যতোদূর মনে পড়ে, ১৯৭১-সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি ছিলাম পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র।
স্বাধীনতা যুদ্ধ কি এবং কেন, তা সেসময়ে আমি ঠিক বুঝে ঊঠতে পারিনি … ।
কিন্তু আমি তখন নিয়মিতভাবেই স্বাধীন বাংলা বেতারের অনেক অনুষ্ঠান শুনতাম। ....
কেন বা কি কারণে শুনতাম, তা বলতে গেলে অনেক স্মৃতি অষ্পষ্টভাবে একটু একটু মনে পড়ে। ..
বলা যায়, অনেকটা শখ ও অভ্যাসের বশেই ছোটবেলায় আমি খুব রেডিও শুনতাম। .... তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ঢাকা রেডিওর বিভিন্ন অনুষ্ঠান-সম্প্রচার শুনতে শুনতেই একদিন হঠাৎ আবিস্কার করে বসলাম, মিডিয়াম ওয়েভ মিটারব্যান্ডে ঢাকা রেডিওর অনুষ্ঠান যে স্থানটাতে শোনা যেতো (৭০০ মিটার ব্যান্ড মার্কিং-এর কাছাকাছি) তার একটু ডান দিকেই ‘কখনো আসে, কখনো আসেনা’ ধরনের অন্য একটি ‘রহস্যময়’ রেডিও স্টেশন থেকে মাঝে মাঝেই সুন্দর সুন্দর সমবেত কন্ঠের বাংলা গান, কথিকা ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে।
....পরে বড়দেরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, এটি নাকি একটি ‘ভয়ের’ রেডিও স্টেশন। এটি জোরে বাজিয়ে শুনতে নেই। গোপনে চুপি চুপি শোনা যেতে পারে ...। জোরে বাজিয়ে শুনলে পাকিস্তানী মিলিটারীরা ধরে নিয়ে যেতে পারে। ..... হ্যা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্বন্ধে আমার ছোটবেলার ধারণাটা ছিলো এরকমই অস্পষ্ট, ভীতিকর কিছু একটা বিষয় ! কিন্তু এরপরেও খুব ছোট বলেই কোন ভয় আমাকে নিয়ন্ত্রিত করেনি। মোটামুটি জোর ভলিউমেই বাজিয়ে শুনতাম এর বিভিন্ন উজ্জীবনী গান ও কথিকা। অবশ্য সেসব গান ও কথিকা যে ছিলো প্রচন্ড সংগ্রামী ও উজ্জীবনী ...সেটিও উপলব্ধি করেছি অনেক পরে ...।
তো সেই সময়েই শোনা একটি অন্যরকম গানের কথা বলি ...।
গানটি প্রচারিত হয়েছিলো সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেই।
এবং আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ( আমার পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে) মাত্র একবার শোনা সেই গান আমি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছিলাম প্রায় দীর্ঘ ২২ বছর অর্থাৎ স্বাধীনতার পর প্রায় ২২ বছর ধরে আমি চেষ্টা করেছি সেই গানটি আরেকবার শুনতে, কিন্তু আশ্চর্য্য বিষয় ছিলো, গানটি আর কোথাও আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না... মুক্তিযুদ্ধের উপর আয়োজিত কোন সেমিনার, কোন সঙ্গীতানুষ্ঠান অথবা প্রকাশিত কোন মুক্তিযুদ্ধের গানের ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি ... কোথাও না ! কোথাও সেই গান নেই ! কি আশ্চর্য্য ! তবে কি সত্যিই আমি সেই গানটি শুনেছিলাম একবার হলেও সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে? নাকি পুরোটাই আমার ভ্রান্ত কল্পনা !! কি জানি !! একসময় নিজেই কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিলাম গানটা নিয়ে !
