ধূমপান ও তামাকের নেশা যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস এর আলোচনা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম
চিকিৎসকদের ধূমপান ও তামাক ত্যাগ করতে হবে। পাশাপাশি সব রোগীকে ধূমপান ও তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। যদি চিকিৎসক ধূমপান ও তামাক সেবন করেন, তবে সেসব নেশাগ্রস্ত চিকিৎসকদের বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি রোগীদের মধ্যেও যদি কেউ ধূমপান বা তামাক সেবন করেন, তবে তাদের চিকিৎসা প্রদান না করার কথা জানালে তারা ধূমপান ও তামাক ত্যাগে বাধ্য হবে।
৩১ মে সকাল ১১টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১৫, উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি উপরোক্ত ঘোষণা দেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মনজরুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালিক এমপি। সম্মানিত অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নুর হোসেন তালুকদার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রধান ডা. এম মোস্তফা জামান, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান ও মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য) রোকসানা কাদের।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ধূমপান ও তামাক হচ্ছে বহবিধ ক্ষতিকর কারণ। ধূমপান হচ্ছে মাদক সেবনের প্রবেশ পথ। তরুণরা সিগারেটের মাধ্যমে নেশাগ্রস্ত হয়, এদের অনেকে পরে মাদকের নেশায় ধাবিত হয়। মাদকের কারণে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তামাক ও মাদক যে কোন মারণাস্ত্রের চাইতে ভয়াবহ। তামাক ও মাদকের নেশা যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ধূমপান ও তামাকের নেশার মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করছে। এতে একদিকে তারা অসুস্থ্য হচ্ছে, কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। এতে তাদের সমস্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশেরও ক্ষতি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি আইন লঙ্গণ করে সিগারেটের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এটি বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী বিড়ি-সিগারেটসহ সব রকম তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের পঞ্চাশ শতাংশ স্থানে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান করা হচ্ছে। ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান করা হলে মানুষের মধ্যে ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার আরও কমে আসবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী আরও বলেন, আত্মীয় স্বজনকে বলতে হবে, কেউ যদি ধূমপান করে, যেন আমাদের বাসায় না আসেন। তবে নিকটজনতের মধ্যে মরণঘাতি নেশার প্রবণতা কমে আসবে।
অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, যারা ধূমপান শুরু করে, তাদের ৪০% সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখেই ধূমপান শুরু করে। সিগারেটসহ মৃত্যুঘাতী পণ্যের ব্যবসা যারা করে সেসব তামাক কোম্পানি এটা জানে বলেই তারা অভিনব উপায়ে আইন লঙ্ঘণ করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ধূমপান ও তামাকের নেশা কমাতে তামাকজাত দ্রব্যের অবৈধ প্রচারণা ও অবৈধ ব্যবসা বন্ধে তামাক কোম্পানির শাস্তির আওতায় আনাসহ আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
নুর হোসেন তালুকদার বলেন, ধূমপান ও তামাক সেবন একটি ভয়াবহ নেশা। এ নেশা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেমন দরকার, তেমনি আইনেরও কঠোর প্রয়োগ দরকার।
ডা. এম মোস্তফা জামান বলেন, পঞ্চাশের দশকেই জানা যায়, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সে সময়ের যুক্তরাজ্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ধূমপানে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশি। কিন্তু ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলো তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা দিতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে। তামাক কোম্পানি এজন্য অর্থ দিয়ে কিছু বিজ্ঞানীকে ক্রয় করে, যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষ ও নীতি নির্ধারকদের বিভ্রান্ত করে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল লুথার জে টেরি’র বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হবার পর বিশ্ববাসী সতর্ক হয় ও তামাক নিয়ন্ত্রণে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠে। তামাকের ব্যবসার সঙ্গে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসার মতই।
তিনি আরও বলেন, তামাকের ব্যবসা বৈধ হলেও অনৈতিক। ক্ষতিকর এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই সিগারেটসহ তামাক বিক্রয়ের অনুমোদন নিতে হবে। সে প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। পাশাপাশি চোরাচালান ও অবৈধ ব্যবসা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান বলেন, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে গর্ভবতী নারী ও শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই শুধু পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহন নয়, বাসায়ও ধূমপান পরিহার করা উচিত। তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে সব তামাকের উপর উচ্চহারে কর বাড়াতে হবে। কারণ সব তামাকই মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ধূমপান ও তামাক জীবনঘাতি বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। তাই ধূমপান ও তামাক নিয়ন্ত্রণকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। চিকিৎসকদের মধ্যে ধূমপানের নেশা কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
রোকসানা কাদের বলেন, তামাকের কারণে মৃত্যুর যে ক্রমবর্ধমান হার, তা কমিয়ে আনতে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ অঙ্গীকারের অংশ হিসাবেই সরকার ২০১৩ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী পাস করেছে এবং ২০১৫ সালে এ আইনের বিধিমালা পাস করেছে। এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে ১% স্বাস্থ্যকর আরোপ করেছে। আগামী দিনেও তামাক নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন বলবৎ থাকবে।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ মনজরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে ধূমপান ও তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করা। সে দিক থেকে এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস সফলই বলা যায়। তবে এ সফলতা ধরে রাখতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তা সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সংগঠন, গণমাধ্যমÑসবার গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ রয়েছে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রবর্তিত বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস সম্মাননা ২০১৫ পদক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ড. মোহাম্মদ নাসিম এর কাছ থেকে গ্রহণ করেন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে খুলনা জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি ও খুলনা জেলার প্রশাসক জনাব মোস্তফা কামাল, বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতীয় অধূমপায়ী ফোরাম এর প্রতিষ্ঠাতা ও সমাজ সেবক সিজিএম কামাল এবং বেসরকারি সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশন এর উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. এম এহসানুর রহমান।
অনুষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ান আঞ্চলিক পরিচালক কর্তৃক প্রবতির্ত ‘এপ্রিশিয়েন এওয়ার্ড’ অর্জন করে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় তামাক বিরোধী সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর সদস্য (বোর্ড প্রশাসন) ফিরোজ শাহ আলম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ড. এম মোস্তফা জামান এর কাছ থেকে বিশেষ সম্মাননা গ্রহণ করেন ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর নির্বাহী পরিচালক সাইফুদ্দিন আহমেদ ও এনবিআর সদস্য ফিরোজ শাহ আলম।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য মন্ত্রী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর নমুনা উদ্বোধন করেন। উল্লেখ্য, আগামী মার্চ ২০১৬ থেকে দেশের সব সিগারেট, বিড়ি ও তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান করা হবে।