পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই পানি। আবার পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু পৃথিবীর বিশাল জলভাণ্ডারের পানি কি মানুষের জীবন হতে পারে? সমুদ্রের নোনাজল কি তিয়াস মেটাতে পারে প্রাণীদের। বিশাল হাওরের পানি কি নিরাপদ পাণীয়? আবার নিরাপদ পানির অন্যতম উৎস ভূগর্ভস্ত পানি কি সবসময় সবখানে নিরাপদ?
জেনারেটর চালিত সাবমার্সেবল।
না। সাগরের নোনাজল শুধু তৃষ্ণা বাড়াতেই পারে। মেটাতে পারে না কখনই। বিশাল হাওরের পানি তৃষ্ণা মেটালেও কখনো কখনো নিয়ে আসে মহামারি। কলেরা, জন্ডিসের মহামারি। ভূগর্ভের পানিতেও আছে আর্সেনিক! পানি শুধু জীবনের অপর নামই নয় বিপদের অপর নামও হতে পারে কখনো কখনো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামির পৃথিবীতে যদি কোন বিশ্বযুদ্ধ হয়; তাহলে তা হবে মিঠা পানির জন্য। সারা পৃথিবীতে মিঠা পানির উৎসগুলো ক্রমশ: শুকিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে মানুষের পানীয় সংকট। বেড়ে যাচ্ছে নিরাপদ পানির মূল্য। সুপেয় পানি চলে যাচ্ছে প্রান্তিক মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। অপরদিকে খেটে খাওয়া মানুষেরা বিশুদ্ধ পানির অভাবে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে। অথচ মুনাফাখোর একদল কৃত্রিম সংকটও তৈরি করছে অথবা সংকট নিরসনের পথ রোধ করছে। মানুষের জীবন পানি নিয়ে বাণিজ্য করার জন্য।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যে দেশ যত উন্নত সে দেশের মানুষ তত বেশি পানি অপচয় করে। পৃথিবীতে অপচয় হওয়া প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে পানিই সবচেয়ে বেশি অপচয় হয়। একটা শাওয়ারে একবার গোসল করলে দেখা যায় প্রায় সত্তর লিটার পানি খরচ হয়ে যায়। কিন্তু সেই পানিটা যদি বালতিতে নিয় গোসল করা হয় তাহলে সর্বোচ্চ চল্লিশ লিটার পানিতেই গোসল শেষ হয়ে যায়। আবার যদি বাথটাবে সেই গোসল করা হয় তাহলে ক্ষেত্র বিশেষ একশ থেকে দেড়শ লিটার পানি খরচ হয়ে যায়। টয়লেটের ফ্ল্যাশে উন্নত বিশ্বের একজন মানুষ সারাদিন যতটুকো পানি ব্যয় করেন- উন্নয়ণশীল দেশের একজন মানুষ সারাদিনে তার সবকাজেও ততটুকো পানি ব্যয় করেন না।
ডীপসেটেও পানি ওঠছে না। তাই পরিত্যক্ত...
আবার যেখানে ট্যাপে অযু করা হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ট্যাপে একবার অযু করতে কারো কারো প্রায় পাঁচ বদনা পানি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু একবার অযু করার জন্য এক বদনা পানিই যথেষ্ট। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, কলেজের হোস্টেল, রেলওয়ে স্টেশনের পানির ট্যাংকি ও মসজিদের অযু খানায় সবচেয়ে বেশি পানির অপচয় হতে প্রকাশ্যে দেখা যায়। কখনো দেখা যায় ট্যাংকি ভরার পরও প্রায় কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত মটর চলছে। ট্যাংকি ভরে পানি উপচে নিচে পরছে। অথচ আমরা জানি নিয়ামতের অপচয় করলে একসময় নিয়ামত উঠিয়ে নেওয়া হয়। আবার পবিত্র কুরআনেও ইরশাদ হচ্ছে, ‘অপচয়কারিরা শয়তানের ভাই।’
আজ থেকে এক যুগ আগে সমগ্র পৃথিবীতে যখন মিঠা পানির সংকটের কথা সংবাদ মাধ্যমে আসতো, তখন আমারা অবাক হয়ে ভাবতাম, পানির আবার অভাব হয় কীভাবে? মাত্র এক-দেড় যুগের ব্যবধানে আমাদের পানির দেশ, নদীর দেশ, ভাটির দেশেই শুরু হয়ে গেছে পানির সংকট। শুধু সুপেয় পানির সংকট নয়। নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয়েও নেমে আসছে পানি সংকট। মাছ চাষের জন্য এখন প্রায় অর্ধেক বছর পুকুরগুলোতে শ্যালো দিয়ে পানি দিতে হয়। কয়েক বছর আগেও এদেশের খুব কম দিঘিই শুকাতো। গ্রীষ্মের তাপদাহে শিশু-কিশোর থেকে নিয়ে জোয়ান-বুড়ো সবাই পুকুরে অথবা নদীর ঘাটে গোসল করতে যেতো। বর্তমানে নদীতে নেই পানি। পুকুরের পানিতে নেই গোসল করার মত শুদ্ধতা। মাছ চাষের আধুনিক পদ্ধতির কারণে পুকুরের পানি এখন ব্যবহার অযোগ্য। মানুষের জীবনের ঘর-গেরস্থালির কাজে ভূগর্ভস্ত পানিই ভরসা।
খবরে প্রকাশ উপকুলে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রায় ছয় মাস মিঠা পানির সংকটে ভোগেন। পাহাড়েও আছে পানীয় পানির সংকট। পার্বত্য অঞ্চলেও চলছে মানুষের জীবনের অপর নাম পানির সংকট। পানি সংকটে নিপতিত মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। উপকুল আর পার্বত্য এলাকা ছেড়ে সেই সমস্যা এখন সমতলের দিকে ধেয়ে আসছে। শীতের শুরুতে সমতল অঞ্চলের অনেক স্থানেই অগভীর নলকূপগুলোতে পানি আসা বন্ধ হয়ে যায়। আরেকবার গ্রীষ্মের শেষের দিকে আস্তে আস্তে পানি আসতে শুরু করে। বর্ষায় পুরোদমে পানি আসে। সমস্যার মূলে রয়েছে বোরা ধানের চাষ। সেচের জন্য যখন শ্যালো মেশিনগুলো ছাড়া হয় তখন সব নলকূপের পানি বন্ধ হয়ে যায়। কেবল সরকার কর্তৃক দেওয়া থার্ড লেয়ারে বসানো নলকূপগুলো দিয়ে পানি আসে। আর এসব গভীর নলকূপ একটা গ্রামে একটি বা দুটির বেশি থাকে না। ফলে এইসব নলকূপের পাশে সবসময় মানুষের ভীড় লেগেই থাকে।
আমরা ময়মনসিংহ জেলার পুর্বাঞ্চল নান্দাইল উপজেলার কয়েকটি এলাকা ও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কয়েকটি এলাকা সরেজমিনে দেখেছি। সেখানের মানুষের কথা হলো পনের বছর আগেও তাদের এমন পানি সংকট ছিলো না। সারা বছর সমভাবে পানি উঠতো নলকূপগুলো দিয়ে। একসময় নলকূপগুলোতে পানি আসা বন্ধ হয়ে গেল বোরো মওসুমে। কিন্তু শ্যালো দিয়ে ঠিকই পানি আসতো। কেউ কেউ বলেন সেচের পানির যখন টান পরে তখন হস্তচালিত কলগুলোতে আর পানি আসে না। কিন্তু বর্তমানে ঐ এলাকা গুলোতে দেখা যায় সেচ মওসুমে শ্যালো দিয়েও আর স্বাভাবিক পদ্ধতিতে পানি তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এখন সব শ্যালো হয়ে যাচ্ছে ‘ডীপ সেট’ মানে মাটিতে গর্ত করে প্রায় দশ থেকে বিশ ফুট পর্যন্ত নিচে মটর বা মেশিনসহ পাম্প সেট করে পানি তোলতে হয়। ডীপ সেট পদ্ধতিও চলছে প্রায় আট/দশ বছর যাবৎ। কোথাও কোথাও দেখা যায় ডীপ সেট পদ্ধতিও কাজ করছে না। নিতে হচ্ছে সাবমার্সেবল পাম্প। বিদ্যুতহীন এলাকায় জেনারেটর দিয়ে সাবমার্সেবল চালাতে হচ্ছে বোরা চাষ করার জন্য। ফলে সমস্যা বাড়ছেই। নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। আবার বেড়ে যাচ্ছে ধানের উৎপাদন খরচ।
ফার্স্ট লেয়ারে পানি এখন বর্ষা ছাড়া পাওয়াই যায় না। সেকেন্ড লেয়ারও সব জায়গায় কাজ করে না শ্যালো ছাড়া। এভাবে যদি পানির স্তর নিচে নামতে থাকে। তাহলে এমন দিন হয়তো বেশি দেড়ি নয় যেদিন আমাদের পানি আমদানি করার প্রয়োজন হতে পারে। একদল গবেষক বলেছেন ঢাকা শহরের পানির স্তর প্রতি বছর দুই মিটার করে নেমে যাচ্ছে। আর এই কথার সত্যতা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। প্রতি বছর গ্রীষ্ম এলেই দেখা যায় ঢাকার কোন কোন এলাকায় পানির জন্য দীর্ঘ লাইন। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যদি ভূগর্ভের পানি না তুলে বোরো আবাদ করা যেতো তাহলে এই সমস্যাটা হতো না। আবার খরচও কম হতো। তারা বলেন, ‘‘আগে আমারা নদীতে বান দিয়ে নাইলে খালে বান দিয়ে বোরো ধান লাগাইতাম। কিন্তু অহন তো নদীতে পানিই থাকে না।” নদী গুলোতে দেখা যায় নদী দখলের নানা কসরতের। কোথাও কোথাও নদীর একটা রেখা মাত্র টিকে আছে। বাকি সবটাই দখল হয়ে গেছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় নদী ভিত্তিক সেচ প্রকল্প আছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সেগুলো করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আদৌ চালু হয়নি। পুরনোগুলো চালু না করেই আবার নতুন করে সেচ প্রকল্প করা হচ্ছে কোথাও কোথাও। কিন্তু এসবের দ্বারা সরকারে ও জনগণের টেক্সের টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণে গফরগাঁওয়ের শেষ প্রান্তে দত্তের বাজার ইউনিয়নে দেখা যায় ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে সেচ প্রকল্প করা হয়েছে। কিন্তু কাজ শেষ হয়েছে কয়েক বছর হলেও এখনো সেই সেচ প্রকল্প চালু করার কোন উদ্যোগ নেই। এমন আরো নানা এলাকায় আছে।
বিপজ্জনক ডীপসেট।
বাংলাদেশে বোরো চাষ এসেছে ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে। মাত্র চার যুগেই কোথাও কোথাও পানি সংকট প্রবল আকার ধারণ করেছে। আর কয়েক যুগ পরে কী হতে পারে? আমাদের দেশের গবেষকগণ কি আদৌ এই সংকট নিরসেনের জন্য কাজ করছেন? এই প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি হয়েছিলাম, কৃষি কর্মকর্তা ড. এখলাছ উদ্দিনের। যিনি আমাদের বোরো ধানের পানি সংকট ও কম পানি দিয়ে আবাদযোগ্য ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি করেছেন। তিনি বলেন, আশার কথা হলো বাংলাদেশের পানি সংকটটি যতটা ভয়বহ দেখা যাচ্ছে ঠিক ততটা নয়। কিছু কার্যকর উদ্যোগ নিলেই এই সমস্যাটি সমাধান করা সম্ভব।” সম্ভাবনার কয়েকটি পদ্ধতিও তিনি বলেন। যেমন, মানুষের নিত্য গেরস্থালির কাজ ও পানের পানির জন্য থার্ড লেয়ারে গভীর নলকূপ দিয়ে দিলেই সংকট অনেকটা নিরসন হয়। আর এটা যদি সরকার আন্তরিক হয় তাহলে দ্রুতই এই গভীর নলকূপগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, ‘‘পানি কম প্রয়োজন হয় এমন ধান-বীজের জাত আনার জন্য চেষ্টা চলছে। যদি এই চেষ্টায় সফল হয় তাহলে সমস্যা অনেকটাই সমাধান হবে। তবে আমাদের পানির অপচয়ও কমাতে হবে।” বোরো চাষ এখন আমদের দেশে বৃহৎ একটি ফসলি মওসুম। এই মওসুমের ধানের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় আমাদের খাদ্য কৌশল। ভাল ফলনের কারণে আমরা এখন অনেকটাই খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ। অথচ এই চাষের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর পানির। সেই পানির উৎসও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্ত পানি। যদি ভূগর্ভস্ত পানির স্তর নিচে নামতে থাকে তাহলে একদিন না একদিন আমদের পানি সংকটে পরতেই হবে। ড. এখলাছ উদ্দিন বলেন, “পানির সংকট যেন আমদের দেশে না হয়। সে জন্য চেষ্টা চলছে আরেকটি পদ্ধতির। সেই পদ্ধতিটির নাম ডিডিএস পদ্ধতি। (DDS= Dry Direct Sheeding) সরাসরি শুকনো জমিতে ধান বীজ রোপন পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিতে ধান উৎপাদনের জন্য সেচের প্রয়োজন হবে না। যদি এই পদ্ধতিতে সফল হওয়া যায় তাহলে বলা যায় আমাদের পানি নিয়ে শংকা অনেকটাই কমে আসবে।”
বাংলাদেশ হলো ভাটির দেশ। পানি যার প্রাণ। সেই দেশে যদি পানির জন্য মানুষ হাহাকার করে তাহলে তা অবশ্যই দুখজনক। আমারা আশা করবো আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের এই পানি সংকট ও পানি নিয়ে আগামীর সব ধরণের আশংকা দূর করে একটা সুন্দর, সুখি ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলবেন আমাদের এই পুণ্যময় সবুজ ভূমিকে।
ছবি: মোবাইলে তোলা। নিজস্ব এ্যালবাম থেকে।
লেখাটি ব্যক্তি উদ্যোগে একটি সচেতনতার প্রয়াস।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৮