রি-পোস্টঃ একটি সন্ধ্যার পুনরাবৃত্তি (ছোট গল্প)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
উদাস চোখে সামনের একতলা বাড়িটার দিকে চেয়ে আছে বাবু। দুইটা শালিক নিজেদের মধ্যে খাবার নিয়ে ঝগড়া করছে। বাবু মনে হয় ওদের ভাষা বুঝতে পারছে। পাখিদের কথা গুলো মৃদু হয়ে বাজছে যেন ওর কানে। পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও ওদের ভাষাতে যে কোনও কাঠিন্য নেই বাবু সেটা জানে। হঠাৎ করেই ওদের ঝগড়াতে বাঁধা পরলো। এই অস্বাভাবিক বাঁধা আশা করেনি পাখি দুইটা তাই খাবার এর মায়া ত্যাগ করেই উড়ে যেতে হলো তাদের।
বাধার কারণ একটা মেয়ে। বাবু ওঁকে চেনেনা। চিনবে কিভাবে? ও তো এখানে নতুন। বাবুর ইচ্ছা করছিল ওঁকে ডেকে ওর নাম জিজ্ঞাসা করতে। কিন্তু সাহস পেল না। যদি কিছু মনে করে। এভাবে ওঁকে দেখতেই ভাল লাগছে বাবুর। বাতাসের মুহুর্মুহু আক্রমণে ওর চুলগুলো যেন এলোমেলো ভাবে উড়ে যেতে চাইছে। বিকালের মিষ্টি রোদ যেন ছুঁয়ে যেতে চাইছে ওঁকে। নিজে নিজে ও যেন কিছু বলছে। বাবু কিন্তু ওর মনের কথা বুঝতে পারছে না। আসলেই মানুষের মনের ভাষা বোঝা অনেক কঠিন। এই ভাষা পাখিদের ভাষার মত সহজ না। পাখিরা কখনও দুর্ভেদ্য কাজও করে না এবং দুর্ভেদ্য কথাও বলে না। মেয়েটি কি কাঁদছে ?মনে মনে ভাবলো বাবু। পড়ন্ত বিকালে উন্মুক্ত ছাদে কি একটা মেয়ের কান্না শোভা পায়। আসলেই মেয়েটি কাঁদছে। কষ্টের চিহ্ন ফুটে উঠেছে ওর চোখেমুখে। নিশ্চয়ই ওর খুব দুঃখ হচ্ছে। বাবু ওর দুঃখ বোঝার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। পারবে কি করে সেই ভাষা তো বড় কঠিন।
মেয়েটি হয়তো ভাবতে পারছে না যে জানালা দিয়ে একটা ছেলে তার দিকে চেয়ে আছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে এখন। আবছা আলোতে মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট। কিন্তু ওর চোখগুলো এখনও জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ মেয়েটা যেন বাবুর জানালার দিকে তাকালো।
একটা হাত যেন বাবুর ঘাড় স্পর্শ করলো। হাতটা যে তার বাবার বাবু সেটা জানে। বহুদিন ধরে এই স্পর্শের সাথে পরিচিত সে। অন্যদের স্পর্শ থেকে বাবার হাতের স্পর্শ অন্যরকম মনে হয় বাবুর কাছে। কেমন যেন কমল স্নেহময়। দেহের সব রক্তকনা যেন সতেজ হয়ে উঠে এই স্পর্শে।
-কি কর বাবু?
- স্বাধীনতা দেখি বাবা। আর দেখি স্বাধীনতার কষ্ট।
- বাইরে তো অন্ধকার। স্বাধীনতা তো অন্ধকার না স্বাধীনতা হল আলো। স্বাধীনতা দেখতে হলে আলোতে এসো।
বাবুর চোখ যেন ভিজে আসতে চায়। তবুও ও সেটা ওর বাবাকে বুঝতে দেয় না। বাবার হাত ধরে ধীরেধীরে নিচে নেমে যায় বাবু।
বাবুকে ওর বাবা কখনই ছোট বাচ্চা মনে করে না। সব সময় ওর সাথে এমন ভাবে কথা বলে যেন কোনও ধিরস্থির বুদ্ধিদীপ্ত মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে কথা বলছে। ছোটবেলা যেদিন ওর মা মারা যায় সেদিন থেকে ওর বাবা কখনও ওর মা এর অভাব বুঝতে দেয় নি। তখন থেকে ওর বাবাই ওর মা ওর বাবাই ওর স্বপ্ন। বাবা যদি ওর সাথে থাকে তাহলে ওর আর কোনও চিন্তা নাই। কিন্তু বাবা ছাড়া ওর পৃথিবী ফাঁকা শুন্য......।
নিচতলায় সোফাতে বসে আছে মামা আর মামী। তারা যে কথা গুলো বলছিল দোতলা থেকে অল্প অল্প শোনা যাচ্ছিলো। এখন সবখানেই আলোচনার বিষয়বস্তু এক আর সেটা হল স্বাধীনতা। নিচতলা তে নেমে আসলে মামা বাবু কে জিজ্ঞাসা করলো।
• কি করছিলি একা ঘরে বসে?
