শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীদের মধ্যে পাঁচজনের প্রাণদণ্ড কার্যকর হৈল। বলা হয়, প্রাণদণ্ড একটি প্রতিশোধমূলক শাস্তিবিধান, ফলে অনেক দেশে প্রাণদণ্ডের বিধান রদ করা হয়েছে। আবার বলা হয়, শাস্তির উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ সংশোধন, কিন্তু কীসের সংশোধন? যিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলেন তার নিশ্চয়ই! আবার এই শাস্তিযোগ্য অপরাধ যদি "ক্ষমা"র অযোগ্য না হয়? তাহলে সংশোধনে কি বা লাভ? .....
ব্লা ব্লা ব্লা.....
এই ধরনের তর্কে একটা সার্কুলার রিজনিং তৈরি হয়। ফলে, প্রথম সোজা যে রাস্তাটা দেখা যায় সেইটা ধরেই এই গোলক ধাঁধা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি।
শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীদের এই প্রাণদণ্ডের শাস্তি প্রতিশোধমূলক নয়। প্রতীকী। আবার এই প্রতীক পরিকল্পিত নয়, অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে এই ঘটনায় বেসামরিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তার বিনীত দম্ভ প্রকাশ করল। কার সাথে?
মানস সেটা রাইসুর নোটে বলেছেন। একমত। সামরিকতন্ত্রের সাথে। যদিও আমাদের সেনাতন্ত্র লিবারাল-কর্পোরেট-এক্সট্রিম নানা ফর্মে আরো বহুদিন সিন্দাবাদের বুড়ার মত রাষ্ট্রের ঘাড়ে সওয়ার হয়েই থাকবে, তবু তাকে একটু ঐতিহাসিক অস্বস্তির মধ্যে ফেলবে এই ফাঁসি।
আমার অস্বস্তি অন্যত্র। এই ঘটনাটা আমার মধ্যে এক বিচিত্র বিপর্যয় তৈরি করছে। এই বিপর্যয় মূলত স্মৃতির গঠনের সাথে ভিজুয়াল বাস্তবতার সংঘর্ষজাত, অনুমান করি।
যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করেছিল, খুন করার পর এর মজুরি হিসাবে দেশে বিদেশে পুরষ্কৃত হয়েছে, বিভিন্ন সভায় সাক্ষাৎকারে ওয়েবসাইটে এই খুনাখুনিকে সদম্ভে জাস্টিফাই করে চলেছে..... এই দলটির ছবি এভাবেই আমার স্মৃতিতে। আর যারা ফাঁসিতে ঝুলল, তাদের কাকুতি, দেশ-দেশান্তর, এবং নির্জীব বার্ধক্য... এটা এদের ব্যাপারে আমার বর্তমানের পারসেপশন তৈরি করে। ফলে আমার মনে হতেই থাকে যে, যে বজলুল হুদার ব্রাশফায়ারে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েছিলেন, সেই বজলুল হুদা এবং ফাঁসিতে ঝুলতে যাওয়া বজলুল হুদা এক ব্যক্তি নয়। যে যৌবন, সামরিকতা এবং দম্ভ এই ভয়াবহ খুনাখুনির লিগ্যাসীকে বহন করে গেছে দীর্ঘ তিন দশক অব্দি -- এই ফাঁসি যেন তার অট্টহাসি ম্লান করে দিতে পারল না। বরং এই ফাঁসি রিচুয়ালিস্টিক নিষ্ঠার সাথে জগতে মূল্যহীন হয়ে পড়া কিছু বুড়াকে এই "দেশে দেশে ভ্রমি" দশা থেকে মুক্তি দিয়ে দিল।
আরেকটু কনক্রিট দৃষ্টান্ত দেই: এসব আত্মস্বীকৃত খুনীদের মধ্যে একমাত্র মেজর ডালিমের ফটৌগ্রাফের কোনো আপডেট চোখে পড়ে না। অন্যদের ক্ষেত্রে যেমন তারা ধরা পড়ার আগেও তাদের বর্তমানের ফটো দেখা গেছিল, ডালিমের ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। ফলে এদের ছবি যখন একসাথে ছাপা হয়, আমার বিপুল অস্বস্তি লাগে। মনে হয় এই সব বুড়ারা সবাই মিলে ডালিমের যৌবনকে পাহারা দিতেছে। তারা যেন তাদের যাবতীয় অপরাধ ডালিমের জিম্মায় রেখে দিয়েছে! আর সেসবকে সাথে নিয়ে ডালিমের খুনী যৌবন চিরকালের জন্য অধরা হয়ে গিয়েছে।
ফলে এই ফাঁসি প্রতীকী। তাকে ঘিরে আনন্দ বেদনার বিস্তারও রাজনৈতিক। এ নিয়ে আমার এর বেশি পর্যবেক্ষণ নাই। কিন্তু ডালিম সন্ধানে রাষ্ট্র যে তার কূটনৈতিক প্রতিভা ব্যয় করবে তাতে আমি খুশি। ওকে ধরতে পারলে আমার স্মৃতিসংক্রান্ত বিপর্যয়টুকুর অন্তত উপশম হবে। এই গ্রুপ ছবিটা আমি ভুলতে চাই, যেখানে জবুথুবু বুড়াদের মাঝখানে মেজর ডালিম তার সময়কে ১৯৭৫ এ থামিয়ে রেখেছে।