কোন একটি নির্দিষ্ট সময়কালে বিজ্ঞানে কারো অবদানের স্বরূপ সন্ধানের পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা এবং ঐ সময়ের পূর্ব পর্যন্ত মানবসভ্যতায় বিজ্ঞানের অবস্থান কোথায় তা নিরুপন করা। এ পর্বে তারই একটা সংক্ষিপ্ত (অপ্রতুলও বলা যেতে পারে) প্রচেষ্টা থাকছে।
উইকিপিডিয়ার ঋনস্বীকার করে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিই এভাবে, “ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান (Science)।”সহজ কথায়, যদি বলি, বিজ্ঞান হচ্ছে, দৃশ্যমান জগতের ঘটে যাওয়া ঘটনার উপর পদ্ধতিগত পর্যবেক্ষন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লব্ধ সুসংবদ্ধ জ্ঞান। বলা ভাল, এই জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতিও বিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত। প্রাকৃতিক(Natural) এবং সামাজিক(Social)-এই দুইটি ক্ষেত্র নিয়ে বিজ্ঞান কাজ করে। জীব ও জড়জগত সংক্রান্ত জ্ঞান নিয়ে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান আর মানুষ ও তার পরিবেশগত জ্ঞান নিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান। তবে, জ্ঞান যে ধরনেরই হোক, যে ক্ষেত্রেই তার কাজ হোক, শর্ত থাকে যে, বিজ্ঞানের আওতায় পড়তে হলে উক্ত জ্ঞানটিকে সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে। আর একই শর্তের অধীনে যে গবেষকই পরীক্ষণটি করুন না কেন ফলাফল একই হতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তি চেতনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষণের ফলাফল কখনও পরিবর্তিত হতে পারে না।
এবার, আরেকটি ভুল ধারনা দূর করা দরকার। তা হচ্ছে, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি কী একই কথা? এদের মধ্যে সম্পর্ক কী? আর সত্যিকারের তফাতই বা কোথায়?
আবার উইকিপিডিয়া! "প্রযুক্তি(Technology) হল কিছু প্রায়োগিক কৌশল যা মানুষ তার প্রতিবেশের উন্নয়নকার্যে ব্যবহার করে।" শুধু মানুষই নয় প্রানীজগতের যে কোন প্রজাতি (Species) তার চারপাশের প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার এবং স্বউদ্ভাবিত বিভিন্ন যন্ত্রের (Tools) প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলার ব্যবহারিক জ্ঞানটিই প্রযুক্তি। মানব সমাজে প্রযুক্তি হল বিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের একটি আবশ্যিক ফলাফল। অবশ্য এটাও ঠিক যে, অনেক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন থেকেই আবার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অনেক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরন স্বরূপ, ক্ষরণ নলে (Discharge Tube) বিশেষ শর্তসাপেক্ষে ক্যাথোড রশ্মির (Cathode Ray) আপতনের ফলে বিজ্ঞানী রন্টজেন এক্স-রে (X-Ray) আবিষ্কার করে। এটি বিজ্ঞান। অন্যদিকে, এই রশ্মিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে ব্যবহারোপযোগী করে তুলতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রের উদ্ভাবন এবং উন্নয়ন হচ্ছে প্রযুক্তি। মজার ব্যাপার হলো, এই প্রযুক্তির উন্নয়ন আবার চিকিৎসা-পদার্থবিদ্যা (Medical Physics) নামে বিজ্ঞানের নতুন এক ক্ষেত্রের জন্ম দেয়! টেলিভিশন হচ্ছে প্রযুক্তি আর এর পেছনে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ (Electromagnetic Wave), ইলেকট্রন বীম (Electron Beam)- এ সবই হচ্ছে বিজ্ঞান। তাই, এককথায় এটা বলা যায় যে, বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞানের আহরন আর প্রযুক্তি হচ্ছে এই জ্ঞানের সহজ এবং সুবিধাজনক ব্যবহার।
এরপরে আসা যাক, বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ে। “বিজ্ঞানের ইতিহাস বলতে আমরা এখানে বুঝব এমন ধরণের ঐতিহাসিক নিদর্শন বা ঘটনাসমষ্টি যা যুগে যুগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিস্তার লাভ করেছে এবং যার ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থেকেছে সবসময়।” ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানের উপরে ব্যক্তি বিশেষের কাজ এবং তৎকালের মানুষের বিজ্ঞানের প্রতি মনোভাব এ নিয়েই বিজ্ঞানের, বিশেষ করে প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস গড়ে উঠেছে। সংক্ষেপে, এক একজন বিজ্ঞানীর কর্মযজ্ঞ এবং এই সময়ে তার পক্ষে-বিপক্ষের মতামত, সমকালীন প্রতিক্রিয়া এবং সুদুরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা থাকবে।
