১৬ বছর বয়সে শুকন্তলার বিয়ে হয় হাসানের সাথে। কবুল বলার সময় তার থেকে বিদায় নেয় জীবনের সব সুখ। কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাসা ছেড়ে বুকভরা আবেগ ঢেকে চলে আসে অন্যের ঘড়ে। হয়ে যায় অন্যকারো।
লাল টুকটুকে এক শাড়ি পরে সে আসে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই পরিবেশে। কিন্তু কেউ একটু চোখ তুলেও তাকায় না। যে যার যার কাজে ব্যস্ত। যেই ঘরে তার বিয়ে হয় সেখানকার বেশিরভাগেরই মত ছিল না বিয়েতে। তারা চেয়েছিল এমন এক মেয়ের সাথে বিয়ে হোক যে ভাল মত শিক্ষিত। কিন্তু হাসানের কাছে শিক্ষার চেয়ে সৌন্দর্যের গুরুত্ব বেশি হওয়ায় বিয়েটা হয়।
এভাবেই প্রথমত পরিবারের কাছ থেকে অবহেলিত হয়ে কেটে যায় বছরখানেক। হাসান সাহেব একটু ভাল অবস্থানে আসলে ছোট একটি বাসা নেয় শহরে। গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসার সময় শুকন্তলার সে কি উত্তেজনা। ইতিমধ্যে তার একটি ছেলে হয়। আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সে। ছেলেকে নিজের মত করে বড় করার স্বপ্ন, একটি সাজানো সংসারের স্বপ্ন। ছিমছাম বাসা। একটা বারান্দা। পাশেই ছোট বাগান। সে, তার ছেলে এবং স্বামী সুখে থাকবে। ব্যাস, এতটুকুই।
তারা গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহরে। কিন্তু সে যা ভেবেছিল তার কিছুই হয় না। হাসান সাহেব সারাদিন কাজে থাকে বাসার বাইরে। সকালে বের হয়, রাতে বাসায় ফিরে। ভাত খেয়ে ঘুম। যেন একটা নিয়মেই আবদ্ধ তার জীবন। শুকন্তলা বাসায় সারাদিন একা। বড় বিরক্ত লাগে তার। রাতে হাসান সাহেব ফিরলে, খাওয়ার টেবিলে তার ইচ্ছে করে ভাত খেতে খেতে জীবনের সুখের গল্প গুলো করতে। কিন্তু হাসান সাহেবের গম্ভীর অভিব্যক্তি দেখে সাহস হয় না। খাওয়ার রুচিও থাকে না তার। কতদিন আর এসব আলু ভর্তা, শাখ সবজি দিয়ে খাওয়া যায়। মাছ মাংস দূরে থাক, একটা ডিম ভেজে খাওয়াও যেন তাদের বিলাসিতা হয়ে যাবে। নিঃশব্দে ভাত খেয়ে উঠে আসে শুকন্তলা। নীরবে চলে যায় ছাদে। তার একটি অদ্ভুত স্বভাব আছে। মন খারাপ হলে আকাশ দেখতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে নির্বাক সময় কাটে তারা ভরা আকাশের নিচে, মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।
নিজে দিনে নিয়ম করে একবার কাঁদলেও অন্য কাউকে কাঁদতে দেখলে তার অবাক লাগে। অদ্ভুত এক প্রশ্ন জাগে মনে, যার কোন মা বাবা থাকে না। 'মানুষ কাঁদে কেন? তারা যদি আমার জায়গা থেকে দেখতে পারত তাদের জীবন!'
বৃষ্টি হলেও সে চলে যায় ছাদে কিংবা জনশূন্য রাস্তায়। কোন মানুষকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়। আজকাল মানুষ কি এতই ব্যস্ত যে একটু বৃষ্টিতে ভেজার সময়ও হয় না? তাদের শৈশবের সময় তো ঠিক এমন ছিল না সবকিছু। বৃষ্টির স্পর্শে নস্টালজিক হয়ে যায় শুকন্তলা। এক এক করে মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা। কি জীবন সে কাটিয়ে এসেছে আর এখন তা হয়েছে কেমন? ভাই বোন সবাই মিলে কত বৃষ্টিতে ভিজেছে। স্কুল বন্ধের দিনে একসাথে কত রাত কাটিয়েছে গল্প করে। সারারাত এক রুমে গোল করে বসে গল্প করা শেষে কাকডাকা ভোরে সুখের রেশ নিয়ে যে যার রুমে ঘুমুতে গিয়েছে বুকভরা তৃপ্তি নিয়ে। স্কুল খোলা থাকলে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে হেটে একসাথে গিয়েছে স্কুলে। কত হাসি, কত কান্না। কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাললাগা।
শুকন্তলা উদাস মনে ভাবে, এখন কোথায় সে দিনগুলো?
সময় গড়িয়ে যায়। রাস্তায় হেটে যাওয়ার সময় প্রচন্ড ধনীব্যক্তি দেখলে শুকন্তলা তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। মস্তিষ্কে পুরাতন সেই ইচ্ছে আবার জেগে উঠে- 'কবে আমি টাকা কামাবো। কবে তাদের মত সুখী হবো'। পর মুহূর্তেই ঘোর ভাঙ্গে। একজন শুকন্তলার জীবনে বাস্তবতার প্রলেপ এতটাই প্রখর যে খুব বেশিক্ষণ কল্পনায় ডুবে থাকতে পারে না তারা।
শুকন্তলার ছেলে বড় হয়। স্কুলে ভর্তি করানোর সময় আসে। দিনে ঠিকমত ভাত খেতে পারাই সমস্যা সেখানে ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাবে কেমনে? এখন আর এতকিছু সে চিন্তা করতে পারে না। বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে। সে চিন্তাভাবনা বন্ধ করে বিধাতার কাছে প্রতবাদ জানায়, হায় খোদা এত মানুষ থাকতে কেন আমি? এক টুকরো সুখের আশায় কি কেটে যাবে পুরো জীবন? সে সময় কি কখনই আসবে না যখন অনেকের মত আমিও মনের সবটুকু তৃপ্তি মেঠানোর হাসি হেসে বলবো, জীবন এত সুন্দর কেন?
শুকন্তলাদের জীবনের গল্প এমনই হয়। খুব বেশি চাওয়া পাওয়া তাদের থাকে না। সুযোগ কিংবা পরিস্থিতিও নেই। অল্প যা কিছু চায় তাও তারা পায় না। তবু মনে আশা থাকে, একদিন সুখ আসবে। আফসোস, সেই একদিন আসার আগেই তাদের সবকিছু অসমাপ্ত রেখে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন চলে আসে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:০৭