প্রায় ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় সাংগঠনিক কাঠামো নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বিএনপির। সৃষ্টি হয়েছে বিশৃঙ্খল এক অবস্থা। দলটির নেতাদের পরস্পরের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাস দিন দিন বাড়ছে। সুসম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘কান ভারী’ করে সুবিধা নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে দলটির নেতাদের মধ্যে। আর ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা হয়ে ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। কে বা কারা সরকারের এজেন্ট; অথবা অমুক এজেন্সির সঙ্গে কার ঘনিষ্ঠতা বেশি—এমন আলোচনাই বিএনপিতে এখন বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। যাঁরা এসংক্রান্ত ‘খবর’ চেয়ারপারসনের কানে বেশি করে তুলতে পারছেন আপাতত তাঁরাই দলে প্রভাব বিস্তারে এগিয়ে আছেন বলে জানা গেছে। কারণ দুটি দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার আশঙ্কা থাকায় একেক সময় একেক অংশের নেতাদের কথায় বিভ্রান্তিতে পড়ছেন খালেদা জিয়া। কোনো ইস্যুতে তিনি এক নেতাকে কাছে টানছেন; আবার অন্য ইস্যু বা কারোর কথায় দূরেও ঠেলে দিচ্ছেন।
সূত্র মতে, প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে দলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা নেতাদের তালিকায় দলের একজন যুগ্ম মহাসচিব আপাতত সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। এ ছাড়া দু-একজন ভাইস চেয়ারম্যানের নাম খুবই আলোচিত। আর তাঁরাই দলের গুলশান থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় এমনকি মহানগরী কার্যালয় পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সব ধরনের কমিটি গঠনে ভূমিকাও তাঁদের বেশি।
কিছুদিন আগে এ তালিকায় স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী আরো দুজন নেতার নাম যুক্ত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে মহিলা দল ও যুবদলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে নানামুখী মেরুকরণে তাঁদের ক্ষমতা কিছুটা খর্ব হয়। এখন আর তাঁদের তত্পরতা খুব একটা দৃশ্যমান নয়।
চেয়ারপারসনের ‘কান ভারী’ করার রাজনীতির প্রতিক্রিয়ায় যেসব নেতা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, নাজিমউদ্দিন আলম, মহিলা দলের নেত্রী শিরিন সুলতানাসহ আরো অনেকের নাম শোনা যায়।
তাঁদের বাইরে স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেকের নাম জড়িয়ে কয়েক বছর ধরে খালেদা জিয়ার কাছে নেতিবাচক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রভাবশালী ওই নেতারা দলের দুঃসময় এলে কোন দিকে যান তার ঠিক নেই। একইভাবে তাঁদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও চেয়ারপারসনের কাছে নালিশ জমা পড়েছে। বেশ কিছু গণমাধ্যমেও এসংক্রান্ত চটকদার খবর প্রচার করা হয়েছে, যার সঙ্গে বিএনপি নেতারাই জড়িত বলে দলটির মধ্যে আলোচনা আছে।
অনেকের মতে, এসব কারণেই প্রায় চার বছরের বেশি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব থাকতে হয়েছে মির্জা ফখরুলকে। একইভাবে বেশ কিছুদিন গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছিলো ড. মোশাররফ ও মওদুদ আহমদকে। কিন্তু যাঁরা এই সন্দেহ খালেদা জিয়ার মধ্যে ঢুকিয়েছেন তাঁরা প্রজ্ঞা বা যোগ্যতা দিয়ে বিএনপিকে সামনে নিয়ে যাওয়ার মতো কর্মকৌশল দিতে পারেননি। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে পিছিয়ে পড়ায় বিএনপিতে দিন দিন বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত আবার ওই সিনিয়র নেতাদের ডেকে সলাপরামর্শ নিচ্ছেন।
সূত্র মতে, দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে সাম্প্রতিককালে বিএনপির মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে চেয়ারপারসনের কাছে ‘অভিযোগ’ তোলা বা সন্দেহ সৃষ্টির প্রবণতা আবারও শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, চেয়ারপারসনের সাজা হলে অমুক অমুক নেতা দলের বিরুদ্ধে যেতে পারেন। এমনকি দল ভেঙে যেতে পারে বলেও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি বিএনপি ও এর বাইরে এমন আলোচনাও আছে যে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নাও হতে পারেন। সূত্র মতে, দলের ভেতর-বাইরের এমন প্রচারণায় সিনিয়র নেতাদের নামই জড়ানো হচ্ছে বেশি। ফলে অস্বস্তিকর অবস্থা এড়াতে ওই নেতারা দুজন কোথাও একসঙ্গে এখন বসছেন না; খালেদা জিয়া না ডাকলে পারতপক্ষে তাঁরা গুলশান কার্যালয়েও যাচ্ছেন না।