• ‘স্বপ্ন দেখছিলো’ উত্তর দেয় বাবুর বাবা।
• ‘ তুই বসে বসেও স্বপ্ন দেখিস? ’ হাঁসতে হাঁসতে জিজ্ঞাসা করে মামা।
• ‘ ঘর ছাড়া একটা ছেলে স্বপ্ন ছাড়া আর কি দেখতে পারে?’ বাবু ত্বরিত উত্তর দেয়।
মামা এই উত্তর আশা করে নি। আসলেই ওরা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
মামী বাবু কে কাছে টেনে নিয়ে মামাকে বলে অযথা ওঁকে কষ্ট দিচ্ছ কেন? দুপুরে খাওয়া হয় নি বাবুর। মামী ওঁকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করে। মামী বাবু কে অনেক ভালবাসে। নিয়মিত খাওয়া ঘুমানোর খোঁজ রাখে। কখনও রাত জেগে পড়লে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যান । এটা কি মায়ের আদরের মত? ‘হয়তবা’ মনে মনে উত্তর দেয় বাবু। মা হারা একটা অনাথ ছেলে এর থেকে বেশি কি আশা করতে পারে ?
মামা বাবাকে বলে পাশের বাড়ির শফিক ভাই এর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খুবই ভাল লোক ছিলেন । উনি ছিলেন উকিল, হাইকোর্টে প্রাকটিস করতেন। কিন্তু গত রাতে একজন লোক ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আর ফিরে আসেননি। হয়ত রাজাকারেরা তাকে মেরে ফেলেছে। এখনও খোঁজ চলছে ।
বাবু ওর মামীকে ছাদের মেয়েটার কথা বলে। মামী বলেন ওর নাম ঊর্মি শফিক ভাইয়ের ছোট মেয়ে। বাবার এই অস্বাভাবিক প্রস্থান হয়ত মেনে নিতে পারেনি তাই ছাদে কাঁদছিল মনে মনে ভাবে বাবু। একটা হৃদয় কত আঘাত সহ্য করতে পারে। বাবাকে হারানোর মত কষ্ট বাবু ভাবতে পারে না। মন খারাপ হয়ে যায় বাবুর। ঊর্মিকে বাবু চেনে না তবুও ওর জন্য বাবুর অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কেন হচ্ছে ও আসলেই জানে না। বিকালে কি ঊর্মি ওঁকে দেখতে পেয়েছিল?
