গদ্য
স্পর্শ এক জটিল বিষয়
সৈয়দ আফসার
অনেকেই বলেন— আমি আবেগি; আমিও তাই ভাবি… আমার আবেগ এক-একটি রক্তবীজ। স্পর্শাবেগে নিজেকে খুঁজি। জলের স্পর্শে দাঁড়াই; মাছ হতে চাই; জলের ছায়ায় নিজেকে আঁকি। জল ছুঁয়ে দেখি; সেও আমাকে জড়ায় স্পর্শের দানায়! জলের মতো সময়ও চলে; আবার জলের স্পর্শে সময়ও ফুরায়। বাতাসের স্পর্শে পাতা নড়েচড়ে ওঠে; পাতাও ঝরে। যে পাতাটি বাতাসের স্পর্শে উড়ে; উড়ার স্থায়িত্ব পরিমাপ করে; সংক্রমিত হয়।যে পাতাটি বাতাস চড়ে মাটি স্পর্শ করলো; তারও তো একটি স্পর্শ কামনা আছে। যে পাখিটি এইমাত্র উড়ে গেল বাতাসের ডানায়; ডানা ভরে অন্য একটি ডালে বসলো; পালক ঝেড়ে দাঁড়ালো… এই যে আমি ভাবছি; দাঁড়িয়ে আছি; এদিক-ওদিক চোখ গুলিয়ে তাকাচ্ছি; এই তাকানোর ভেতরও আমার রক্ত কণিকাগুলো আরো তীক্ষ্ণ ভাবে নাড়িয়ে তুলে। প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ স্বপ্ন আমাকে স্পর্শ করে; চোখও দেখছে আমার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে চলছে মারুতিগাড়ি। গাড়ির চাকাও তো স্পর্শ করছে চেনা জানা পথ, পথের সুরত।স্পর্শ করছে শাদাকালো নুড়িপাথর।
অভিজ্ঞতা আর দৃশ্য আমাকে স্পর্শ করে; তাড়িত করে; কারণ অভিজ্ঞতাই স্পর্শবীজ। অভিজ্ঞতাই স্পর্শের কাঙ্ক্ষিতফল। অভিজ্ঞতাই সকল ঘটনাবলির ছক এঁকে দেয়। অভিজ্ঞতাই নির্ভরতার মেলবন্ধন তৈরি করে। সেখান থেকেই আমি আমার লেখার থিম পেয়ে যেতে পারি। হয়ত প্রকৃতিই আমাকে ভাবায়, লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়, লিখতে বসায়। আমার কথা, আমার কবিতা কে জানিতে চায়? আমরা সবাই তো জানি— মানুষ আর জীবন পদে পদে অদল-বদল হয়। এই অদল-বদল অনুভূতির ভেতর হাজারো কাঙ্ক্ষা লুকায়। মনের কাঙ্ক্ষা না ফুটলে কী ভালো কবি হওয়া যায়? কবি তো আশা, কল্পনা, স্মৃতিকাতরতার ভেতর মনের রঙে নিজেকে রাঙাবেন; সময়কে রাঙিয়ে তুলবেন।
বিনয় মজুমদার যেভাবে বলেন— ‘যে গেছে সে চ’লে গেছে, দেশলাইয়ে বিস্ফোরণ হয়ে/ বারুদ ফুরায় যেন; অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/ আপন অন্তরলোকে; মাঝে-মাঝে সহসা সাক্ষাৎ/ তারই অনুজার সঙ্গে;/’ বিনয় যথার্থ বলেছেন, যে চলে যায় সেতো চলেই যায়; কিন্তু যে মনে রাখে সেতো সারাজীবন পুড়ে-পুড়ে অঙ্গার হয়; তার স্মৃতি তার কল্পনা তার সকল কল্পনার ভেতর ছোঁয়া যায়; শৈশব, কৈশোর, যৌবন এই তিনটি স্তরের ভেতর সময়স্পর্শ কিংবা সময়ানুভব ভিন্নতর হয়।
