পথিক এর ফোনটা যখন এলো, ঘড়ির কাটায় তখন রাত প্রায় সোয়া এগারো। মোবাইলের স্ক্রীণে ইংরেজীতে Pothik নামটা ভেসে উঠতেই আমি একটু অবাক হলাম। এতো রাতে পথিক এর ফোন কেন? গুরুতর কিছু?
ঘটনাটা দু’তিন দিন আগের। ২০শে মার্চ, বৃহস্পতিবারের। আব্বা গুরুতর অসুস্থ বলে আব্বাকে দেখতে গিয়েছি স্বামীবাগে। সেখানে ছোট ভাইয়ের সাথে আছেন আব্বা । আমি ঠিক করলাম, রাতটা আব্বার কাছে থেকে আসবো। পঁচাশি বছর বয়সে এসে আব্বা হঠাৎ অসহায় শিশুর মতো হয়ে গেছেন। একসময় যাকে দেখেছি বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর পদে প্রচন্ড নিষ্ঠা আর সততার সাথে পাগলের মতো পরিশ্রম করে কাজ করতে, তিনি এখন অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না। রাতে তার পাশে একজন না থাকলে ভীষণ অসুবিধা হয়।
আমি আব্বার জীর্ণ শীর্ণ হাতটি ধরে বসে আছি। ভাবছি এমন একটি দিন হয়তো আমাদেরও আসবে। একদিন আমাদেরও সকল অমিয় তেজ নিভু নিভু হয়ে আসবে তেল ফুরিয়ে আসা প্রদীপের মতো। একদিন আমরাও হয়তো তন্ন তন্ন করে পাগলের মতো হাতড়ে হাতড়ে আমাদের পাশে একজন সাহায্যকারী খুঁজবো -শুধুমাত্র একটু হাঁটার সাহায্যের জন্যই... ।
এইসব ভাবতে ভাবতেই পথিক এর ফোন। দেখলাম রাস্তার নানা শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেমন শাঁ শাঁ অচেনা একটা শব্দও শোনা যাচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে শব্দটা পানিতে বৈঠা বাওয়ার। আবার কখনো মনে হচ্ছে অন্য কিছু।পথিক আসলে ফোন করছেন কোথা থেকে?..... এটা জিজ্ঞেস করার আগেই পথিক জানালেন শুক্রবার বিকেলে ব্লগারদের আড্ডার আয়োজন হয়েছে। ঠিক বিকেল পাঁচটায় আমি যেন পৌছে যাই সেখানে।
“তাতো বুঝলাম, কিন্তু অনুষ্ঠানটা হবে কোথায়? আমি যাবো কোনখানে?”
এই প্রশ্নের আর কোন উত্তর পাওয়া গেল না। তার আগেই হঠাৎ একটা চিৎকার । পরক্ষণেই মনে হল মোবাইলের ওপারে আর যেন পথিক নেই। অথচ মোবাইল বন্ধ হয়নি। আশেপাশের অল্প বিস্তর শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সরাসরি কেউ কথা বলছে না। আমি চিৎকার করে ‘হ্যালো হ্যালো’ বলছি, কিন্তু ওপার থেকে কোন উত্তর নেই।...
আমি একটু অবাক হলাম। আশ্চর্য্য! কি হতে পারে ? কেন পথিক আর কথা বলছে না? তবে কি মোবাইলের আশে পাশে সে নেই? তবে কি মোবাইলটা এই মুহুর্তে অন্য কারো হাতে?
একটা অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠল। তবে কি মোবাইলটা তার ছিনতাই হয়েছে? সে কি রাস্তায় ছিল? নাকি অন্য কোথাও?
আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা কি করবো। আমি ফোনটা কেটে দিয়ে আবার রিং করলাম। এবার মনে হল ফোনটা কেউ ধরেই আবার কেটে দিলো। তাহলে ? তাহলে কি হতে পারে? আমি বার বার ফোন করতে লাগলাম। বারবার কেউ কেটে দেয়।
আমি মহাফাঁপরে পড়লাম। তবে কি পথিক কোন বিপদে পড়েছেন? এই মুহুর্তে কি তার সাহায্য দরকার? আমি চিৎকার করে বারবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করছি। বাসার সবাই সেই হ্যালো শুনে বুঝে ফেললো- অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে। কিছু একটা জরুরী ঘটনা আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।
বাসার সবাই আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে “লোকটি কে? কেন তার জন্য আমি এতো অস্থির হয়ে উঠেছি? সে কি আমার কোন ক্লোজ ফ্রেন্ড? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু? না কি অফিসের কোন কলিগ?......”
