কথাশিল্পী শওকত আলীর জন্ম ১৯৩৬ সালে। জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে। দেশভাগের চার বছর পর তাঁর চিকিৎসক পিতা সপরিবারে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। থিতু হন দিনাজপুরে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত পিঙ্গল আকাশ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এরপর প্রকাশিত হয়েছে দুটি ছোটগল্প সংকলন। বাংলা ছোটগল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৬৮ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ২১শে পদকে ভূষিত হন। নৃতত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসে তাঁর আগ্রহ অত্যন্ত গভীর। বাংলার প্রায় লুপ্ত ও ঝাপসা হয়ে যাওয়া ইতিহাসে তাঁর সৃজনশীল অনুসন্ধান আমাদের সাহিত্যকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রন্থের মধ্যে রয়েছে প্রদোষে প্রকৃতজন, যাত্রা, ওয়ারিশ, দলিল, দক্ষিণায়নের দিন, উত্তরের খেপ প্রভৃতি।
এই সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি, বেড়ে ওঠা, রাজনীতি, স্বদেশ ভাবনাসহ তাঁর রচনাকর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন।
মাহমুদ শাওন: আপনার জীবনে আপনার মায়ের প্রভাবের কথা প্রায়ই বলে থাকেন। ওনার সম্পর্কে জানতে চাইছি।
শওকত আলী: তার আগে পশ্চাৎপটটা একটু বলতে হবে। মার মুখ থেকে শুনেছি। আমার মা মাতৃহারা হয়েছিলেন অল্প বয়সে। ওনার বাবা ছিলেন, বড় ভাইরা ছিলেন, কাজের লোকেরা ছিলেনজ্জতারাই তাকে মানুষ করেছে। শহর থেকে অনেক দূরে, এমনকি থানা শহর থেকেও অনেক দূরে, সেখানে শহরের মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা ছিলেন না। আমার বড় মামা স্কুলের হেড পণ্ডিত ছিলেন। তাদের অনেক জমিজমা ছিল, তবু তিনি পণ্ডিতগিরি করতেন। আমার মা বাড়িতে বসে বসেই পড়াশোনা করতেন আর কী। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছেন, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন। আর ওদিকে আমার বাবার খেয়ালিপনা ছিল। তিনি বেশ বইপত্র পড়তেন। ইংরেজি ভালো জানতেন, বাংলা তো জানতেনই। কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ভালো ভাবেই। বাবা আবার সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছিলেন। সেজন্য তার বিয়ের বয়স পার হয়ে গিয়েছিল। ফলে বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন। তখন বয়স্ক মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না! বাবাদের বাড়িতে যে ডাক্তার ছিলেন জগদিশ চন্দ্র বসু, পাশেই তার সরকারী ডিসপেনসারি ছিল। তিনি ডাকসাইটে ডাক্তার ছিলেন। সাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। তো তিনি বাবাকে বললেন, ‘একটা মেয়ে পাওয়া গেছে, বয়স বেশি। এখনও বিয়ে হয়নি।’ বাবা শুধু বললেন, ‘লেখাপড়া জানে তো?’ ডাক্তার বাবু বললেন, ‘হ্যা, জানে তো!’ এরপর বিয়ে হয়ে গেলো। মা তো নেই। ভাবিরাই আমার মাকে সাজিয়ে গুজিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠালো। বাবার বন্ধুরা ছিল আশপাশের হিন্দু পরিবার। তাদের বউরা এলো। তারা শিতি। তখন কাপড়-চোপড় গয়নাগাটি দেখে তারা নানারকম কটুক্তি করতে লাগলো। যেমন- ‘বউদি এটা কী পড়েছেন! ছি ছি ছি এভাবে কেউ কাপড় পরে না-কি! মাথার ঘোমটাটা এভাবে দেয় না-কি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো বউদি লেখাপড়া জানেন তো!’ মা ঘোমটা অবস্থাতেই মাথা নাড়লেন। একজন ভদ্র মহিলা অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী তুমি লেখাপড়া জানো না!’ তারপর বাবাকে গিয়ে বললেন, ‘তুমি কী মেয়ে বিয়ে করলে?’ এরপর তারা চলে গেলো। বাবাতো রেগে-মেগে বলতে লাগলেন, আমাকে ঠকিয়েছে, অমুক করেছে তমুক করেছে। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। বিয়ের দান-টান, উপহার যা পেয়েছিলেন সেসব উঠোনের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে, রাত্তির বেলা, বৃষ্টির মধ্যে বাবা উধাও! এদিকে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে আবার বাপের বাড়িতে জামাইসহ যেতে হয়। মা’র সঙ্গে এসেছিলেন তার দাদী আর আমার বড় মামার ছেলে। পরদিন সারাদিন তারা বাবার জন্য অপো করলো। আসে না। এরপর সন্ধ্যে হয়ে আসছে যখন তখন আমার মা-ই তার শ্বাশুড়িকে বললেন, ‘মা, আপনার ছেলে তো এলো না। আমার দাদী অসুস্থ মানুষ। আমি যাচ্ছি।’ তারা গরুর গাড়িতে করে এসেছিল, গরুর গাড়িতে করে চলে গেলো। আমার দাদা তো খুব রেগে গেছেন বাবার ওপর। সন্ধ্যার পর কোত্থেকে কোত্থেকে বাবা এসেছে। উঠোনের কাদার মধ্যে জিনিসপত্র সব ছড়ানো-ছিটানো। বাক্স-টাক্স কাদায় মাখানো। বাবা হইচই করছে, হ্যা এইসব কেউ উঠোয়নি। তখন দাদা বললেন, অন্যরা ওঠাবে কেন? তুমি ফেলেছো তুমি ওঠাও। বাবা ঐসব তুলতে গিয়ে দেখে- বই! বইয়ে লেখা- ‘এই বইয়ের মালিক মোছাম্মৎ সেলেমা খাতুন’। যে বই উল্টায় সেখানেই ঐ কথা লেখা। সেখানে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের বইসহ আরও অনেক বই ছিল। বাবা বইগুলো দেখলেন। তারপর রাত্তিরবেলা বই খুলে দেখেন বিভিন্ন পাতায় লেখার নীচে দাগকাটা। এসব দেখে রাত ভোর হওয়ার আগেই বাবা মাকে আনার জন্য ঘোড়ায় চড়ে শ্বশুর বাড়ি রওনা হলেন।
তারপর তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হলো। কিন্তু তখনও পাশের বাড়ির বৌদিদের মাকে ছোট ভাবার বিষয়টা ছিল। আমার মা তখন বাবাকে বললেন, ‘আমি ইংরেজি শিখব। আমাকে ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা করে দাও।’ খ্রিস্টান মিশনারিজের একজন মহিলা পাদ্রি এসে এসে মাকে ইংরেজি শেখাতে লাগলেন। এভাবে মা কিছুটা ইংরেজি শিখেছিলেন। পরে টেক্সটাইল ইন্সটিটিউটে শিক্ষার্থী নেয়া হবে বলে একটা বিজ্ঞাপন বেরলো। তখন সারা ভারতবর্ষে দু’টো টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট ছিল। একটা ইউপিসিপির ঐদিকে আর একটা শ্রীরামপুরে। যেখানে উইলিয়াম কেরী এসেছিলেন। মা সেই কলেজে ভর্তি হলেন। তখন কিন্তু আমরা ছেলেমেয়ে হয়ে গেছি পাঁচজন। সেটা ১৯৩৯ সাল। ১৯৪২ সালে মা’র ডিপ্লোমা কোর্স শেষ হলো, ডিগ্রীতে ভর্তি হবেন- তখন কলকাতায় বোম পড়া শুরু হলো। আমরা ফিরে গেলাম আমার দাদাবাড়ি উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ। এখন যেটি ভারতের উত্তর দিনাজপুরের একটি জেলা। একথা বলছি এ কারণে, আমাদের বাড়ির ভেতরে লেখাপড়ার চর্চাটা ছিল। বাবারও সাহিত্য প্রীতির ঝোঁক ছিল। রাজনীতি সচেতনতা তো ছিলই। তিনি একবার ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলন যখন শুরু হয়ে গেলো মা কিন্তু পাকিস্তানের পে ছিলেন। তিনি মেয়েদের সংগঠন করতেন। বাবা কংগ্রেস করতেন, মা মুসলীমলীগ! এসময় ঢাকা থেকে যে সব তরুণরা আসত, তারা দেখতে যেত একই বাড়িতে কংগ্রেসের ক্যাম্প আছে আবার মুসলীমলীগের ক্যাম্প আছে। এ কথাটি আমি অনেক পরে শুনেছিলাম চারণ সাংবাদিক এম আর আকতার মুকুল ভাইয়ের কাছে, ইত্তেফাকের অফিসে বসে। পরে মা স্কুল টিচার হন আর বাবা তো হোমিওপ্যাথী ডাক্তার- এইচএমবি।
মাহমুদ শাওন: দেশ ভাগের পর আপনার মা তো এখানে আসতে চাননি। কেন?
