somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্পর্শ এক জটিল বিষয়

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ ভোর ৬:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গদ্য


স্পর্শ এক জটিল বিষয়
সৈয়দ আফসার
অনেকেই বলেন— আমি আবেগি; আমিও তাই ভাবি… আমার আবেগ এক-একটি রক্তবীজ। স্পর্শাবেগে নিজেকে খুঁজি। জলের স্পর্শে দাঁড়াই; মাছ হতে চাই; জলের ছায়ায় নিজেকে আঁকি। জল ছুঁয়ে দেখি; সেও আমাকে জড়ায় স্পর্শের দানায়! জলের মতো সময়ও চলে; আবার জলের স্পর্শে সময়ও ফুরায়। বাতাসের স্পর্শে পাতা নড়েচড়ে ওঠে; পাতাও ঝরে। যে পাতাটি বাতাসের স্পর্শে উড়ে; উড়ার স্থায়িত্ব পরিমাপ করে; সংক্রমিত হয়।যে পাতাটি বাতাস চড়ে মাটি স্পর্শ করলো; তারও তো একটি স্পর্শ কামনা আছে। যে পাখিটি এইমাত্র উড়ে গেল বাতাসের ডানায়; ডানা ভরে অন্য একটি ডালে বসলো; পালক ঝেড়ে দাঁড়ালো… এই যে আমি ভাবছি; দাঁড়িয়ে আছি; এদিক-ওদিক চোখ গুলিয়ে তাকাচ্ছি; এই তাকানোর ভেতরও আমার রক্ত কণিকাগুলো আরো তীক্ষ্ণ ভাবে নাড়িয়ে তুলে। প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ স্বপ্ন আমাকে স্পর্শ করে; চোখও দেখছে আমার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে চলছে মারুতিগাড়ি। গাড়ির চাকাও তো স্পর্শ করছে চেনা জানা পথ, পথের সুরত।স্পর্শ করছে শাদাকালো নুড়িপাথর।

অভিজ্ঞতা আর দৃশ্য আমাকে স্পর্শ করে; তাড়িত করে; কারণ অভিজ্ঞতাই স্পর্শবীজ। অভিজ্ঞতাই স্পর্শের কাঙ্ক্ষিতফল। অভিজ্ঞতাই সকল ঘটনাবলির ছক এঁকে দেয়। অভিজ্ঞতাই নির্ভরতার মেলবন্ধন তৈরি করে। সেখান থেকেই আমি আমার লেখার থিম পেয়ে যেতে পারি। হয়ত প্রকৃতিই আমাকে ভাবায়, লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়, লিখতে বসায়। আমার কথা, আমার কবিতা কে জানিতে চায়? আমরা সবাই তো জানি— মানুষ আর জীবন পদে পদে অদল-বদল হয়। এই অদল-বদল অনুভূতির ভেতর হাজারো কাঙ্ক্ষা লুকায়। মনের কাঙ্ক্ষা না ফুটলে কী ভালো কবি হওয়া যায়? কবি তো আশা, কল্পনা, স্মৃতিকাতরতার ভেতর মনের রঙে নিজেকে রাঙাবেন; সময়কে রাঙিয়ে তুলবেন।

বিনয় মজুমদার যেভাবে বলেন— ‘যে গেছে সে চ’লে গেছে, দেশলাইয়ে বিস্ফোরণ হয়ে/ বারুদ ফুরায় যেন; অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/ আপন অন্তরলোকে; মাঝে-মাঝে সহসা সাক্ষাৎ/ তারই অনুজার সঙ্গে;/’ বিনয় যথার্থ বলেছেন, যে চলে যায় সেতো চলেই যায়; কিন্তু যে মনে রাখে সেতো সারাজীবন পুড়ে-পুড়ে অঙ্গার হয়; তার স্মৃতি তার কল্পনা তার সকল কল্পনার ভেতর ছোঁয়া যায়; শৈশব, কৈশোর, যৌবন এই তিনটি স্তরের ভেতর সময়স্পর্শ কিংবা সময়ানুভব ভিন্নতর হয়।

শৈশবের শীতের সকাল এখনো আমাকে স্পর্শ করে, তাড়িত করে; বারবার স্মৃতিদর্পণে লুবায়; ঝলমল করে; কাজের ফাঁকে অদৃশ্য হলেও পোড়ায়। শৈশবে খুব ভোরে ঘন কুয়াশার ভেতর হেঁটে মক্তবে যেতাম; হাঁটার ঠিক সামনে রাশি-রাশি কুয়াশার শাদা চাক দেখে দু’হাত দিয়ে স্পর্শ করতাম; হাতে লেগে যেত জলের কোলাহল; সেন্ডেল জড়িয়ে রাখত দূর্বা আর কুয়াশাজল। যারা নতুন শাড়ি পরতে শিখেছে তাদেরকে দেখতাম লোকচুক্ষের আড়ালে পুকুরে স্নান সেরে মুচকি হাসির ভেতর হেঁটে ফিরছে অন্দর মহলে…। কৃষক লাঙল জোয়াল কাঁধে মাঠে ছুটছে। গরুর হাম্বা ধ্বনি। বকনার দুধপান। লাফালাফি। ছাগলের তিড়িংবিড়িং…। রাখালের বিড়ি ফুঁকার দৃশ্য…।কৈশোর স্মৃতিকথা আমার পঞ্চমান্দ্রিয় জাগিয়ে তুলে, আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগ্রেট ধরাই; সিগ্রেট টান দিলে ধোঁয়া বের হয়। নির্গত ধোঁয়া উড়ছে, বাতাসে মিশছে; পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে জানি, কিন্তু অভ্যাসটি ছাড়তে পারিনি। না-ছাড়ার ভেতরের কথাও স্পর্শ করি। নিজের ভেতর রক্তাক্ত হই; স্পর্শ করি কৈশোরে দল বেঁধে দীর্ঘ সাঁকো পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া; অ্যাসেম্বলি!বই হারানো। কলম হারানো। খাতায় আঁকাআঁকি। দুষ্টুমি। শিক্ষকের বেতাঘাত…।

মনের স্পর্শ; হাতের স্পর্শ এক নয়। মানুষ কল্পনাপ্রবণ। প্রত্যেক মানুষের আলাদা একটি জগৎ থাকে। প্রত্যেকের মানুষের ভেতর আরেক আমি’র অস্থিত্ব থাকে। এই আমিত্ব’ই ক্ষণে ভাবায়, ক্ষরণে ভাবায়, মন সাজায়, ভাষায় জড়ায়। সেখান থেকে মানুষ তাঁর আমিত্বকে উপলব্দি করে দৈনন্দিন জীবন যাপনে মেশায়। যেমন কেউ গান লিখে, কেউ গান শোনে, কেউ সিনামা দেখে, কেউ ঘুরে বেড়ায়, কেউ গল্প করে, কেউ ব্যস্ত সাজসজ্জায়। কেউ আবার কবিতা লিখে, গল্প লিখে, গদ্য লিখে। কেউ সময় আর স্মৃতিকে ধরে রাখে, মনে রাখা, ধরে রাখাই মানুষের জীবন বাস্তবতা। আর যৌবনাভব ছায়াকে কায়া ভেবে তাঁকে ফিরিয়ে দেয়া…। এই ফিরিয়ে দেয়াই আমার স্পর্শ-আকুলতা।আর এখন প্রতিদিন সতেজ সবজি স্পর্শ করি হাতে দোলে গন্ধ ও মায়া। তবে সময়ের হাত স্পর্শ করলেই মনে হয়— স্পর্শ ছাড়া পূর্ণতা আসে না।

কবিতা ভাব থেকে মায়ায় জগৎ তৈরি করে।আর আবেগই হচ্ছে শিল্পবস্তু; যা থেকে দানা বাঁধতে থাকে কথা ও সম্ভাবনা। তবে এও ঠিক সময় সকল আবেগ সমরূপি হতে পারে না। কিংবা সমরূপ নয়।আবেগ আর অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই বস্তুর সৃষ্টি বা বিকাশ ঘটে।মানুষ যা কল্পনা করে, ভাবে, স্পর্শ করে, অবলোকন করে, তা হলে তার দৃশ্যরূপ। আর এই ‘দৃশ্যরূপ’ই হচ্ছে কবিতার প্রাণ।মাধুর্য আর সৌন্দর্যের শুদ্ধতম রূপটি হচ্ছে চোখ খুলে দেখা আর ভাবা; কেননা কবিতা হচ্ছে শাশ্বত ইশারা।

আমার পাশে যে রাত শোয়ে থাকে; সে রাতেরও একটি স্পর্শ আছে।এই যে সারাদিন ব্যস্ততায় কাটে; চাকুরি ঠিকে থাকার আশায় কখনো সখনো একটু-আধটু মিথ্যাও বলি; কারো সাথে মনের অজান্তে রাগ করি, কটু কথাও বলি— এসব ভাবনা যখন রাতে বালিশের পাশে দাঁড়ায়; নিজেকে অসহায়ের মতো লাগে। ভাবি যদি রাগ সংবরণ করা যেত; কটু কথা না-বললে চলতো…। কারো কষ্ট দেখলে বুক কেঁদে ওঠে। গলা ঠেলে, চোখ খোলে, কান্না আসে। আমি কাঁদি। আমার পরিবেশ, আমার সমাজ, আমার জীবন স্পর্শ করে।

দেহের পরতে পরতে গাত্রদাহ! নিজের ভেতর প্রশ্ন জাগে কেনো লিখি? কার জন্য লিখি? লিখার কোন দায় আছে কিনা! শেষে এও ভাবি কবিতা না-লিখলে আমি হয়ত জীবন নিয়ে ভাবতাম না।কবিতা তো নিজের মুখের কথাগুলো বলে যাওয়া; দৈনন্দিন সময়কে বেঁধে ফেলার পথ খুঁজে নেয়া.. নিজের ক্লান্তি, দ্বেষ-বিদ্বেষ অন্যকে জানানো; কেননা সকল মানুষ কল্পনাপ্রবণ; প্রতিটি মানুষের ভেতর তার নিজস্ব কিছু নিয়ম থেকে যায়; যা মানুষকে আলাদা করে ফেলে… সব মানুষই কল্পনাপ্রবণ কল্পকথা কেউ ধরে রাখতে পারে; কেউ গান লিখে, কেউ গল্প করে কেউ গল্প দেখে কেউ আবার হেসেখেলে ঘুরে ফিরে জীবন কাটায়; কেউ আবার লিখে সময় কাটায়।

রান্নাও শিল্প। খাবারের আগে রান্নার ঘ্রাণই আমাকে স্পর্শ করে।জীবন আর বাস্তবতা একই গতিধারা কারণ রাত্রি হলেই মনে হয় আজ ঘুমিয়ে যাব একটু তাড়াতাড়ি কারণ রাত্রি কারো জন্য হয় সারারাত ঘুমিয়ে থাকার জন্য; কারো রাত আসে সিনামা দেখার জন্য; কারো আসে স্বপ্নে ডুবে থাকার জন্য; কারো আসে আগামী দিনের জন্য… আর আমি দীর্ঘরাত্রি জেগে থাকি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আশা নিয়ে। এখন প্রশ্ন হলো কেন লিখি কে আমাকে লিখতে শিখায়? কে আমাকে লিখতে বসায়? কারা আমাকে ভাবনার খোরাক জমায়? কারা আমাকে ভাবায়? যেমন ভাবি— স্পর্শ ছাড়া পূর্ণতা আসে না!তেমনি স্পর্শ ছাড়া রাত্রিও সাজে না। অনুভব ছাড়া তৃপ্তি মিলে না। স্মৃতি-প্রকৃতি ছাড়া মানুষ বাঁচে না।

আমার ইচ্ছাকথা; স্পর্শকথা মনে থাকে না। বয়সটা একুশের ঘরে থাকলে স্পর্শানুভব কেমন হয়?... এখন আর বলতে পারি না। একুশে ভাবলে হয়ত লজ্জায় লাল হয়ে যেত গাল; কালোতিলের ভেতর ঠেলে দেয়া যেত গালের টোল…। এখন হয়ত হাসির ছলে ফিরে আসে হারানো কান্না। কিন্তু পারিনা। স্পর্শের ভেতর বারবার নিজেকে হত্যা করতে চাচ্ছি; বারবার দেখতে চাচ্ছি প্রাণের ভেতর ঢুকে পড়া ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’…
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ৭:৫০
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×