেখান থেকে শহরের বাস ছেড়ে যায় দুই বেলা। সকাল আর বিকাল।
মাঝি হাটার গতি বাড়ায়। বিলের পাড়ে এসে তার বাধা নাউ এর খুটি তোলে। লম্বা দাগ কেটে তীর থেকে নাউ ভাসায় মাঝি। শান্ত বিলের পানিকে আজ ঝাপসা দেখে মাঝি। শাপলা শালুক আজ বহু দুরের দৃষ্টিতে বধা। বিলের মাছ ব্যং গুলোও বুঝি আজ মাঝিকে নতুন ভাবে দেখছে। একলা .একা..ক্ষুদ্ধ..নি:স্ব......
ছায়ার পানিতে বৈঠা মেরে মাঝি পৌছে যায় বিলের ঐ পাড়ে। বৈঠা ছেড়ে দেয় বিলের পানিতে...
খাড়া ভাবে ডুবে গিয়ে ফুস করে ভেসে উঠে আবার বৈঠা, বুঝি বা মাঝিরে কিছু বলতে চায়। যাইওনা মাঝি, কত লম্বা সময় তুমি আমি ছিলাম একসাথে, কত ঝড়ই না তুমি আমি মোকাবিলা করছি।
ভ্রু ক্ষেপ নাই মাঝির..
মাঝি জানে তার এই চলে যাওয়া দাগ কাটবেনা কোথাও, ভাবান্তর হবেনা কারো এক অপরাহ্ন বা সাঝ বেলা..
তীর বেয়ে উঠতে গিয়ে আবার থমকে দাড়ায়...নোকৌয় ফিরে আসে, গলুয়ের পাশে দাড়িয়ে থাকে কিছুক্ষন।
কি ভাবো মাঝি ? ডোরা কাটা শাড়ি পড়া কারো কথা ? গলুয়ে আধ শোয়া হয়ে থাকা সেই মায়াবী মুখের কথা ? উচ্চ হাসির ভেংগে পড়া হাজারো কিন্নরী সেই মেয়ের কথা ?
শক্ত হাতে গলুই চেপে ধরে মাঝি , দেহের সব শক্তি এক করে এক জান্তব কষ্ট চেপে রাখতে গিয়ে অনুচ্চারিত এক শব্দ দিয়ে নৌকা ঠেলে দেয় মাঝি বিলের পানিতে...
তারপর আর একবার ও পিছনে না ফিরে মাঝি হাটা দেয় গন্জের বাজারে।
বাস ছাড়তে বোধহয় আর বেশি দেরী নাই।