শওকত আলী: পাকিস্তান যখন হয়ে গেলো অর্থাৎ ৪৭’র পরে বাবা মাকে বলতেন, ‘কী হলো, তোমার পাকিস্তান তো হয়ে গেলো। যাবে না, পাকিস্তান যাবে না!’ মা বলতেন, ‘হ্যা যাব, যখন সময় হবে তখন যাব।’ এরপর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তার ক্যান্সার হয়েছিল। ৪৮ সালে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার আগে, ঐ সময় জিন্নাহ যখন এসে ঘোষণা দেনজ্জউর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। রেডিওতে এটি খুব প্রচার হয়েছিল, তখন মা ঐটি শুনেছিলেন। ঐ কথা শোনার পর মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি আমাদের সব ভাইবোনদের ডেকে তার মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন যে, ‘ঐ পাকিস্তানে তোরা যাবি না।’ যে পাকিস্তানের জন্য তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন, সেই পাকিস্তানে যেতেই তিনি আমাদের নিষেধ করেছেন। এটা খুব উল্লেখযোগ্য, যে পাকিস্তান চেয়েছিল বাংলার মুসলমানেরা তা ঐ ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানোর জন্য নয়। তারা ছিল সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত। কাশ টেন-এ আঠার-কুড়ি জন পরিক্ষার্থী তার মধ্যে ২/১ জন মুসলমান। আমি ১৯৫১ সালে মেট্রিক পাস করেছি, তিনজন ছেলে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল- তার মধ্যে আমি একজন। তো তখন আশপাশ থেকে মহিলারা দেখতে এসে বলেছিল, ‘দেখি দেখি মুসলার ছেলে কী রকম করে ফার্স্ট ডিভিশন পায়!’ এরকম একটা অবস্থা ছিল যে সোসাইটিতে, সোসাইটির সে অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই সাধারণ মুসলমানেরা পাকিস্তানের প নিয়ে ছিল। এসব কথা কোনও আলোচনায় আসে না।
মাহমুদ শাওন: পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন কোন্ সালে?
শওকত আলী: পরে ওখানে আমাদের নানারকম অসুবিধা হয়েছিল। ফলে চলে আসতে হলো। আমার বাবাই তখন আমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বয়স তখন পনর/ষোল। সদ্য মেট্রিক পাশ করেছি। ১৯৫১ সাল। এসে ভর্তি হয়েছিলাম দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। তখন সেই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন জি সি দেব (গোবিন্দ চন্দ্র দেব)। বাবা ওখান থেকে আসবেন না বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবাকেও আসতে হয়েছিল। যদি তিনি না আসতেন তাহলে মারা পড়তেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সবাইকে ওখানে পাঠিয়ে বাবা একাই ছিলেন দিনাজপুরে। আশেপাশের সবাই চলে যাচ্ছে বর্ডার ক্রস করে, কিন্তু বাবা গেলেন না। আমার এক ছোট ভাই ছিল। বাবা এখানে এসে আর একটি বিয়ে করেছিলেন। সে-ই পরে ছোট ভাই। ১৪ এপ্রিল তাকে খোঁজার জন্য বাবা বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন এবং তখন পাকিস্তান আর্মিরা বাবাকে গুলি করে। তিনি শহীদ হন। আমার ভাই-বোন, স্টেপ মাদার সবাই গেলেন, কিন্তু বাবা গেলেন না। কেন গেলেন না! তিনি এখানেই শহীদ হয়েছেন। পরে অবশ্য তাকে শহীদ বলে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তার নামে একটি ডাকটিকিটও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
মাহমুদ শাওন: এই যে আপনার জন্মভূমি বা জন্মস্থান ছেড়ে চলে আসা, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি-এসব মনে পড়লে কেমন লাগে?
শওকত আলী: এসব কথা আমার লেখার মধ্যে আছে। ঐ দিনগুলোর কথা আমার স্মরণে আসে। ওয়ারিশ নামে আমার একটা উপন্যাস আছে, সেখানে এই বিষয়গুলো এসেছে। দলিল নামে আর একটি উপন্যাসেও কিছু কিছু আছে। আমি যদি বড় লেখক বা ভালো লেখক হতে পারতাম তাহলে হয়তো আরও ভালোভাবে আসতো।
আমাদের বাসায় গরু রান্না হতো না। তখন ঈদের দিনে আমার বড় ভাইয়ের হিন্দু বন্ধুরা অনেক রাতে, লুকিয়ে আমাদের বাসায় আসতো মুরগা-মুসাল্লাম খেতে। ওরা মুসাল্লাম বলতে পারতো না, বলতো মুরগীর মুসলমান (হা হা হা)। ওখানকার বন্ধুদের ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। পরবর্তীতে বি.এ পাশ করার পর ১৯৫৬ সালে আমি যখন ওখানে গিয়েছিলাম, তখন ওরা আমাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। খুব আদর করে রেখেছিল আমাকে। তবে দেশভাগের ফলে যে জাগরণ এখানে ঘটেছে, অর্থাৎ বাঙালি যে আলাদা জাতি, তাদের জাতীয়তার জাগরণটা এখানে ঘটেছে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যে সম্পর্ক ইংরেজ শাসনের সময় কলকাতা রাজধানী হওয়ার পর থেকে ছিল, তাতে তো একশ’ বছর আগে থেকেই তারা বিলেত আসা-যাওয়া করছে। জাতীয়তা কাকে বলে, জাতি-রাষ্ট্র কাকে বলে তা তো তারা জানে। কিন্তু বাঙালির আশা-আকাক্সা, ঐতিহ্য নিয়ে যে জাতীয়তা এই চেতনার জাগরণ এখানেই হয়েছে। এটাকে শুধু মুসলমান বাঙালির বিকাশ বললে ভুল হবে। এটি স্বতন্ত্রভাবে টোটাল বাঙালির জাতীয়তার বিকাশ। ৭১’ সালের কথাই ধর। তখন এখানে মানুষ ছিল ৭ কোটি। এখন তার দ্বিগুণ। কিন্তু দুর্ভি হয়েছিল ৭৪’ সালে। এরপর আর দুর্ভি হয়নি। অথচ মানুষ বেড়েছে। খাদ্যের চাহিদা বেড়েছে। এই খাদ্য উৎপাদন করেছে কারা? এই দেশের সাধারণ বাঙালিরাই। আধুনিক বিশ্ব থেকে আমরা কি খুব পিছিয়ে আছি? আমার মনে হয়- না। এখন নানা ষড়যন্ত্র করে আমাদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল ছিল আমাদের। অথচ তা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ডারের ওপারে গড়ে উঠছে নতুন নতুন পাটকল। আমাদের চিনিকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অথচ একসময় আমরা চিনি রপ্তানি করতাম। এতকিছুর পরও আমাদের ফরেন একচেঞ্জ কিন্তু কমেনি। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে আমাদের লোকজন। কিংবা শিক্ষার কথা যদি বলি, শিল্পসাহিত্যের কথা যদি বলি তাহলে আমরা কি খুব পিছিয়ে আছি? জাতির চেতনার বিকাশ তো রুদ্ধ করে রাখা যায়নি। বাংলাদেশের লোক হিসেবে, বাঙালি হিসেবে আমি অনেক গর্বিত।
মাহমুদ শাওন: একটা সময় আপনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। জেলও খেটেছেন। তো রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াটা কি পারিবারিক কারণে?
শওকত আলী: রাজনীতি সচেতনতা আমাদের বাড়িতে ছিল। ওখান থেকে আসার পরে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে, ততদিনে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়ে গেছে, ১৯৫৪ সালে আমি দিনাজপুরেই বি.এ কাশে ভর্তি হই। টিউশনি করি। তখন দিনাজপুরেই ছাত্র ইউনিয়নের একটি শাখা খোলা হয়েছে। আমি ওখানে যুক্ত হই। যুক্ত হওয়া মানে ভালোভাবেই সক্রিয় থাকা। তখন বাদল (মোহাম্মদ ফরহাদ) আমার এক কাশ নিচে পড়তো। পরবর্তীতে বাদল ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হয়েছিল। তো ১৯৫৪ সালে নির্বাচন হয়েছিল। সে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জিতল। প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠনও করা হলো। কিন্তু ৯২-এর ক ধারা জারি করে নির্বাচন বাতিল করা হলো। তারপর শুরু হলো ধড়পাকড়। অনেকেই পালালো। আমি ধরা পড়ে গেলাম। আট-নয় মাসের মতো জেলে ছিলাম। জেলে অনেকেই ছিল- যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাদলও ছিল। জেলে বসে কবিতা লিখেছি।
মাহমুদ শাওন: আপনার লেখালেখির শুরুটা কি ওখানেই হয়?
শওকত আলী: না না। বাড়িতেই লিখেছি। কবিতা লিখে লুকিয়ে রাখতাম। ছাপতাম না। যখন কলেজে ভর্তি হয়েছি তখন এ্যানুয়াল একটা প্রতিযোগিতা হতো। তো বন্ধুরা বললো তুইও দে। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রবন্ধ জমা দিলাম এবং প্রথম হলাম। জেলে কবিতা লিখে বন্ধুদের শুনিয়েছি। আর গল্প লেখা শুরু করেছি জেল থেকে বেরিয়ে। সেগুলো ঢাকা-কলকাতার পত্রিকায় ছাপা হলো। তারপর ঢাকায় যখন এম এ পড়তে এলাম তখন অনেক তরুণ লেখক কবিদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এভাবেই লেখালেখি শুরু আর কী।
মাহমুদ শাওন: আপনার যাত্রা উপন্যাসে দেখি ২৭ মার্চ দলে দলে মানুষ পালিয়ে গেল। এবং সেই পলায়ন শুধু চেতনাগত নয়, মানসিকভাবেও পলায়ন। এবং এক সময় তারা আবার পিছন ফিরে তাকালো...এই যে তাকানো...এর মধ্য দিয়ে কোন বিশেষ দিক কি চিহ্নিত করতে চেয়েছেন?
শওকত আলী: প্রথম যেটা পলায়ন সেটা প্রাণ রার্থে। জীবন বাঁচানোর জন্য। সেটা জীব মাত্রই করবে। সেটা কাক-পাখি হোক আর মানুষ হোক। পলায়ন করার পরে যখন সে দাঁড়াবে তখন পুরনো সবকিছুকে ফেলে দেবে কি সে? প্রথমত নিজেকে বাঁচাবে, নিজের সম্পদ, উত্তারাধিকারকে রা করার জন্য, পুনরুদ্ধার করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা সে করবে। ঢাকা শহর থেকে যারা চলে গিয়েছিল, এমন কী আমার মতো ুদ্র লোকেরাও পয়সা-কড়ি নিয়ে যেতে পারেনিজ্জতবু যখন মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে, তখন তাদেরকে যা ছিল তা দিয়েই যথাসাধ্য সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। আমি একা দেইনি, সবাই দিয়েছে। যখন ঢাকায় ফিরে এসেছি, চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয় রয়েছে, তখন তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তখন যতটুকু পেরেছি তাদেরকে সাহায্য করেছি।
মাহমুদ শাওন: বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সম্পূর্ণ উপন্যাস কি লেখা হয়েছে বলে মনে করেন?
শওকত আলী: না হয়নি। শীঘ্রই হবে বলেও মনে হয় না।
মাহমুদ শাওন: কেন?
শওকত আলী: ফরাসী বিপ্লবের পরে ফরাসী বিপ্লব নিয়ে সম্পূর্ণ উপন্যাস লেখা হয়েছে কি?
মাহমুদ শাওন: নেপোলিয়নের মৃত্যুর অনেক পরে তলস্তয় তো লিখেছেন ওয়ার এন্ড পিচ উপন্যাসটি। আমাদেরকেও কি সেরকম অপো করতে হবে?
শওকত আলী: তলস্তয় অনেক বড় লেখক। ওনার প্রতিভা ওরকম ছিল। এবং ওরকম প্রতিভাকে সমর্থন করার মতো লোকজনও ছিল। আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৩৮ বছর আগে। এখনও কেউ কেউ লেখার চেষ্টা করছে। আংশিকভাবে কারো কারো লেখায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে; কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে আসেনি। এমনকি বাঙালি, বাংলার যে দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে তা নিয়েও তো তেমন কোনও কাজ এখানে হয়নি। আমি একটা চেষ্টা করেছিলাম প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে। কতদূর হয়েছে জানি না।
মাহমুদ শাওন: সম্ভবত আপনার সর্বাধিক আলোচিত ও বহুলপঠিত বই প্রদোষে প্রাকৃতজন। প্রায় ৮ শ’ বছর আগের ইতিহাসের সেইসব চরিত্র নিয়ে উপন্যাস লেখার আগ্রহ কিভাবে হলো?
শওকত আলী: আমার চিন্তাটা এ কারণেই এসেছিল যে, এখানকার সাধারণ মানুষ ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী রাজ্যশাসনের যে প্রক্রিয়াটা ছিল- তা তো তারা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে। দণি এশিয়ার এই প্রান্তে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা এত বেশি হওয়ার কারণ কী? এটা আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আমি অনেকজনকে প্রশ্ন করেছি কিন্তু কোনও সঠিক উত্তর পাইনি। মুসলমান যারা দিগবিজয় করতে এসেছে তারা তো ঐদিক দিয়ে এসেছে। তারপর মোগল-পাঠানরাও ঐদিক দিয়ে এসেছে। এটা কিন্তু অবাস্তব কৌতূহলের কিছু নয়। একসময় মুসলমানরা এখানে আধিপত্য করছে, তারা শাসন করেছে ২/৪ শ’ বছর, তারা মতায় থাকা সত্বেও ঐসব অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়েনি। এখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। এটা সম্পর্কে আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, বইপত্র পড়েছি। একসময় একটা সংস্কৃত বই হাতে আসে। বইটির নাম হচ্ছে শেখ শুভদয়া। কেউ বলেছে সেন রাজত্বের পরপরই ওটা লেখা হয়েছিল। শেখের শুভ উদয়- এই অর্থে। শেখ মানে মুসলমান। ভালো সংস্কৃত আমি জানি না। মোটামুটি পড়তে পারি। কিন্তু হিন্দি ভালো পড়তে পারি। তো ওর মধ্যে কিছু কিছু গল্পের মতো পেয়েছি। যেমন একটা দৃশ্য ওখানে পেয়েছি যে, অশ্ব বিক্রেতারা নৌকায় চড়ে অশ্ব বিক্রয় করতে এসেছে। অশ্ব বিক্রয় হয়ে গেছে। সন্ধ্যা সমাগম। তখন ৬/৭ জনের মধ্যে বয়োজ্যষ্ঠ যিনি, তিনি উš§ুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে মানে সূর্য অস্তের দিকে তাকিয়ে কানে হাত দিয়ে উচ্চস্বরে কাকে যেন ডাকছেন। তারপর এক জায়গায় গোল হয়ে বসে প্রভু-ভৃত্য সবাই একপাত্র থেকে আহার গ্রহণ করছে। আহার শেষে একজন সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করছে, তারপর উঁবু হয়ে থাকছে, অবশেষে প্রণাম করছে। তিনি যা যা করছে পিছনের সবাই তাকে অনুসরণ করছে। সামনে যে ছিল সে কিন্তু প্রভু নয়; ভৃত্য। তবু সবাই তাকে অনুসরণ করছে। আমি এই দৃশ্যটা আমার প্রদোষে প্রাকৃতজন’র মধ্যে ইচ্ছে করেই দিয়েছি। এই রকম একটা দৃশ্য যদি দেখে সাধারণ মানুষ, যে মন্দিরের ছায়ায় অচ্ছ্যুত নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের পা যেন না পড়ে সে জন্য সকালে মন্দিরের পশ্চিম পাশের এবং বিকালে মন্দিরের পূর্বদিকের রাস্তা দিয়ে নিম্নবর্গীয় মানুষের চলাচল বন্ধ, তাহলে তাদের মনে প্রতিক্রিয়া কী হবে? এরকম একটা অবস্থা সেখানে ছিল। এরপর যখন যবনরা এলো, তারা একসঙ্গে বসে, একসঙ্গে ওঠে, একসঙ্গে খায়, প্রভুর উপাসনা করেজ্জআমার নিজের মনের থেকে ধারণা হলো এই অঞ্চলে নিম্নবর্গের মানুষ সবচে বেশি ছিল এবং এখানে সবাই যবন ধর্মটি গ্রহণ করেছিল। এর কিন্তু কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ আমি দিতে পারব না। এটা আমার অনুমান। এই ভিত্তিতে আমি আমার উপন্যাসে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করেছি। বৌদ্ধদেরকে তো মেরে ফেলা হয়েছিল। কেউ কেউ পালিয়ে পাশ্ববর্তী অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপরও যবনরা আসছে শুনে অত বড় রাজা লক্ষণ সেন রান্না করা খাবার না খেয়েই নৌকা নিয়ে পালিয়ে গেল। এই ঘটনাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছিল এই উপাদানগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে কেমন হয়। আমি ইসলাম প্রচার করতে যাচ্ছি না। কী হয়েছিল না হয়েছিল সে সবের কোনও সিদ্ধান্তও আমি দেইনি। এর মধ্যে প্রেমের ব্যাপারটা আছে। প্রেমিক-প্রেমিকরা যে সমাজ পরিবর্তনের জন্য উত্থান-পতন, গৃহযুদ্ধজ্জতাতে অংশ নিয়েছে। প্রেমিকাকে ফেলে প্রেমিক যুদ্ধে যাচ্ছে, সে কোন্ যুদ্ধে যাচ্ছে? কার জন্য যাচ্ছে? তার ধর্ম কী? একটি ধর্ম নিরপে সমাজ পরিবর্তনের কথাই আমি বলতে চেয়েছি। এই উপন্যাসটি নিয়ে খুব একটা আলোচনা আমার চোখে পড়েনি।
মাহমুদ শাওন: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে, যতদূর জানি, আপনার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ব্যক্তি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছি।
শওকত আলী: ব্যক্তি ইলিয়ানের অন্বেষণের মধ্যে একটা ব্যাপার ছিল। সেটা তৎকালীন আধুনিকতার যে ব্যাপারটা এসেছিল, পরাবাস্তবতা...যাদুবাস্তবতা, উত্তরাধুনিকতা...এগুলো তাকে আকর্ষণ করেছিল। আমাকেও আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু পরাবাস্তবতার যে ব্যাপারটা সে সেটাকে যুক্ত করলো ঐতিহ্যের সঙ্গে। বিশেষ করে তার খোয়াবনামা উপন্যাসে এই বিষয়টা ভালোভাবে আছে। কাৎলাহারের বিল, চিলগুলো উড়ে যাচ্ছে, নৌকার মাঝি সেই বুড়োটা এবং বুড়ো লোকের সেই মেয়ে বউটি, তার সঙ্গে এক তরুণের সম্পর্কের যে ব্যাপারটা--এই সমস্ত বিষয়গুলো পরাবাস্তবতার কাছাকাছি। কিন্তু সেই পরাবাস্তবতাকে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন বাস্তবতায়, মানুষের যে সংগ্রাম, হিউম্যান স্ট্রাগলজ্জসেই হিউম্যান স্ট্রাগলের সঙ্গে পরাবাস্তবতাকে তিনি মেলাচ্ছেন। পৃথিবীর অন্য ভাষায় এরকম নিরীক্ষা আর হয়নি। আমি সে জন্যই বলি ইলিয়াসের এই উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখিত উপন্যাস হওয়ার যোগ্য।
আমার লেখার ব্যাপারে ইলিয়াসের খুব উৎসাহ ছিল। বিশেষ করে আমার গল্পের প্রতি ওর আগ্রহটা বেশি ছিল। আদিবাসী, তেভাগার লড়াই ইত্যাদি বিষয়গুলো ওকে আকৃষ্ট করতো। আবার মাঝে মাঝে ও কিন্তু বলতো, ‘বুঝছি না আপনি এসব কেন করছেন? আপনার একঘেয়ে লাগে না এক জিনিস লিখতে?’ আমি বলতাম, আমি তো এক জিনিস লিখছি না। আমি ঘটনাগুলো বিভিন্ন দিক থেকে দেখছি। কখনও নারীর চোখে, কখনো পুরুষের চোখে, কখনো জোদ্দারের দিক থেকে দেখছি। তারপর ফসলের আবাদের যে প্রক্রিয়াটা-- বৃষ্টি হচ্ছে, চারা রোপন করছে- এসব বিষয়গুলোকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করছি। এর মধ্য দিয়ে শিল্পগুণ কতটুকু বিকশিত হচ্ছে কিংবা আদৌ হচ্ছে কী-না জানি না। তবে আমার লিখতে ভালো লাগছে তাই লিখছি। পরে অবশ্য সে আমার কাছে স্বীকার করেছে যে না আপনার চিন্তাটা ঠিক ছিল।
মাহমুদ শাওন: এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক কথাশিল্পীর উচিৎ মাঝে মাঝে কবিতা লেখা’। কেন উচিৎ?