আমি থ মেরে আছি। আমি কাউকে কিছু বলছি না। আসলে কাউকে কিছু বলতে যেন ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আমার মন ভেতরে ভেতরে চিৎকার করছে। আমার হৃদয় যেন ভেতরে ভেতরে চিৎকার করে বলে উঠতে চাইছে – “পথিক আমার কেউ না । কেউ না ! কোন বন্ধু না। কোন ক্লাশমেট না। কোন কলিগও না...। এইতো তার সাথে মাত্র কিছু দিনের পরিচয় আমার! কিন্তু তারপরেও পথিক আমার কাছে অনেক কিছু। .... অনেক, অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ।....
পথিক হচ্ছে আমার নিত্য দিনের এক অনবদ্য ‘খোলা জানালা’র একজন সাথী। পথিক হচ্ছে সেই জানালার সহযাত্রী, যেখানে মুখ রাখলে আমি সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষা ভাষীদের খুব কাছে পেয়ে যাই। যেখানে মুখ রাখলে আমার হঠাৎ মনে হয় আকাশ জুড়ে বহুকাল পর চমৎকার বৃষ্টি নেমেছে। কিংবা হঠাৎ চাঁদ উঠেছে জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় পৃথিবী ভাসিয়ে....।
যেখানে মুখ রাখলে মনে হয়, আমিতো এই অনুপম কথামালার বিশালতার মাঝেই বাঁচতে চেয়েছি চিরকাল। আমি তো তীক্ষ মন্তব্যের এই সুতীব্র রোদ, অপরূপ আলাপচারিতার এই অপূর্ব বৃষ্টিকেই বলতে চেয়েছি ‘প্রিয় জীবন’-‘প্রিয় ভালবাসা’! আমিতো এমন একটি প্রিয় প্রাঙ্গনেই লুটিয়ে দিয়েছি আমার শব্দমালার সকল আকুলতা, যেখানে অনেকদিন পর পর লগ-ইন করলে আবেগে আনমনে বলে উঠি, “কী আশ্চর্য্য, কী আশ্চর্য্য, এই তোমার কাছ থেকে কীভাবে কেমন করে মাঝে মাঝে এতোটা দূরে থাকি, প্রিয় সামহয়্যার ইন ব্লগ ?...”
হ্যাঁ, শেষপর্যন্ত বাসার কাউকেই আমি কিছু বললাম না। পথিক আমার সামহয়্যার ইন ব্লগের সহগামী ব্লগার লেখক, এটি ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে সময় লাগবে অনেক। আমি তাই সে চেষ্টা বাদ দিয়ে আবার ফোন করলাম পথিকের মোবাইলে। এবার আর ফোন ধরলোনা কেউ। শুধু ইংরেজীতে মোবাইল সংযোগ দেওয়া যাচ্ছেনা, সেই মেসেজটা শোনা গেল।
আমি আশংকার দোলায় দুলতে লাগলাম। যদি মোবাইলটা ছিনতাই-ই হয়, তবে পথিক-কি ভালো আছেন? তার কোন দুর্ঘটনা ঘটেনিতো? অনেকসময় ছিনতাই-এর ঘটনার সময় বাঁধা দিলে অনেক অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনাও ঘটে যায়। পথিক এর আবার তেমন কিছু হয়নি তো?
আমি কাকে বলবো? কার কাছে যাবো? কার কাছে গেলে আমি তার সঠিক খবর পেতে পারি? তার আর কোন ঠিকানা বা কন্টাক্ট নাম্বার তো আমার কাছে নেই ! তাহলে এখন এই রাত প্রায় বারোটায় আমি আর কি করতে পারি?
পথিক আমার বন্ধু নয়, ভাই নয়, কলিগ নয়, আত্মীয়ও নয়। তবুও সে আমার আত্মার পরমাত্মীয়। সে আমার প্রিয় শব্দমালার সহযাত্রী। সে আমার প্রিয় কবিতার প্রিয় পাঠক । সে আমার প্রিয় সামহয়্যারের নিত্য কথামালার সঙ্গী। আমি যে তার কোন অমঙ্গলের কথা ভাবতেই পারিনা !
পথিক এর স্থানে অন্য কোন ব্লগার হলেও আমার অনুভব হতো এরকমই। যদি পথিক এর স্থানে থাকতো সেই হ্যান্ডসাম বয় আবু সালেহ, যদি থাকতো মুদু হাসির ট্যালেন্টেড শামীম, যদি দেখতাম জ্ঞানগর্ভ চোখের সামী মিয়াদাদ কিংবা কৌতুক মেশানো দুষ্টু হাসির রাতমজুর- তাহলেও তাদের কেন্দ্র করে আমার অনুভব হতো এক রকমই। প্রত্যুতপন্নমতি, লুলুপাগলা, সুখিমানুষ, জয়িতা, আইরিন, অ্যামেটার, নাঈম, সাতিয়া মুনতাহা , ইমন, সারিয়া, পিয়াল, জলিল, শাহানা, সাদিক, ধূসর গোধূলী, কালপুরুষ, সাজি –সামহয়্যারের আবেগময় অনবদ্য বাগানে ফুটে থাকা এরকম থোকা থোকা নামের যে কেউই বিপদে পড়লে আমার অনুভব হয়তো কেঁদে উঠতো এভাবেই।আমার ভালবাসার বিশাল রাজ্যে প্রজ্জ্বোলভাবে ফুটে থাকা একটি গোলাপও যেন বিবর্ণ না হয়, আমার প্রতিদিনের প্রিয় জানালায় দেখা একটিও রজনীগন্ধার ষ্টিক যেন ঝরে না যায় কোন অপ্রত্যাশিত আকস্মিকতায়, আমার সকল চাওয়া তো আকাশমুখী হয়েছে সেই প্রলম্বিত প্রত্যাশা নিয়েই !
পথিক- তাই যেন একটি দুর্ঘটনার প্রতীক হয়ে আমার ভেতরে জ্বল জ্বল করে জ্বালিয়ে দিলো ব্লগারদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার চিরপ্রস্তুত সলতেটিকে। আমার বাসা, আমার পরিবারের যে কেউ বিপদে পড়লে আমি যে টেনশান , যে আকুলতা অনুভব করি পরতে পরতে, সেদিন পথিকের ক্ষেত্রেও তার কোন কমতি ছিলোনা। আর এ কারণেই, রাত দেড়টার মধ্যেই সে বাসার একটি পিসিতে অনেক সমস্যার মাঝেও নানা ঝামেলা করে মোবাইলের ‘এজ’ কানেকশানের মাধ্যমে যুক্ত হলাম ইন্টারনেটে, তারপর প্রায় রাত দু’টার দিকে ঢুকে পড়লাম প্রিয় প্রাঙ্গণ- সামহয়্যারইন ব্লগে। দেখলাম- অনুমান আর আশংকা- সবই সত্যি হয়েছে। পথিক এর মোবাইলটি ঠিকই ছিনতাই হয়েছে। তাই তিনি পোষ্ট দিয়েছেন “এইমাত্র মোবাইল বিয়োগ ঘটলো, ছিনতাই না চুরি, বুঝতে পারছিনা”..
পথিকের সেই পোষ্টে সেই মুহূর্তে আমার কোন মন্তব্য লিখতে ইচ্ছে হলোনা। ইচ্ছে হলোনা তাকে কোন সান্ত্বনার বাণী শোনাতে। আমার হৃদয়ে তখন ফল্গুধারার মতো একটি অপরূপ স্বস্তির হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আমার সুনীল সমুদ্রে তখন অপরূপ আনন্দের জোয়ার- “পথিক ভাল আছে! পথিক ভাল আছে!! কিছু ক্ষতি, কিছু বিপদে পড়লেও পথিকের শারীরিক কোন ক্ষতি হয়নি। সে ভাল আছে !”
আর পথিক ভাল থাকা মানে আমার সামহয়্যার-ইন-ব্লগের আর সব ব্লগার বন্ধুরাও ভাল আছে। ভাল আছে সেই প্রিয় জানালাটা । সামহয়্যার ইন ব্লগের সেই অনবদ্য আবেগময় অপরূপ এক জানালা। যেখানে কাল সকালে মুখ রাখলেই হয়তো দেখতে পাবো সুন্দর এক কবিতার সাজি নিয়ে অপেক্ষা করছেন সুলতানা শিরীন সাজি। হয়তো বলছেন, ‘সুনীল সমুদ্র, আপনার জন্য বরফদেশ থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি শুভেচ্ছা!’
হায়! এমন শুভেচ্ছা তো পাঠাতে পারে সেই সব অপরূপ মানুষেরাই।
যারা চোখ রাখে প্রতিদিন- প্রিয় এক জানালায়।
যাদের সকল আবেগে মিশে থাকে অনির্বাণ এক প্রশ্ন অণুক্ষণ-
“তুমি ভালো আছো? তুমি ভালো আছো, প্রিয় সামহয়্যার ইন?”
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৮ রাত ১:১৫