বাবা আর মামার মধ্যে ভারি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাবুর কিছুই শুনতে ইচ্ছা করছে না। মন আসলেই খারাপ হয়ে গেছে। রাজাকারেরা এতো নিষ্ঠুর ভাবতে পারে না বাবু। এতো নিষ্ঠুরতার শাস্তি ওরা একদিন পাবেই মনে মনে ভাবে বাবু। মামী বাবুর মন খারাপ বুঝতে পেরে ওঁকে খাবার টেবিলে নিয়ে গেল। খেতে খেতে বাবু ওর মামীকে ঊর্মির পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করে। ঊর্মি ওর মা আর বড়বোনের সাথে কালকেই ওদের গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে । বাবুর অবুঝ প্রশ্ন ‘ ঊর্মির মা অনেক ভাল তাই না মামী?’ ‘হ্যাঁ’ ছোট উত্তর দেয় মামী। চোখে জল চলে আসে বাবুর। ওর মা ও নিশ্চয়ই ঊর্মির মায়ের মত ভাল ছিল। কিন্তু তিনি তো আজ বেঁচে নেই। ওর মায়ের কোনো সৃতিও নাই ওর কাছে। একটা ছবি আছে ওর বাবার কাছে। আজ অনেকদিন পর আবার ছবিটা দেখতে ইচ্ছা করছে বাবুর। খাওয়া শেষ করে রুম এ চলে আসে বাবু। অনেক খুজে ওর মায়ের ছবিটা বের করে। মা যেন নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে বাবুর দিকে । কি স্নিগ্ধ দৃষ্টি! চোখ ভিজে আসে বাবুর। অন্ধকারে ঊর্মিদের ছাদের দিকে তাকায় বাবু। কখন যে বাবুকে ঘুম তাঁর কোলে টেনে নেয় বুঝতে পারে না ও ।
সকালবেলা মামীর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে বাবুর। মামীর চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। ‘কি হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা করে বাবু। মামী শব্দ করে কেঁদে ওঠেন। বলেন কাল রাতে ওরা তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে গেছে, তোর বাবা আর ফিরে আসেনি। বাবু যেন কিছু বুঝে উঠতে পারে না । সে কি স্বপ্ন দেখছে? আবার চোখ বুজে আসতে চায় ওর। মামী বলে ‘তোর মামা তোর বাবাকে খুঁজতে গেছে সেই ভোরে সেও তো আর ফিরে আসেনি।’ বাবু চোখ মেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর মামীর দিকে যেন কিছুই বুঝতে পারে নি ও । হঠাৎ ওর চোখ ছলছল করে ওঠে। এতক্ষন পর ও বলে ওঠে, ‘ বাবা!!!!! বাবা কোথায় গেছে?’ মামী কেঁদে ওঠে। বিছানা ছেড়ে এক লাফ দিয়ে নিচে নামে বাবু। সিঁড়ি দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে নামে ও। মাথা যেন ভনভন করে ঘুরছে। পা যেন অবশ হয়ে আসতে থাকে ওর। চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। তবুও প্রাণপণে ছুটতে চায় ও। বাবা কে যেকোনো ভাবেই ফিরিয়ে আনতে হবে। তারপর আর কিছু মনে নেই বাবুর।
ওর জ্ঞান ফেরে সন্ধ্যার সময়। চোখ খুলে ও দেখে মামা মামী ওর দিকে চেয়ে আছে । আর একটা মুখ খুজে ফেরে বাবুর কৌতূহলী চোখ। অজানা আশায় চোখ খুলে বাবু জিজ্ঞাসা করে , ‘মামা, বাবা কি ফিরেছে?’ মামার চোখ জলে ভরে ওঠে। বাবুর আর বুঝতে বাকি থাকে না তাঁর বাবার ভাগ্যে কি ঘটেছে। বাবুর যেন বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় ঝরছে অশ্রু। বাবুর মনে হয় ওর হৃৎপিণ্ড কাজ করছে না। ধীরে ধীরে ও ছাদে উঠে আসে । আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন। বাবুর দুঃখে তারাও আজ বাথিত। ঊর্মিদের বাসার সামনে একটা ভ্যান দাড়িয়ে আছে। ওরা এখন চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজেকে এখন একটা ঘর ছাড়া দল হারানো একটা পাখির বাচ্চার মত মনে হচ্ছে বাবুর। একটা ছায়া ছাড়া যার আর কেউ নেই। ঊর্মি ওর বোন আর মায়ের সাথে ভ্যানে উঠে পড়েছে। সামনের রাস্তা ধরে ওরা এগিয়ে গেল। ধীরে ধীরে অদৃশ্য হল বাড়িগুলোর আড়ালে। অন্ধকার নামতে শুরু করেছে আকাশ জুড়ে। বাবার কথা মনে হল বাবুর। “ স্বাধীনতা অন্ধকার না স্বাধীনতা আলো” চোখ ভিজিয়ে কান্না এল ওর। অনেকক্ষণ কাঁদল বাবু। প্রকৃতির বাস্তবতাকে মেনে নিতে অক্ষম ছেলেটির কান্নার জল যেন শুষে নেয় রাতের অন্ধকার। উপরে চোখ মেলে তাকায় বাবু। আবছা অন্ধকারে ওর বাবার মুখটা ফুটে উঠলো। অদূরের কোনও জানালা দিয়ে কেউ হয়ত ওর দুঃখের সাক্ষী হয়ে রইল। ওর বাবার মুখটা যেন আরও সাদা হয়ে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে ওর বাবার মুখটা স্পর্শ করার চেষ্টা করে বাবু।
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সত্যি বলছি, চাইবো না
সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্থান.....
শেখস্থান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন