নব্বই দশকের “ডার্ক জাস্টিস” নামের টিভি সিরিয়ালটির কথা মনে পড়ে? বিচারক নিক মার্শালের পরিবার নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর খুনীরা আইনের ফাঁক গলে তার এজলাশ থেকেই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তাই বিচারক নিক মার্শাল, যিনি আগে আবার পুলিশেও চাকরি করতেন, তিনি রাতের অন্ধকারে আইন নিজের হাতে তুলে নেন। আর আমরা যারা সমব্যথী দর্শক তারা নিক মার্শালের এই আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাটিকে নৈতিক সমর্থন দিতে থাকি। মনে রাখতে হবে, নাটকে নিক মার্শাল কিন্তু এক বিচারক, আবার তিনি সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাও। নিক মার্শালের বিচারক পরিচয় তার কর্মকাণ্ডের পক্ষে আমাদের নৈতিক সহানুভূতিকে আরেকটু বৈধতা দেয়। অর্থাৎ যেহেতু নিজেই তিনি বিচারক ফলে তার পক্ষে অপরাধী আর নিরপরাধের ফারাক বোঝা সম্ভব। কিন্তু সেই সাথে তার "সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা" পরিচয়টির মাধ্যমে "ডার্ক জাস্টিস" নিশ্চিত করবার নৈতিক অধিকার বিচার বিভাগ থেকে নির্বাহী বিভাগে স্থানান্তরিত হয়।
ক্রসফায়ার-সংস্কৃতি বাংলাদেশে চালু হয় ঠিক তার এক দশক পর ২০০২ সালে, অপারেশন ক্লিনহার্ট-এর মাধ্যমে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছিল অনেক আগে ১৯৭৩ সালে নকশাল দমনের পুলিশি কৌশল হিসাবে। আবার ১৯৭৫ সালের সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডটির আদলটিকে বর্তমান ক্রসফায়ারের পূর্বসূরী গণ্য করা যায়। সেই অর্থে নিখিল বঙ্গীয় ঐতিহ্য অনেকখানিই ধরে রেখেছে হালের এই ক্রসফায়ার, কারণ তা সম্ভবত সবচে বেশিবার প্রযুক্ত হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের চরমপন্থীদের বিরূদ্ধে। কিন্তু অতীতের যে কোন দৃষ্টান্ত থেকে বর্তমানের এই ক্রসফায়ার গুণে, পরিমাণে এবং পরিণামে যে অনেক ভিন্ন তা বোঝার জন্যই এই লেখার অবতারণা।
প্রথম আলো-র এক সাম্প্রতিক জরিপে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সবচে জোরালো যে মতটি খেয়াল করা যায় সেটা হল, ক্রসফায়ারে দাগি সন্ত্রাসীকে মেরে ফেলা হলে সমস্যা নাই। নিরপরাধ লোক মারা গেলেই সমস্যা। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে ক্রসফায়ার করা হয়েছে যাদের বিরূদ্ধে পরে কোনো দাগ পাওয়া যায় নি। বাপী হত্যাকাণ্ড এর সাম্প্রতিকতম নমুনা। ফলে সমাজের একাংশ মনে করেন যে ক্রসফায়ার বন্ধ করা এ জন্যই উচিৎ যে এতে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এই যুক্তিটি কিন্তু ক্রসফায়ার সম্পাদনকারী বাহিনির হত্যা করবার এখতিয়ারকে প্রশ্ন করে না, বিচারে “নির্ভুল” থাকার ক্ষমতাকে সন্দেহ করে মাত্র।
ক্রসফায়ার নিয়ে জনমতের এই মিশ্র দশাটি তৈরি হয়েছে কেন? এক, এলিট ফোর্স র্যাবের ব্যাপারে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে সমাজে। সেটা হয়েছে সাবেকী পুলিশ বাহিনীর ঢিলেঢালা দশার বিপরীতে র্যাবের কমাণ্ডো-ব্রান্ডিং এবং কর্মতৎপরতার ডিসপ্লে থেকে। ফলে শহরের মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবর্গের চোখেও র্যাব শুধু হুকুম-তামিল করা কোনো বাহিনি নয়, বরং এমন এক বাহিনি যে কিনা স্বয়ম্ভূ বিবেক দিয়ে পরিচালিত হয়। কড়াইল কিংবা ধলপুর বস্তিতে মাস্তানদের উৎপাত যে র্যাবের দৌরাত্ম্যেই কমেছে একথা বস্তিবাসীরা জোরগলায় বলে। আর দ্বিতীয় ফ্যাক্টরটা তৈরি হয়েছে বিচার বিভাগের ওপর বিদ্যমান অনাস্থার ফলে। মজার বিষয় হল, এই অনাস্থার জন্য বিচার বিভাগ দায়ী নয়, কারণ সে কখনই স্বাধীনভাবে ক্রিয়াশীল হয় নি। কিন্তু আমরা বিচার বিভাগের সদিচ্ছা আর ক্ষমতাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছি সে স্বায়ত্তশাসিত হবার আগেই। এভাবে আইনের শাসন আমাদের সামনে ইউটোপিয়াই রয়ে গেছে। এই দুই ফ্যাক্টর ক্রসফায়ারের মত ব্যবস্থাকে ব্যবহারিক অনুমোদন দেয় কারো কারো বিবেচনায়।
এখন কথা হচ্ছে, ক্রসফায়ার কি শুধু হত্যারই মামলা? তাহলে ঈদমৌসুমে বরিশালগামী লঞ্চডুবির সাথে এর পার্থক্য কি? কেউ বলবেন, পার্থক্য এটাই যে ক্রসফায়ার কেবল সন্ত্রাসীদের বিরূদ্ধে ব্যবহৃত হয়। সন্ত্রাসীকে মেরে ফেলার অধিকার রাষ্ট্র সংরক্ষণ করে কিনা সেটা নিয়ে প্রচুর আলাপ হয়েছে অতীতে। তবে সন্ত্রাসীর মৃত্যুকে ভিজুয়াল প্যাকেজ বানিয়ে টেলিভিশনে বা পত্রিকার পৃষ্ঠায় ছেড়ে দেয়ার রাজনীতি কিন্তু ভিন্ন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে, ক্রসফায়ার সমাজে মোটামুটি তিন ধরনের সংক্রমণ করছে: হত্যার, মিথ্যার এবং আতঙ্কের। একটি সত্য হত্যাকাণ্ডের পর প্রচারমাধ্যমগুলো উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতরে উপহার দিচ্ছে একটি সার্বজনীন মিথ্যার প্যাকেজ। একেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটবার পরে যে সংবাদটি বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয় তার মুখস্থ ফর্ম্যাট (অপরাধীসহ অস্ত্র উদ্ধারে যাওয়া > সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা সহযোগীদের হামলা > আত্মরক্ষার্থে র্যাবের পাল্টা গুলি > অপরাধী হত) থেকে আমরা সহজেই বুঝি যে, হত্যাকাণ্ডের মত এই মিথ্যাকাণ্ডেরও পৃষ্ঠপোষকতা করছে স্বয়ং রাষ্ট্র। অর্থাৎ ক্রসফায়ার শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই নয়, বরং একটি হত্যাকে মিথ্যার বাতাবরণে প্রকাশ করার রাষ্ট্রীয় কৌশলও। হত্যার সাথে মিথ্যার এই মনিকাঞ্চনযোগে যা উৎপন্ন হয় তার নাম নিখাদ আতঙ্ক এবং তাকে বইয়ে দেয়া হচ্ছে সমাজের মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে। তার ওপর, এক বাপ্পীর বদলে অন্য বাপ্পীর ক্রসফায়ার সমাজে নিরাপত্তাহীনতার যে বোধ ছড়িয়ে দিচ্ছে তা সংঘহীন সাধারণ মানুষকে দাগি সন্ত্রাসীর চেয়ে কোনো অংশে কম আতঙ্কিত করছে না। এভাবেই ক্রসফায়ার জিনিসটা হত্যা, মিথ্যা এবং আতংকের ত্রিবেণী হয়ে উঠেছে। এটাই রাষ্ট্রীয়ভাবে ফ্যাসিবাদ কার্যকর করার পদ্ধতি, যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যা এই গোটা প্রক্রিয়ার একটি উপাদানমাত্র। কিন্তু এর উপজাত হিসেবে উৎপন্ন মিথ্যা এবং আতঙ্ক সমগ্র সমাজের উপর সুদূরপ্রসারীভাবে প্রযুক্ত হচ্ছে। সামাজিক সন্ত্রাসকে মোকাবেলা করতে গিয়ে বানানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দক্ষযজ্ঞে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা নেহাত অধস্তনের ভূমিকা পালন করছে। ক্রসফায়ার যেন দলীয় এজেন্ডার বাইরে! ক্রসফায়ারপ্রশ্নে দৃশ্যত কোনো মতবিরোধ নাই ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতা-হারানো দলগুলোর! কারণ, এহেন ব্যবস্থা দিয়ে বিদ্যমান সন্ত্রাসকে মোকাবেলার ডিসপ্লে করা সহজ, এবং এর ফলে সন্ত্রাসের অদৃশ্য উৎসকে (যা কিনা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক) পর্দার আড়াল করে রাখাও সম্ভব হয়। ফলে তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই যেন ক্রসফায়ারের একটা “লার্জার দ্যান লাইফ” ইমেজ খাড়া করাতে চান। যেন জনমানস ভেবে নেয় যে ক্রসফায়ার স্বয়ংক্রিয় একটা জিনিস, রাষ্ট্রক্ষমতার আধিকারিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে, মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের নাকের ডগা দিয়ে স্বয়ম্ভূ কোনো ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে!
এই লেখার শিরোনাম “ক”-তে ক্রসফায়ার। কেন? উইকিপিডিয়া খুলে দেখুন: ইংরেজি উইকিপিডিয়া যেখানে ক্রসফায়ারকে প্রথম মহাযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক রণকৌশল হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে, সেখানে বাংলা উইকিপিডিয়া বলছে “ক্রসফায়ার হল বন্দুকযুদ্ধের নামে কুখ্যাত অপরাধী বা অপরাধী সন্দেহভাজন বা অপরাধীগণ্য কোনো ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা”। ক্রসফায়ারপ্রশ্নে বাঙ্গালি জাতির মত উইকিপিডিয়া-পরিবারও যেন দ্বিধাগ্রস্ত! এক ভাষার অভিধানে ক্রসফায়ার তার সামরিক-ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে বিরাজিত, অন্যভাষায় দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রযত্নে তার ইম্প্রোভাইজড চেহারা! বিদ্যাজাগতিক বলয়ে তাকে নিয়ে আরো ভাবনাচিন্তার অবকাশ তৈরি হচ্ছে বোঝা যায়। আশা করা যায়, খুব শিগগিরই বাংলাদেশী তথা নিখিল বঙ্গীয় ক্রসফায়ার সংস্কৃতি ইংরেজি অভিধানেও আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক মসজিদের ইমামকে গুলি করে হত্যা করার পর আইনপ্রয়োগকারী বাহিনির সদস্যরা যে বিবৃতি দিয়েছে তা কিন্তু আমাদের ক্রসফায়ার-বয়ানের মিলে যায় বেশ। রমরমা রপ্তানির এই কালে ক্রসফায়ার প্রযুক্তিরও নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানচিত্রে আটকে থাকার কোনো কারণ নেই!
আমাদের দেশে এই ব্যবস্থার ভবিষ্যত কি? আগে ক্রসফায়ারের সাথে শুধু র্যাবের নামই শোনা যেত, এখন পুলিশের প্রযত্নেও “বন্দুকযুদ্ধ” বা “এনকাউন্টার” ঘটছে বলে জানা যায়। অর্থাৎ ক্রসফায়ার অপারেশনের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটছে। সেটা কোথায় গিয়ে থামবে? ক্রসফায়ার কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের অস্ত্র হয়ে উঠবে? ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্বের লড়াইকে কি ক্রসফায়ারে মোকাবেলা করা হবে? শিক্ষিত মধ্যবিত্তীয় অ্যাকটিভিজমের গায়ে ক্রসফায়ারের গরম নিঃশ্বাস পড়বে কবে? ক্রসফায়ারে বাপ্পী হত্যার মত “স্ট্যান্ডার্ড এরর” কি বাড়বে না কমবে? ক্রসফায়ারের ফলে সমাজ থেকে সন্ত্রাস কি নির্মূল হয়ে যাবে?
দ্য আনসার ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড!