জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান -দ্বিতীয় অংশ
এই সিরিজের ক্রমহ্রাসমান পাঠক সংখ্যা এটিই প্রমান করছে যে, এ বিষয়ের উপরে তাঁদের আগ্রহ ধরে রাখার ব্যাপারে লেখক ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। অবশ্য, প্রায় অপরিচিত বিভিন্ন বিজ্ঞানীর আবিষ্কারের ফিরিস্তি ভাল না লাগাটাকে অস্বাভাবিক বলা যায় না কোনভাবেই। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, বিগত এক সহস্রাব্দ কিংবা তারও বেশী সময় ধরে বিজ্ঞানের এইসব মহান সাধকদের পরিচয় এবং অবদানকে যেভাবে ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক সাধারন মানুষের জানাশোনার আড়ালে রাখা হয়েছে, তাতে এখন সুযোগ পেয়ে, তাঁদের অবদানগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরার লোভ সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই সিরিজের প্রথম দিকে কেউ কেউ বিজ্ঞানের রাজ্যে মুসলমানদের অবদান খোঁজাকে হারিকেন হাতে নিয়ে কিংবা ছাই দিয়ে মাছ ধরার সাথেও তুলনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই, এটি এক ধরনের দায়মুক্তিও বটে। কথা দিচ্ছি, আর এক কিংবা দুই পর্ব পরেই এই সকল তথ্যগত(Informative) আলোচনা ছেড়ে আমরা তত্ত্বগত(Theoritical) আলোচনার দিকে পা বাড়াবো।
যাই হোক। জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের ঐতিহাসিকগ অবদানের একাংশ বর্ণনা করা হয়েছে বিগত পর্বে। এ পর্বে থাকছে বাকী অংশ।
সন্দেহ নেই, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় খৃষ্টীয় একাদশ শতকের পর থেকেই মুসলমানদের মৌলিক অবদান এবং আনাগোনা কমে যেতে থাকে। কিন্তু, জ্যোতির্বিজ্ঞান এর একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আগের তিন শতকের মতই দ্বাদশ শতক হতে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত এক্ষেত্রে একের পর এক আগমন ঘটতে থাকে মৌলিক এবং প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের যাঁদের মধ্যে রয়েছেন আবু ইস্হাক ইব্রাহিম আল-জারক্বালী(أبو إسحاق إبراهيم بن يحيى بن النقاش; ১০২৯-১০৮৭), ওমর খৈয়াম(عمر خیام; ১০৪৮-১১৩১), আবুবকর মুহাম্মাদ ইবন্ বাজ্জাহ্(أبو بكر محمد بن يحيى بن الصائغ ابن باجة; ?-১১৩৮), আবুবকর মুহাম্মাদ ইবন্ আবদুল মালিক ইবন তুফায়েল(أبو بكر محمد بن عبد الملك بن محمد بن طفيل القيسي الأندلسي; ১১০৫-১১৮৫), নুর আদ-দীন আল-বেত্রুগী(نور الدين زنكي; ?-১২০৪), শরফ্ আল-দীন আল-তুসী(شرفالدین طوسی; ১১৩৫-১২১৩), ইবন্ আল-রাজাজ্ আল-জাযারী(أَبُو اَلْعِزِ بْنُ إسْماعِيلِ بْنُ الرِّزاز الجزري; ১১৩৬-১২০৬), ফখরুদ্দীন আল-রাজী(أبو عبدالله محمد بن عمر بن الحسین فخرالدین الرازي ;১১৪৯-১২০৯), নাসিরউদ্দীন আল-তুসী(نصیر الدین طوسی; ১২০১-১২৭৪), ইব্রাহিম আল-শাতীর(ابن الشاطر; ১৩০৪-১৩৭৫) এবং উলুঘ বেগ(میرزا محمد طارق بن شاهرخ; ১৩৯৩-১৪৪৯) এর মত বড় মহারথীরা।
ইবন আল-শাতীরের নির্মিত সূর্যঘড়ি, দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে আজো বিদ্যমান
ইব্রাহিম আল-জারক্বালী তাঁর জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ছকের(Astronomical Table) জন্য পাশ্চাত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর Book of Tables ত্রয়োদশ শতকে রাজা আল্ফোন্সোর(King Alfonso X) নির্দেশে অনূদিত হয় এবং এর মাধ্যমে পাশ্চাত্যে গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার পূনর্জন্ম হয়। তিনি অ্যাস্ট্রোল্যাব যন্ত্রের উন্নতিসাধন করেন এবং বুধ(Murcury) গ্রহ সংক্রান্ত টলেমীর মতবাদে সংশোধনী আনেন।
দার্শনিক, সংগিতজ্ঞ এবং কবি হিসেবে সুপরিচিত ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিজ্ঞানেও প্রাতঃস্মরণীয়। তৎকালীন সেলজুক সুলতান মালিক শাহ ১০৭৩ সালে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে তাঁকেও আমন্ত্রণ জানান একটি মানমিন্দর(Observatory) নির্মাণের জন্য। তিনি তখন অত্যন্ত সফলভাবে (দশমিকের পর ছয় ঘর পর্যন্ত) সৌর বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন। তাঁর হিসাবে এটি ছিল ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন। এই ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রতি ৫,৫০০ বছরে এক ঘন্টার গড়মিল হয়ে থাকে। অন্যদিকে, আমরা বর্তমানে যে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করি তাতে প্রতি ৩,৩০০বছরে একদিন গোলমাল হয়ে থাকে। কীভাবে পারস্য পঞ্জিকা সংশোধন করতে হবে তাও তিনি হিসাব করেন। ১০৭৯ সালের ১৫ মার্চ সুলতান মালিক শাহ ওমরের সংশোধিত ক্যালেন্ডার চালু করেন। ওমর একটি তারাচিত্রও (Star Map) তৈরি করেন তবে সেটি এখন আর পাওয়া যায় না।
ইবন্ বাজ্জাহ্ আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গা(Milky Way) যে অসংখ্য তারকার সমষ্টি, সে কথা প্রথম বলেন এবং এক্ষেত্রে তিনি অ্যারিস্টটলের মতবাদকে সংশোধন করেন। সূর্যের বুকে দৃষ্ট কালো বিন্দুর(Black Spot) কারন যে, বুধ এবং শুক্র গ্রহ(Transit of Murcury and Venus) তা এই আন্দালুসিয়ানই প্রথম বলেন, যদিও এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব ষোড়শ শতকের দুই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানী জেরেমিয়া হোরোক্স (Jeremiah Horrocks; ১৬১৮-১৬৪১) এবং জোহান্স কেপ্লারকে (Johannes Kepler; ১৫৭১-১৬৩০) দেয়া হয়ে থাকে।
ইবন্ তুফায়েল ছিলেন পূর্বোক্ত ইবন্ বাজ্জাহের ছাত্র এবং আল-বেত্রুগীর শিক্ষক। আল-বিত্রুগী ‘কিতাবুল হাইয়া’(كتاب الحياة) এর লেখক যাতে তিনি গ্রহসমূহের আবর্তন নিয়ে পুরানো মতবাদসমূহকে বর্জন করে নতুন একটি মতবাদ দাঁড় করান। ত্রয়োদশ শতকে এটি মাইকেল স্কট(Micheal Scot; ১১৭৫-১২৩২) কর্তৃক De motibus celorum নামে ল্যাটিনে অনূদিত হয়।
ফখরুদ্দীন আল-রাজীকে অনেকেই সুবিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী জাকারিয়া আল-রাজীর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘মাতালিব আল-আলিয়া’ গ্রন্থের প্রনেতা যাতে তিনি কুরআনের আয়াতের সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেন। অ্যারিস্টটল এবং ইবন্ সীনার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি একাধিক মহাবিশ্বের(Multiple Universes) অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনাকে স্বীকার করে নেন।
তুসী-কাপল, তুসীর নিজের গ্রন্থ হতে
নাসিরউদ্দীন আল-তুসী জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসের এক অনন্য প্রতিভা। গ্রহসমূহের ঘূর্ননকালে অ্যাকোয়েন্ট(Equant) সমস্যা সমাধানে ঘূর্নায়মান বৃহৎ বৃত্তের মাঝে ক্ষূদ্র বৃত্তের ধারনা প্রবর্তন করেন যা এখনো পর্যন্ত একটি গ্রহনযোগ্য সমাধান। তাঁর নামের প্রতি সম্মান রেখে একে তুসী কাপল(Tusi-couple) নামকরন করা হয়েছে। কোপার্নিকাসের সৌর মডেলে একে সরাসরি গ্রহন করা হয়েছে। এছাড়া জিজ্-ই-ইখানী(زیجِ ایلخانی) নামে তাঁর একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সংকলন রয়েছে যাতে গ্রহসমূহ এবং অন্যান্য তারকার অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। তাঁর আরেকটি বড় কৃতিত্ব হচ্ছে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানকে প্রভাবিত করে বর্তমান আজারবাইজানের মারাগাহ(maragheh) নামক স্থানে ১৩৫৯ সালে একটি বিশাল মানমন্দির এবং বিজ্ঞান গবেষনাগার স্থাপন করেন। এটি শুধু সে সময় নয় বরং পরবর্তী কয়েক শতক পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানমন্দির হিসেবে বিবেচিত হোত। তুসী এ মানমন্দিরে তৎকালীন পৃথিবীর প্রায় সকল প্রথম সারির জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে সমবেত করতে পেরেছিলেন।
মারাগাহ্ মানমন্দির; এখনো দৃশ্যমান
সুবিখ্যাত উমাইয়া মস্জিদের নামাযের সময় হিসেবের দায়িত্বে ছিলেন ইবন্ আল-শাতীর। বছরের বিভিন্ন সময়ে সুর্যের বিভিন্ন অবস্থানের উপর ভিত্তি করে দিনের বেলায় নামাযের বিভিন্ন সময় নিখুঁতভাবে নির্ণয়ের জন্য তিনি ঐ মস্জিদে একটি দারুন সুর্যঘড়ি(Sun Dial) নির্মান করেন। এছাড়াও তিনি আরো অন্ততঃ চারটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের আবিষ্কর্তা। তিনি ‘কিতাব নিহায়াত আল-সূল ফি তাশিহ্ আল-উসূল(The Final Quest Concerning the Rectification of Principles) গ্রন্থে সূর্য, পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহসমূহের গতিপথের উপর টলেমীর মডেলে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনেন এবং এর মাধ্যমে ষোড়শ’ শতকে কোপার্নিকাসের যুগান্তকারী সৌরমডেল নির্মানে সরাসরি অবদান রাখেন, যদিও সে কৃতিত্বকে তখন অস্বীকার করা হয়।
উলুঘ বেগের মানমন্দিরের ভগ্নাবশেষ
রাজকার্যের ব্যস্ততা যে বিজ্ঞান সাধনার পথে বাধা প্রদানে সক্ষম নয়, উলুঘ বেগ তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের বংশধর এবং তৈমুর খানের পৌত্র এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৪৩৭ খৃষ্টাব্দে সুবিখ্যাত জিজ্-ই-সুলতানী(زیجِ سلطانی) রচনা করেন যাতে প্রায় এক হাজার তারকার বর্ণনা প্রদান করেন। পরবর্তী দুই শতক এটি জগতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত হোত। তবে, উলুঘ বেগ সমরখন্দে একটি মানমন্দির নির্মানের জন্যেই বেশী পরিচিত।
এর পর থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের সুর্য অস্তমিত হতে থাকে, যদিও এ অবদান একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি বরং থেমে থেমে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিজ্ঞানের জগতে মুসলমানদের অবদান রচনার অন্যতম দিকপাল ডোনাল্ড আর. হিল(Donald Routledge Hill; ১৯২২-১৯৯৪) তাই, জ্যোতির্বিদ্যায় মুসলমানদের ইতিহাসকে চারটি সুনির্দিষ্ট সময়কালে ভাগ করেছেন।
ক. ৭০০-৮২৫; সাসানীয়, ভারতীয় এবং হেলেনীয় জ্যোতির্বিদ্যা আয়ত্বে আনয়ন
খ. ৮২৫-১০২৫; আয়ত্বকৃত বিদ্যার উপর উদ্দীপ্ত গবেষনা এবং উন্মেষ
গ. ১০২৫-১৪৫০; জ্যোতির্বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ
ঘ. ১৪৫০-১৯০০; পতনের কাল, খুবই সামান্য অবদান
জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনায় একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে, এতে গণিতের ব্যবহার বিজ্ঞানের অন্য যে কোন শাখার চাইতে বেশী। প্রকৃতপক্ষে, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিত হাতে হাত রেখে চলে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের যে অবদান আমরা দেখতে পেলাম তা গণিতে পারদর্শিতা ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। অতএব, গণিতে মুসলমানরা পারদর্শী ছিলেন একথা সহজেই বলা চলে। তবে, এক্ষেত্রে তাঁদের উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রয়েছে কীনা তা আসছে পরের পর্বে।
চলবে.....
আগের পর্বগুলোঃ
১. ভূমিকা পর্ব
২. বিজ্ঞানের দর্শন
৩. বিজ্ঞানের ইতিহাস
৪. মৌলিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৫. ব্যবহারিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৬. রসায়নবিজ্ঞানে অবদান
৭. আলোকবিজ্ঞানে অবদান
৮. জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১০ রাত ১১:২১