শওকত আলী: হ্যাঁ বলেছিলাম। কবিতা লেখা উচিত এই কারণে, কথাসাহিত্যের যে ভাষা, সে ভাষা নির্মাণের জন্য কবিতা খুব সহায়ক। অনেক শব্দের মধ্যে ডাইমেনশনটা এত বিচ্চুরিত হয়, এমন চারপাশটাকে আলোকিত করে তোলে, যে কাহিনী ঘটনা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, মানসিকতা, মনোভাব, লেখকের ইচ্ছা-সবগুলোকে কবিতা একই সঙ্গে আলোকিত করতে পারে, সংযুক্ত করতে পারে। এর ফলে থিমটা জমাট বাঁধে বা বিস্তারিত হতে পারে। সুললিত-সুন্দর ও উপভোগ্য হয়।
মাহমুদ শাওন: আপনি তো কবিতা লিখেছেন। কিন্তু ছাপতে দেন না কেন?
শওকত আলী: এখনও কবিতা লিখি। কিন্তু দু’তিনটা প্যারা লেখার পর ওগুলো কোথায় যে রাখি আর খুঁজে পাই না। অনেক সময় অসমাপ্ত থেকে যায়।
মাহমুদ শাওন: একটি কবিতা কি আমাকে শোনাবেন?
শওকত আলী: শোনাতে পারি। কিন্তু ছাপানো যাবে না।
(১৯৯৪ সালে লন্ডনের ব্রুকস্ হাসপাতালে বসে লেখা ‘ব্রুকস্ হাসপাতালে সন্ধ্যা’ নামের একটি প্রেমের কবিতা তিনি আমাকে শোনান।)
মাহমুদ শাওন: আপনার লেখা উপন্যাস উত্তরের খেপ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দেখেছেন? কেমন লেগেছে?
শওকত আলী: দেখেছি। খুব একটা ভালো লাগেনি। উপন্যাসটি তুমি পড়েছ?
মাহমুদ শাওন: না, পড়িনি।
শওকত আলী: একজন বাস ড্রাইভার বাস নিয়ে উত্তরবঙ্গে দিনাজপুরে যাচ্ছে। সেখানে তার যে অভিজ্ঞতা, লোকে ঠকাচ্ছে, এই করছে সেই করছে, তারপর আবার ফিরে আসছেজ্জযাওয়া আসার ঐটুকু সময়ের মধ্যে তার সারাজীবনটা বর্ণিত হয়ে আছে। উপন্যাসটি কী একটা পুরস্কারও পেয়েছে। সিনেমাটাও কী যেন পুরস্কার পেয়েছে। তবে অন্যান্য যেসব ছবি দেখি তার তুলনায় এটি অবশ্যই অনেক ভালো নির্মাণ। উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রজ্জশিল্পের এই দু’টি মাধ্যমকে আমি আলাদা করে দেখি। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি জিনিস এক থাকতে হবে- মানুষের অনুভূতিতে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, মাধ্যম আলাদা হলেও অনুভূতির ঐ আবেদনটিজ্জরাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-বিদ্বেষ-প্রেম, তার শ্রেণী সচেতনতা এগুলো যেন ঠিক থাকে।
মাহমুদ শাওন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শওকত আলী: তোমাকেও।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ৩১/১০/২০০৯, টিকাটুলি, ঢাকা।
কালের কণ্ঠের ‘শিলালিপি’তে প্রকাশিত হয়েছে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১০