শৈশবের শীতের সকাল এখনো আমাকে স্পর্শ করে, তাড়িত করে; বারবার স্মৃতিদর্পণে লুবায়; ঝলমল করে; কাজের ফাঁকে অদৃশ্য হলেও পোড়ায়। শৈশবে খুব ভোরে ঘন কুয়াশার ভেতর হেঁটে মক্তবে যেতাম; হাঁটার ঠিক সামনে রাশি-রাশি কুয়াশার শাদা চাক দেখে দু’হাত দিয়ে স্পর্শ করতাম; হাতে লেগে যেত জলের কোলাহল; সেন্ডেল জড়িয়ে রাখত দূর্বা আর কুয়াশাজল। যারা নতুন শাড়ি পরতে শিখেছে তাদেরকে দেখতাম লোকচুক্ষের আড়ালে পুকুরে স্নান সেরে মুচকি হাসির ভেতর হেঁটে ফিরছে অন্দর মহলে…। কৃষক লাঙল জোয়াল কাঁধে মাঠে ছুটছে। গরুর হাম্বা ধ্বনি। বকনার দুধপান। লাফালাফি। ছাগলের তিড়িংবিড়িং…। রাখালের বিড়ি ফুঁকার দৃশ্য…।কৈশোর স্মৃতিকথা আমার পঞ্চমান্দ্রিয় জাগিয়ে তুলে, আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগ্রেট ধরাই; সিগ্রেট টান দিলে ধোঁয়া বের হয়। নির্গত ধোঁয়া উড়ছে, বাতাসে মিশছে; পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে জানি, কিন্তু অভ্যাসটি ছাড়তে পারিনি। না-ছাড়ার ভেতরের কথাও স্পর্শ করি। নিজের ভেতর রক্তাক্ত হই; স্পর্শ করি কৈশোরে দল বেঁধে দীর্ঘ সাঁকো পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া; অ্যাসেম্বলি!বই হারানো। কলম হারানো। খাতায় আঁকাআঁকি। দুষ্টুমি। শিক্ষকের বেতাঘাত…।
মনের স্পর্শ; হাতের স্পর্শ এক নয়। মানুষ কল্পনাপ্রবণ। প্রত্যেক মানুষের আলাদা একটি জগৎ থাকে। প্রত্যেকের মানুষের ভেতর আরেক আমি’র অস্থিত্ব থাকে। এই আমিত্ব’ই ক্ষণে ভাবায়, ক্ষরণে ভাবায়, মন সাজায়, ভাষায় জড়ায়। সেখান থেকে মানুষ তাঁর আমিত্বকে উপলব্দি করে দৈনন্দিন জীবন যাপনে মেশায়। যেমন কেউ গান লিখে, কেউ গান শোনে, কেউ সিনামা দেখে, কেউ ঘুরে বেড়ায়, কেউ গল্প করে, কেউ ব্যস্ত সাজসজ্জায়। কেউ আবার কবিতা লিখে, গল্প লিখে, গদ্য লিখে। কেউ সময় আর স্মৃতিকে ধরে রাখে, মনে রাখা, ধরে রাখাই মানুষের জীবন বাস্তবতা। আর যৌবনাভব ছায়াকে কায়া ভেবে তাঁকে ফিরিয়ে দেয়া…। এই ফিরিয়ে দেয়াই আমার স্পর্শ-আকুলতা।আর এখন প্রতিদিন সতেজ সবজি স্পর্শ করি হাতে দোলে গন্ধ ও মায়া। তবে সময়ের হাত স্পর্শ করলেই মনে হয়— স্পর্শ ছাড়া পূর্ণতা আসে না।
কবিতা ভাব থেকে মায়ায় জগৎ তৈরি করে।আর আবেগই হচ্ছে শিল্পবস্তু; যা থেকে দানা বাঁধতে থাকে কথা ও সম্ভাবনা। তবে এও ঠিক সময় সকল আবেগ সমরূপি হতে পারে না। কিংবা সমরূপ নয়।আবেগ আর অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই বস্তুর সৃষ্টি বা বিকাশ ঘটে।মানুষ যা কল্পনা করে, ভাবে, স্পর্শ করে, অবলোকন করে, তা হলে তার দৃশ্যরূপ। আর এই ‘দৃশ্যরূপ’ই হচ্ছে কবিতার প্রাণ।মাধুর্য আর সৌন্দর্যের শুদ্ধতম রূপটি হচ্ছে চোখ খুলে দেখা আর ভাবা; কেননা কবিতা হচ্ছে শাশ্বত ইশারা।
আমার পাশে যে রাত শোয়ে থাকে; সে রাতেরও একটি স্পর্শ আছে।এই যে সারাদিন ব্যস্ততায় কাটে; চাকুরি ঠিকে থাকার আশায় কখনো সখনো একটু-আধটু মিথ্যাও বলি; কারো সাথে মনের অজান্তে রাগ করি, কটু কথাও বলি— এসব ভাবনা যখন রাতে বালিশের পাশে দাঁড়ায়; নিজেকে অসহায়ের মতো লাগে। ভাবি যদি রাগ সংবরণ করা যেত; কটু কথা না-বললে চলতো…। কারো কষ্ট দেখলে বুক কেঁদে ওঠে। গলা ঠেলে, চোখ খোলে, কান্না আসে। আমি কাঁদি। আমার পরিবেশ, আমার সমাজ, আমার জীবন স্পর্শ করে।
দেহের পরতে পরতে গাত্রদাহ! নিজের ভেতর প্রশ্ন জাগে কেনো লিখি? কার জন্য লিখি? লিখার কোন দায় আছে কিনা! শেষে এও ভাবি কবিতা না-লিখলে আমি হয়ত জীবন নিয়ে ভাবতাম না।কবিতা তো নিজের মুখের কথাগুলো বলে যাওয়া; দৈনন্দিন সময়কে বেঁধে ফেলার পথ খুঁজে নেয়া.. নিজের ক্লান্তি, দ্বেষ-বিদ্বেষ অন্যকে জানানো; কেননা সকল মানুষ কল্পনাপ্রবণ; প্রতিটি মানুষের ভেতর তার নিজস্ব কিছু নিয়ম থেকে যায়; যা মানুষকে আলাদা করে ফেলে… সব মানুষই কল্পনাপ্রবণ কল্পকথা কেউ ধরে রাখতে পারে; কেউ গান লিখে, কেউ গল্প করে কেউ গল্প দেখে কেউ আবার হেসেখেলে ঘুরে ফিরে জীবন কাটায়; কেউ আবার লিখে সময় কাটায়।
রান্নাও শিল্প। খাবারের আগে রান্নার ঘ্রাণই আমাকে স্পর্শ করে।জীবন আর বাস্তবতা একই গতিধারা কারণ রাত্রি হলেই মনে হয় আজ ঘুমিয়ে যাব একটু তাড়াতাড়ি কারণ রাত্রি কারো জন্য হয় সারারাত ঘুমিয়ে থাকার জন্য; কারো রাত আসে সিনামা দেখার জন্য; কারো আসে স্বপ্নে ডুবে থাকার জন্য; কারো আসে আগামী দিনের জন্য… আর আমি দীর্ঘরাত্রি জেগে থাকি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার আশা নিয়ে। এখন প্রশ্ন হলো কেন লিখি কে আমাকে লিখতে শিখায়? কে আমাকে লিখতে বসায়? কারা আমাকে ভাবনার খোরাক জমায়? কারা আমাকে ভাবায়? যেমন ভাবি— স্পর্শ ছাড়া পূর্ণতা আসে না!তেমনি স্পর্শ ছাড়া রাত্রিও সাজে না। অনুভব ছাড়া তৃপ্তি মিলে না। স্মৃতি-প্রকৃতি ছাড়া মানুষ বাঁচে না।
আমার ইচ্ছাকথা; স্পর্শকথা মনে থাকে না। বয়সটা একুশের ঘরে থাকলে স্পর্শানুভব কেমন হয়?... এখন আর বলতে পারি না। একুশে ভাবলে হয়ত লজ্জায় লাল হয়ে যেত গাল; কালোতিলের ভেতর ঠেলে দেয়া যেত গালের টোল…। এখন হয়ত হাসির ছলে ফিরে আসে হারানো কান্না। কিন্তু পারিনা। স্পর্শের ভেতর বারবার নিজেকে হত্যা করতে চাচ্ছি; বারবার দেখতে চাচ্ছি প্রাণের ভেতর ঢুকে পড়া ‘কথা ও হাড়ের বেদনা’…
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ৭:৫০