এবারে গানটা কি ছিলো, সেই কথায় আসি ...। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের জীবনে ঈদ এসেছিল বর্ষপঞ্জীর স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষের বিপুল অসহায় কষ্টের মাঝে আবার কিসের ঈদ? কিসের আনন্দ ? এ অঞ্চলের গোটা জাতি যখন পাকিস্তানী হানাদারদের অত্যাচার আর নিপীড়নে বিপর্যস্ত, মানুষের আর্তনাদ আর হাহাকারে যখন ভারী হয়ে উঠেছে এ দেশের বাতাস, যখন বেদনায় বিপন্ন নীল আকাশও রক্তবর্ণ ধারণ করেছে ক্ষোভ আর প্রতিশোধের অগ্নিশিখায়, তখন ঈদের একফালি আনন্দের চাঁদও যেন গীতি-কবির কাছে হয়ে উঠলো অনাকাঙ্খিত, অপ্রত্যাশিত কোন বিষয়। তাই তীব্র এক হাহাকার আর বেদনার আবেগ নিয়েই যেন তিনি লিখে ফেললেন –
"চাঁদ তুমি ফিরে যাও, ফিরে যাও, ফিরে যাও, ফিরে যাও । চাঁদ .... তুমি ফিরে যাও, দেখো বাংলার মানুষের হাহাকার-"
হ্যাঁ, এরকম কথা দিয়ে শুরু হওয়া গানটিই আমি শুনেছিলাম মাত্র একবার। সেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে।
স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে ছোটবেলার স্মৃতিচারণে এ গানটির কথা যখনই আমার মনে হয়েছে, তখনই আমি ভেবেছি, সত্যিই কী এটা স্বাধীন বাংলা বেতারের গানই ছিল? নাকি নিছকই আমার কোন কল্পনা? গানটির কেবলমাত্র দুলাইন আমার মনে ছিল এবং দ্বিতীয় লাইনে ‘দেখো বাংলার মানুষের হাহাকার’ এর শেষ অংশে ‘হাহাকার’ নাকি অন্য কোন শব্দ ছিল সে বিষয়েও আমি ছিলাম ভীষণ দ্বিধান্বিত। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাধীনতার পর প্রায় বিশ-বাইশ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও এ গানটি আর কখনো কোথাও দ্বিতীয়বার শুনতে পাইনি।... কোথাও খুঁজে পাইনি এ গান।
এ কারণেই মনের মধ্যে একসময় ভাবনা এসেছিল, সত্যিই কী এটা স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধ সময়কালের কোন গানই ছিল? নাকি নিছকই আমার কোন অবাস্তব কল্পনা?
এরপর এলো নব্বই এর দশকের কোন এক বিজয় দিবস অথবা ২৬ শে মার্চের রাত (সঠিক সাল ও তারিখ মনে নেই)। সম্ভবতঃ বিটিভি থেকেই প্রচারিত হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গান নিয়ে কোন এক অনুষ্ঠান। আর সে অনুষ্ঠানেই আমাকে চমকে দিয়ে একজন শিল্পী গাইতে লাগলেন সেই গান- ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও...’।
আমার সমস্ত শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুত বয়ে গেল। দীর্ঘ বাইশ বছর পর ছোট্টবেলায় একবার মাত্র শোনা একটি গান আমি আবার শুনছি। এইতো, এইতো সেই গান ! প্রথমে একক কণ্ঠে শিল্পি গেয়ে ওঠেন প্রথম লাইন, ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও...’, তারপর সমবেত কণ্ঠে সবাই গাইতে থাকেন ‘ফিরে যাও, ফিরে যাও, ফিরে যাও....’। সেই একই নিয়মে, একই সুরে, সেই একই আবেগ দিয়ে গাওয়া গান। শুনে আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।... আমার মুখে কোন কথা নেই। আমি যেন এক ঘোর লাগানো আবিষ্কারের মধ্যে আছি! এক তীব্র নতুন উপলব্ধির মধ্য আছি !
আমি দ্রুত টেপ-রেকর্ডার বের করে গানটি রেকর্ড করার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতেই গানটি শেষ হয়ে গেল !
এরপর যদিও নিশ্চিত হয়ে গেলাম, গানটি আসলেই স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধ সময়কালেরই কোন গান, এবং এই গানই বেঁচে আছে আমার অস্পষ্ট স্মৃতির মধ্যে, কিন্তু তার পরেও গানটি আর আমার সংগ্রহে পাবার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শুধু তাই নয়, বিভিন্নজনের সাথে আলোচনা করে এটা বুঝে গেলাম যে, এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের এই গানটির বিষয়ে অনেক কম অবগত । শুধু আজকের নতুন প্রজন্মই নয়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের তরুণ যুবক বা বয়স্ক মানুষজনের কাছেও এ গান অনেকটাই অজানা। .... তাছাড়া, ঈদের চাঁদ কেন্দ্রিক একটি গানের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কি সম্পর্ক, সেটিও অস্পষ্ট অনেকের কাছেই ....।
এরকম একটি গানের বিষয়ে এদেশের মানুষ অবগত হোক, এরকম একটি প্রত্যাশা নিয়েই চাচ্ছিলাম, গানটি সবার কাছে সহজলভ্য হোক। গানটি সবাই যেন শোনার সুযোগ পায় । গানটি যেন আর এরকম সবার চোখের আড়ালে না থাকে !
অতঃপর, সেই প্রত্যাশা পূরণ হলো আরও কয়েক বছর পর ! ২০১৭ সালের মার্চে অর্থাৎ স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় ৪৬ বৎসর পর এই ঐতিহাসিক গানটির একটি রেকর্ড প্রথমবারের মতো ইউটিউবে আপলোড করেন Music Civic. Manzur Badal. গানটি আপলোড করার সময় তিনি নিজেও বোধহয় এ গানটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের গল্পটি ঠিক সেভাবে জানতেন না। আমি তার আপলোড করা গানের নীচে ‘বড় আকারে’ মন্তব্য লিখে গানটির অপার গুরুত্বের অজানা গল্পটি তুলে ধরি ...।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ গানটি গেয়েছিলেন কন্ঠশিল্পী রূপা ফরহাদ। গীতিকার ছিলেন প্রয়াত শহিদুল ইসলাম আর সুরকার ছিলেন প্রয়াত অজিত রায়। Manzur Badal এর আপলোডের কয়েকমাস পরেই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গানটির মূল রেকর্ড (রূপা ফরহাদ-এর কন্ঠে) ইউটিউবে আপলোড করেন তারই নাতিন Ifte islam. ( আমি এই লেখার নীচে তার দ্বারা আপলোডকৃত গানের ইউটিউব লিংকটিই সংযোজন করলাম)।
Ifte islam ইউটিউবে তার দ্বারা আপলোডকৃত এই গানের বিবরণে লিখেছেন-
“This song “Chad Tumi Firey Jao” touched the hearts of Bangladeshis during the liberation war in 1971. Eid was not in the minds of the people who were ready to give up their lives for the country. The beautiful words were written by the late lyricist, Shahidul Islam and composed by the late Ajit Rai. It was sung by no other than my Grandmother, Rupa Farhad a “Kontho Jodhdha” of Shadhin Bangla Betar Kendra.”
********************************
শেষ হলো একটি খুবই 'কম-শোনা' এবং অপেক্ষাকৃত ‘কম পরিচিত’ মুক্তিযুদ্ধের গানের গল্প !
এরকম অনেক অনেক গল্প আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয় -
একটি জাতির মুক্তির জন্য, একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য কতো মানুষের কতোরকম প্রচেষ্টাই না ছিল ! কেউ জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন যুদ্ধের রক্তলাল সংগ্রামী প্রাঙ্গনে, আবার কেউবা ঢেলে দিয়েছেন তাদের অনুপ্রেরণার অসীম অসামান্য আবেগ ..... রক্তে আগুন ধরানো কোন ‘গানের কথা’য় অথবা উজ্জীবনী সুরের অসামান্য উত্তাল স্রোতধারায় .. !
তাই সব সময়ের প্রার্থনা একটাই, যেন কখনোই ভুলে না যাই, এইসব অসামান্য সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী ।
যেন ভুলে গিয়ে অকারণে তুচ্ছ না করে ফেলি, কারও অবদান।
যেন অবহেলায় অবজ্ঞা না করি - অমূল্য আত্নদানে পাওয়া- অসামান্য এক স্বদেশ !
..................................................
পুনঃলিখন: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮
গানটির ইউ-টিউব লিংক:
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৫৮