অনেকের মতে, ঢাকা মহানগরীর আহ্বায়কের পদ থেকে সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে দেওয়ার মূল কারণ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার। খোকার সঙ্গে সরকারের আঁতাত রয়েছে বলে প্রচার চালিয়েছেন তাঁর বিরোধী মির্জা আব্বাস সমর্থকরা। অথচ একটি মামলায় কিছুদিন আগে খোকার সাজা হয়েছে। এমনকি তাঁর গুলশানের বাড়িসহ সম্পত্তির বড় একটি অংশ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ফলে এখন ওই একই প্রচারণা খোকা সমর্থকদের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে আব্বাসের বিরুদ্ধেও। কারণ খোকার মতোই আন্দোলনে আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বাধীন মহানগরী বিএনপির কমিটি। ফলে এখন আবার ওই কমিটি বদলে ফেলে শিগগির নতুন কমিটি ঘোষণা করতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে।
অন্যদিকে কূটনৈতিকপাড়ায় তত্পর বিএনপি নেতারাও পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘কুৎসা’ রটিয়ে চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ হতে চাইছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। কে কোন দেশের ‘চর’ বা এজেন্ট সে সংক্রান্ত তথ্য জানানো হচ্ছে খালেদা জিয়াকে। আর চেয়ারপারসনও একেক সময় একেক নেতার কথায় আশ্বস্ত হয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাকে কূটনৈতিক তত্পরতা চালানোর দায়িত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত এসব তত্পরতায় কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলেই মূল্যায়ন বিএনপি নেতাদের।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, বিএনপির ভেতরে সন্দেহ-অবিশ্বাসের মূল কারণ দলটি আন্দোলনে নেই। আন্দোলনে থাকলে দেখা যেত কে নেমেছে আর কে নামেনি। তা ছাড়া ওই পরিস্থিতিতে কে কার এজেন্ট তা বলা বা প্রচার করার সুযোগও হতো না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন দীর্ঘদিন ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকার কারণেও তাঁর মধ্যে ভয়, সংকোচ বা সংশয় কাজ করতে পারে। আর সম্ভবত এর সুযোগই নিচ্ছেন বিএনপির কিছুসংখ্যক নেতা। দলের মধ্যে এমন অবস্থার কারণ জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, আসলে এক-এগারোপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কারণে সন্দেহ-অবিশ্বাসের প্রসঙ্গ বারবার আসে। তা ছাড়া এটা তো ইতিহাস, গল্প নয়। তাঁর মতে, ওই সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কিছু নেতা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অবিশ্বস্ত হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। আর এখন চলছে নতুন এক ক্রান্তিকাল। ফলে ষড়যন্ত্র, বিভাজন বা আশঙ্কার কথা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। তবে এটি দলের জন্য ভালো হচ্ছে না, যোগ করেন স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এই নেতা।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু নেতা পরস্পরের বিরুদ্ধে হিংসা বিদ্বেষ ছড়াতে পারেন। কিন্তু তাঁরা বিএনপির ভালো চান বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, এখনকার যে ক্রান্তিকাল তাতে বিএনপির ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত। কিন্তু পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা বা অপপ্রচার যাঁরা চালান বুঝতে হবে তাঁদের অন্য কোনো এজেন্ডা আছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন তত্কালীন বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। কার্যত এর সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে বিএনপি ভেঙে যায়। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও তত্কালীন সিনিয়র নেতা প্রয়াত এম সাইফুর রহমানসহ দলের শতাধিক এমপি সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে ওই সময় থেকে বিএনপি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। গত সাত-আট বছরে সংস্কারপন্থীদের বড় একটি অংশ দলে ফিরলেও অর্ধশতাধিক এমপিসহ অনেকেই আজ পর্যন্ত ফিরতে পারেননি। খালেদা জিয়ার হাত থেকে নেতৃত্ব চলে যেতে পারে এমন সংশয় ও সন্দেহ থেকে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও অলি আহমদকে বিএনপিতে ফিরিয়ে আনা হয়নি।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৬:২৫