বাংলাদেশ সমবায় আন্দোলনের ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমা :
বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমা আছে । প্রায় ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনকে অগ্রসর হতে হয়েছে। সমবায় শুধু মাত্র একটি উন্নয়ন দর্শনই নয়, এই আন্দোলন আর্থ সামাজিক আন্দোলনও বটে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে এই আন্দোলন চলমান রয়েছে। মানুষের অংশ গ্রহনের মাধ্যমে সমবেত উদ্যোগে আন্দোলনকে যথাযথ সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছ আর্ন্তজাতিক সমবায় এলায়েন্স (International Cooperative Alliance- ICA)। বিশ্বের সকল দেশই যে সমবায় আন্দোলন অত্যন্ত সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে তা-নয়।
ICA এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সফল ৩০০ সমবায়ের মধ্যে স্বপ্লোন্নত বা পিছিয়ে পড়া অর্থনীতির দেশ সমূহের সমবায় প্রতিস্ঠান খুব একটা জায়গা করে নিতে পারেনি । তবে এরপরও ঐসব দেশে সমবায় আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে না।
.............................. ৬৮ তম বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের ইয়োগা সেশন..................................
প্রতিটি দেশের আর্থ- সামাজিক বাস্তবতা, নীতি-কাঠামাে, প্রচলিত সমবায় আইন,নেতৃত্ব, গনমানুষের মানসিকতা ইত্যাদির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তাই সমবায় আন্দোলনের সাফল্য -ব্যর্থতার মধ্যেও দৃশ্যমান পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ সমবায়
আন্দোলনের সাফল্য -ব্যর্থতার মূল্যায়নের জন্য এর ঐতিহাসিক পরিক্রমায় সুর্নিদিষ্ট মাইল ফলক গুলো জানা আবশ্যক।
সন অনুযায়ী সংক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশের সমবায়ের ইতিহাসকে নীচে তুলে ধরা হয়েছে ................
১৯০৪- কো-অপারেটিভ ক্রেডিড সােসাইটিজ এ্যাক্ট প্রনীত হয়।
১৮৭৫- সালে দক্ষিণ ভারেতর বিভিন্ন জায়গায় কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এই বিদ্রোহের মূলে ছিল কৃষি ঋণের অভাব, মহাজনী ঋনের চক্রবৃদ্ধি জনিত উচ্চ সুদের হার, কৃষকদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য । এঘটনার পর ১৯০১ সালে ইন্ডিয়ান ফেমিন কমিশনের সুপারিশ মতে এবং তৎকালীন ভাইসরয় লড কার্জন কর্তৃক গঠিত তিন সদস্যর সুপারিশ অনুসারে ১৯০৪ সালে
কো-অপারেটিভ ক্রেডিড সােসাইটিজ এ্যাক্ট প্রনীত হয় ।
১৯১২- কো-অপারেটিভ ক্রেডিড সােসাইটিজ এ্যাক্ট জারী করা হয়।
১৯০৪ সালে প্রণীত কো-অপারেটিভ ক্রেডিড সােসাইটিজ এ্যাক্ট এর আওতায় কেন্দ্রীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে সমবায় সমিতি গঠনের সুযাগ না থাকায় দ্বি -স্তর এবং ত্রি -স্তর বিশিষ্ঠ সমবায় সমিতি গঠনের লক্ষ্যে কো-অপারেটিভ ক্রেডিড সােসাইটিজ এ্যাক্ট এর পরিবর্তে কো-অপারেটিভ সােসাইটিজ এ্যাক্ট জারী করা হয়।
১৯১৪- ম্যাকলেগান কমিটি গঠন।
ভারতর্বষের কো-অপারেটিভ সমূহের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় উদ্ভাবনের জন্য ১৯১৪ সালে । স্যার এডওয়ার্ড ম্যাকলেগানকে প্রধান করে “ইমপেরিয়াল কমিটি অন কো-অপারেটিভ ইন ইন্ডিয়া” গঠিত হয়। ১৯১৫ সালে ম্যাকলেগান কমিটি সুপারিশ দাখিল করে। এই কমিটির প্রতিবেদনকে ভারতের জন্য “সমবায়ের বাইবেল” হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
১৯১৯- সমবায়কে ভারতর্বষে প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে রুপান্তর করা হয়। প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে রুপান্তরের ফলে বি-কেন্দ্রীকরনের আওতায় বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকার তাদের প্রদেশের জনগনের চাহিদা অনুযায়ী সমবায় আইন ও নিয়মাবলী প্রণয়ন করে।
১৯৪০ - বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সােসাইটিজ এ্যাক্ট প্রণয়ন।
সমবায়কে প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে ঘােষনার পর বঙ্গদেশে বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সােসাইটিজ এ্যাক্ট প্রণয়ন ও কার্যকর করা হয়। এই আইন সমবায় সমিতি গঠন ও পরিচালনার বিষয়ে পরিপূর্ন আইন হওয়ায় ১৯৮৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত আইনের মাধ্যমেই বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন অগ্রসর হয়।
১৯৪২ - সমবায় নিয়মাবলী জারী।
এই অন্চলে প্রণীত প্রথম সমবায় নিয়মাবলী। মূলত বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সােসাইটিজ এ্যাক্ট ১৯৪০ সালে এর সমর্থনে ১৯৪২ সালে সমবায় নিয়মাবলী জারী করা হয়।
১৯৫৬- কুমিল্লার কােটবাড়ীতে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী স্হাপিত হয়।
ডঃ আখতার হামিদ খান সমবায় সংক্রান্ত প্রায়োগিক গবেষনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। ( বর্তমানে বাংলাদেশ একাডেমী রুরাল ডেভেলপমেন্ট হিসেবে পরিচিত।)
১৯৫৮- পাকিস্হান স্টেট বাংক এ অন্চলের সমবায় প্রতিষ্ঠানকে কৃষিঋণ দেয়া শুরু করে।
১৯৫৯ - ডঃ আখতার হামিদ খান উদ্ভাবিত দ্বি-স্তর ভিত্তিক সমবায় কাঠামাে কুমিল্লা পদ্ধতি এর পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু ।
১৯৬০- সমবায় অধিদপ্তর হতে মাসিক ‘সমবায়’ এবং ইংরেজী সন্মাসিক “কো-অপারেশন” পত্রিকা দ্বয়ের প্রকাশনা শুরু হয়। ১৯৬০ সালে ঢাকার গ্রীন রােডে বাংলাদেশ সমবায় কলেজ স্হাপিত হয়।
১৯৬১- বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্হান সমবায় ইউনিয়ন) আর্ন্তজাতিক সমবায় সংস্হার সদস্য ভূক্ত হয়।
১৯৬২ - প্রথম বারের মত “জাতীয় সমবায় নীতিমালা” গৃহীত ও প্রচারিত হয়। ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ সমবায় কলেজ গ্রীন রােড হতে কুমিল্লার কােটবাড়ীতে স্হানান্তরিত হয়।
১৯৭২- গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে “সমবায়” কে সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে একটি পৃথক (২য়) খাত হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করা হয়।
১৯৭২-৭৩ উক্ত অর্থ বৎসরে কুমিল্লা দ্বি-স্তর সমবায় পদ্বতির সম্প্রসারন কাজ সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচী দেশের বিভিন্ন থানায় বাস্তবায়ন আরম্ভ করা হয়।
১৯৭৩- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের চাহিদা পূরণের জন্য সমবায়ের ভিত্তিতে দুগ্ধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপননের লক্ষ্যে মিল্কভিটা প্রতিষ্ঠা করেন।
... সমবায় খাতে একটি সফল দুগ্ধ খামারীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান,যা থেকে প্রায় ১৮টি পণ্য বাজারে বিক্রয় হয় ।....
১৯৮২- সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীকে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বাের্ড নামে রুপান্তর করা হয়।
১৯৮৪- বাংলাদেশে ১ম বারের মত সমবায় অধ্যাদেশ জারী করা হয়। ১৯৪০ সালের সমবায় আইনকে সময় উপযাগী করে সামরিক সরকার কর্তক সমবায় অধ্যাদেশ জারী করা হয়।
১৯৮৭- সমবায় অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর সমর্থনে সমবায় নিয়মাবলী প্রর্বতন করা হয়।
১৯৮৯- স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সমবায় নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়।
২০০১- প্রথমবারের মত বাংলায় সমবায় আইন জারী করা হয়।
২০০২- সমবায় আইন ২০০১ এর কতিপয় ধারা সংশােধন করে সমবায় সমিতি (সংশােধন) আইন ২০০২ জারী করা হয়।
২০০৪- সমবায় আইন ২০০১ এবং সংশােধিত আই্ন ২০০২ এর সমর্থনে ২০০৪ সালে সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ জারী করা হয়।
২০১২-দারিদ্র মুক্ত আত্ন -নির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ায় সমবায়ী উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান এবং গণমুখী সমবায় আন্দোলনের দিক নির্দেশনার প্রয়ােজনে ১৯৮৯ সালে প্রণীত সমবায়নীতিকে যুগােপযােগী করে “জাতীয় সমবায় নীতি ২০১২” প্রণয়ন করা হয়।
২০১৩- সমবায় আইন ২০০১ কে অধিকতর সংশােধন করে সংশােধিত সমবায় আইন ২০১৩ জারী করা হয়।
বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কয়েকটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হয় যে : ................
(ক) এ অঞ্চলে সমবায় নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে, ফলে সমবায় আইন ও বিধি সুস্হিতি পায়নি।
(খ) সমবায় আন্দোলনকে বাস্তবায়নের জন্য সমান্তরাল একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাে তৈরী করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে সাধারণ সমবায়ীরা বিভ্রান্ত হয়েছে।
(গ) সমবায় সাফল্যের অন্যতম হাতিয়ার হ’ল “প্রশিক্ষণ”। কিন্ত তৃণমূলের সমবায়ীদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য সু-সংগঠিত প্রশিক্ষণ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল সীমিত।
(ঘ) সমবায় আইন ও বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক সমস্যা সমাধানকে প্রাধান্য দেয়া হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সমবায় আন্দোলনকে ধারাবাহিক সাফল্যের লক্ষ্যে পৌঁছানাের বিষয়টি অনেকাংশে উপেক্ষিত হয়েছে।
(ঙ) পল্লী উন্নয়ন নিয়ে গবেষণার জন্য স্বতন্ত্র দুটি জাতীয় ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও এদের মাধ্যমে সমবায় আন্দোলনের প্রায়ােগিক গবেষনার কাজ খুব একটা হয়নি । অনদিকে সমবায়কে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র গবেষনা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এখনও এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি।
(চ) সমবায়কে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে মালিকানার ২য় খাত হিসেবে স্হান দেয়া হয়েছে। কিন্ত সে অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন সেক্টরাল (খাত) নীতিমালায় (যেমন শিল্পনীতি, কৃষিনীতি,শ্রমনীতি ইত্যাদি) সমবায়কে অধিকতর গুরত্ব দিয়ে অর্ন্তভূক্ত করার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়নি।
........................... সমবায়ীদের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা .............................................
(ছ) সমবায়কে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করতে হয়, কিন্ত সমবায় আইন ও বিধি সেক্টরাল ভিত্তিক না হওয়ায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সেক্টর ভিত্তিক সমবায় আইন ও বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে অনেক দেশ ইতিমধ্যে দ্রুত সাফল্য পেয়েছে।
বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা অতি আবশ্যক।
তথ্য সূত্র : সমবায় তথ্য বাতায়ন, ঢাকা ।
( লেখাটির সুত্রপাত শ্রদ্বেয় ব্লগার চাঁদগাজী ও অন্যান্য ব্লগার এই বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন, তাই কর্তৃপক্ষর নিকট অনুরোধ
যেন অধিক সংখ্যক ব্লগার বিষয়টি প্রথম থেকে পড়তে পারেন এবং বুঝে শুনে অতপর সমবায় ব্যবসা করতে আগ্রহী হবেন। )
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৭