তাত্ত্বিক আলোচনায় যারা বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন তাঁদের সহ্য ক্ষমতার শেষ পরীক্ষা নিতে বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে। দর্শন (philosophy) জ্ঞানের অন্যতম প্রাচীন একটি শাখা , যার অর্থ love of wisdom বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ। দর্শনের সাথে মূল সম্পর্ক হচ্ছে প্রজ্ঞার, আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসার। জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা এক জিনিস নয়। ঘটনা ও তথ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ও নির্ভুল ধারণা থেকে জ্ঞান(knowledge) লাভ করা যায়, কিন্তু দার্শনিক (যিনি দর্শন চর্চা করেন তাকেই দার্শনিক বলা হয়) কেবল তথ্যগত জ্ঞানের উপর নির্ভর করেন না। দর্শনের প্রধান কাম্য বিষয় প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার অনুসন্ধান ও চর্চার মাধ্যমেই দর্শন বিকাশ লাভ করে। মূলত: দর্শনকে তার বিষয়বস্তু দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা বিফলে পর্যবসিত হয় বরং একে এক অনন্য সুশৃঙ্খল পদ্ধতি ও তার আবেদনের দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করলেই বুঝতে সুবিধা হয়। অন্যদিকে, বিজ্ঞান দর্শন (philosophy of Science)দর্শনের অন্যান্য শাখা যেমন- মনোদর্শন, ধর্মদর্শন, নীতিদর্শন, রাষ্ট্র-দর্শন ইত্যাদি শাখার মতই একটি শাখা। প্রকৃতপক্ষে, দর্শন বিষয়টিই জ্ঞানের একটি অনন্য শাখা হিসেবে শিক্ষার অন্যান্য বিষয় যেমন জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস, ভূগোল এগুলো থেকে বৈশিষ্ট্যগতভাবে আলাদা। অন্যান্য বিষয়ের মতো দর্শনের যেমন কোন সুনির্দিষ্ট বিষয় নেই, তেমনি সম্ভাব্য সকল বিষয়বস্তুই দর্শনের অন্তর্ভুক্ত এবং কোন না কোনভাবে যে কোন বিষয়েই দর্শনের প্রবেশাধিকার থাকে। দর্শন তার বিচার বিশ্লেষণের পদ্ধতির সাহায্যে জীবন ও জগতের বিভিন্ন মৌলিক সমস্যাগুলি (যেগুলো যে কোন বিষয় থেকে উদ্ভূত হতে পারে) সমাধানের চেষ্টা করে। এদিক থেকে বিজ্ঞান থেকে উদ্ভূত নানা মৌলিক প্রশ্নগুলি যার সমাধান শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে পাওয়া যায় না, বিজ্ঞানের পদ্ধতিগুলো যেগুলো বিভিন্ন বিভাগের জন্য আলাদা এবং সমন্বয়হীন, বিজ্ঞানের ভিত্তিগুলো সুদৃঢ় কি না ইত্যাদি বহু প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টায় দর্শনের একটি শাখা হিসাবে বিজ্ঞান দর্শনের সৃষ্টি। সংক্ষেপে, বিজ্ঞানের দর্শন যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, সেগুলো হলোঃ
১. বিজ্ঞানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
২. বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আহরনে পর্যবেক্ষন এবং পরীক্ষণের ভূমিকা
৩. বিজ্ঞানের দাবী প্রমানের পদ্ধতি
৮. বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পদ্ধতিসমূহ
৫. বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উন্নয়ন, প্রসার এবন অগ্রসরতা
৬. ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিজ্ঞানের বিষয়াদি এবং বৈশিষ্ট্যের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া
৭. বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মাঝে সম্পর্ক এবং পার্থক্যের স্বরূপ
৮. মানব কল্যানে বিজ্ঞান ব্যবহারের পরিধি
তত্ত্ব কচ্কচানির পালা শেষ। পরবর্তী আলোচনা অনুধাবনের ক্ষেত্রে এদের একান্ত প্রয়োজনের তাগিদেই এর অবতারনা। এখন, আমরা মানব ইতিহাসে বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা করব।
আগুনের আবিষ্কারঃ বিজ্ঞানের সূচনা?
বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে জর্জ সার্টনের(১৮৮৪-১৯৫৬; যিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসের জনক নামে খ্যাত) উক্তিটিই আমার কাছে খুব পছন্দের। তিনি বলেন, “It (science) began whenever and whatever men tried to solve the innumerable problems of life.” আবির্ভাবের পর থেকেই মানুষ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, যার মধ্যে স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষা সংকটই সবচেয়ে জটিল। মানুষ যদি নিজে না বাঁচে তাহলে থাকে তা কী? তাই, মানুশের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের উৎপত্তি, বলা চলে। তারপরে, টাইম লাইন রক্ষার খাতিরে বেশীরভাগ বিজ্ঞানীই আগুনের আবিষ্কারকে বিজ্ঞানের সূচনাকাল বলে চিহ্নিত করেছেন। দাবানল সহ বিভিন্ন উৎস থেকে আদিম মানুষ আগুন সংগ্রহ করতো হয়তো; কিন্তু, প্রথম যে মানুষটি পাথরে পাথর ঘষে আগুন সৃষ্টি করেছিল সে কি কষ্মিনকালে ভেবেছিল যে, সে একটি নব সভ্যতার জন্ম দিলো? তার হাতে বিপ্লবের সূচনা হলো? আগুন আবিষ্কারের সময়কাল নিয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও বেশীরভাগের মত আজ হতে ৪০,০০০-৬০,০০০ বছরের মধ্যে। যাই হোক, এভাবেই চলেছিল অনেকটা কাল। ভাষা এবং স্মৃতির মাধ্যমে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এরপরে এলো লেখনীর জ্ঞান। তারপর একসময় যখন মানুষ তার কর্ম দেখে তার কাজের অর্থ ও গুরুত্ব বুঝতে পারল তখন সে তার কাজগুলোকে গুছিয়ে আনার চেষ্টা করল। আর এভাবেই জন্ম নিলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। তারপরের ইতিহাস হল বিপ্লবের ইতিহাস যার পরে আর মানব সভ্যতাকে আর কখনও পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার মানচিত্র, অধিকাংশের মতে যেখানে মানব সভ্যতার উৎপত্তি!
আমাদের জানা ইতিহাসের জ্ঞান থেকে আমরা বলতে পারি যে, মানব সভ্যতার সূচনা হয়েছে, টাইগ্রিস(দজ্লা) এবং ইউফ্রেটিস্(ফোরাত) নদীর অববাহিকায় মোসোপটেমিয়া (আজকের দিনের ইরাক) অঞ্চলে। আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ সালে এখানে জড়জগতের বিভিন্ন পর্যবেক্ষন সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে লিখে রাখার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। একে, বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহের সূচনা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। যাই হোক, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং নীল নদ বিধৌত মিসরে বিজ্ঞানের মন্থর সূচনা হলেও বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে পুরোদমে আলোচনার জন্য আমরা চলে যাব এশিয়া মাইনর পেরিয়ে বস্ফোরাসের ওপারে প্রাচীন গ্রীস ও রোমে।
এথেন্স কেন্দ্রিক প্রাচীন গ্রীস
সেখানেই আবির্ভূত হলেন থেলিস্ (Thales; ৬২৪-৫৪৬ খৃষ্টপূর্বাব্দ), যাঁকে বলা হয় বিজ্ঞানের জনক(Father of Science)। বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) থেলিস হাত ধরেই পাশ্চাত্য দর্শনের সূচনা বলে মত প্রকাশ করেছেন। অবশ্য, আজ হতে আড়াই হাজার বছর আগের সে সময়টা এমন যে, বিজ্ঞান আর দর্শনের মাঝে দৃশ্যমান কোন পার্থক্য করা সম্ভব ছিল না। এভাবে, সূর্যগ্রহনের ভবিষ্যদ্বাণী, বৃত্তের ব্যাস এবং লোডস্টোনের(Loadstone) চৌম্বক ধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান প্রভৃতির মাধ্যমে তাঁর হাত ধরেই মূলতঃ প্রথাগত বিজ্ঞানের পদযাত্রা শুরু হলো।
চলবে.....
ভূমিকা পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১০ রাত ৯:৩০