somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আঁধারে ইরাবতীর আলো

১৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কাঠফাঁটা দুপুরের রোদটার তেজ অনেকটাই কমে এসেছে মনে হচ্ছে,সময়ের নিয়মে সূর্যটা এখন ফিরে যাবার পথে এগুচ্ছে। দিন শেষের এই সময়ে সবাই ই নীড়ে ফেরার পথে আছে,কিন্তু আজ যেনো রাজ্যের ক্লান্তি যেনো এসে ভর করেছে চোখে,এতোটা দুর্বল কেন লাগছে?দুপুরে খাওয়া হয়নি বলেই বোধহয়! আরশি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পা চালানোর চেষ্টা করতে করতে একটা সময় বাসার সামনে এসে পৌছায়। অভিদের বাসা থেকে তার বাসার দুরত্বটা এমন যে,না রিকশায় আসা যায়,আর না কম সময়ে হেঁটেও আসা যায়!বাসা থেকে বেরোবার সময় ইচ্ছে করলে দুপুরে খেয়েই বের হতে পারতো,কিন্তু খুব একটা ক্ষুধা ভাব মনে হচ্ছিলো না দেখে এসেই খাবে,ভেবে বেড়িয়ে গিয়েছিলো টিউশনীর উদ্দ্যেশ্যে।
বাসার দরজার সামনে এসে কলিংবেলে চাপ দিতে যাবে ঠিক তখনই কানে ভেসে আসল,কান্নার শব্দ!আরশি কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এই মূহুর্তে তিনতলায় উঠার মতো অবস্থা নেই তার,কিন্তু কান্নার শব্দটা খুব করে যেনো বাঁধছে বুকে! ভাবতে ভাবতে কখন যে তিন তলায় উঠে এসেছে সে টেরই পায়নি!কলিংবেলে কয়েকবার চাপ দিলো একসাথে,দরজা খুলে দিতেই কান্নার শব্দটা আরো জোরে ভেসে আসল,আরশি নিজের ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-কি হয়েছে গো?এতো কান্না কেন?!হুম?
বলতে বলতে দু'হাত সামনে বাড়তেই কোলে চলে আসল,৮মাস বয়সি ইরা। আরশি ওকে কোলে নিয়ে বুকে চেঁপে ধরলো,
-কি হয়েছে ইরাবতী?কাঁদছো কেন?কেন এতো দুঃখ আপনার চোখে?
ছোট্ট ইরা কি বুঝলো কে জানে,আরশিকে দেখে মনে হলো,তার প্রাণ ফিরে এসেছে,অস্পষ্ট সব শব্দে কি কি যেনো ঠোঁট ফুলিয়ে বলতে লাগল,যেনো কতো কথা তার আরশির সাথে!
আরশি মুচকী হেসে আবারো বুকে জড়িয়ে ধরলো। কাজের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো,
-সকালে যে খিঁচুরী রেখে গিয়েছিলাম,দুপুরে খাইয়েছিলে তা?
-সেটা খাওয়ানোর চেষ্টাই তো করতেছি! কিন্তু কিছুই তো খাইতে চায় না আমার হাতে!
-হুম,আচ্ছা,বাটিটা নিয়ে একটু আমার সাথে নিচে আসো,আমিও দুপুরে খাইনি কিছু,আমি খেতে খেতে ওকে খাওয়াবো,ঠিক আছে?
মেয়েটা মাথা নেড়ে রাজী হলো। সে ও মনে হলো হাফ ছেঁড়ে বেঁচেছে! ইরাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে ক্লথ বিছিয়ে বিছানার মাঝখানে বসাতে বসাতে নীচু স্বরে বলল,
-ইরাবতী,গুড গার্লের মতো এখানে বসে থাকো ওকে?খালামণি,হাত মুখ ধুবো,তারপর আমরা একসাথে খাবো,ঠিক আছে?একদম নড়াচড়া করবে না কিন্তু হুম?
কিন্তু ইরাকে রেখে আরশি দু'কদমও আগাতে পারলো না,মেয়েটা হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত বিছানার কিনারে চলে আসল!বাধ্য হয়ে সে বিছানায় বসলো,
-ওরে ইরাবতী?এতো চঞ্চল হলে হবে?খালামণি অনেক টায়ার্ড যে,খুব ক্ষুধা লেগেছে তো?একটু বসো মা,আমি এক্ষুনি আসছি!
ইরা ততোক্ষনে আরশির চুল নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে! ওদের কথার শব্দে বিছানার ওপাশে শুয়ে থাকা তিথীর ঘুম ভেঙ্গে গেছে ততোক্ষনে,সে এপাশ ফিরে আরশির দিকে তাকিয়ে বললো,
-ওকে আবার এখন আনার কি দরকার ছিলো?
-খুব কাঁদছিলোরে,কিচ্ছু খায়নি দুপুরে,তাই নিয়ে আসলাম!
অনেকটা কৈফিয়ত দেবার মতো করে বললো আরশি। তিথী কপাল কুঁচকে বললো,
-কেন ওদের কাজের মেয়েটা কি করে?আস্ত ফাঁকিবাজ একটা!একটা ঘন্টাও সামলাতে পারে না ওকে!আর তুমিও একজন,সারাক্ষন নিজের কাছে রাখো,বদঅভ্যাস হয়ে যাচ্ছে তো,পরে কিন্তু আর দূরে রাখতে পারবে না,দেখো!
আরশি কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। তিথী সব সময় এমনই করে,বাচ্চাদেরকে ওর খুব একটা পছন্দ না,আর তাই ইরা কে বাসায় দেখলেই এমন অনেক মন্তব্য করবে! বড় বোনকে চুপ থাকতে দেখে,শোয়া থেকে উঠে বসল, আগের মতো গলায় ঝাঁঝ নিয়েই বললো,
-বসে আছো কেন?আমি উঠেছি তো,যাও এখন,হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও আমি দেখছি ওকে। এই যে আহ্লাদী বেগম,আসেন এদিকে,ওরটা ছেড়ে এখন আমার চুল ছিঁড়েন!
ইরা ভূবন ভুলানো হাসি দিয়ে তিথীর দিকে দৌড়ে গেলো,আর তা দেখে তিথীও বিরক্তি ভুলে হাসতে লাগল!

গত চারমাস যাবত আসিফ আপ্রাণ চেষ্টা করে অফিস থেকে যতোদ্রুত সম্ভব বাসায় ফেরার। কিন্তু যতো দ্রুতই বের হোক না কেন,জ্যাম পেড়িয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যে হবেই! আজো আধা ঘন্টা যাবত জ্যামে বসে প্রচন্ড ভাবে রাগে ফুঁসছিলো,হঠাত মোবাইলটা বেজে উঠলো,হাতে নিয়ে দেখলো বড় খালার ফোন। রিসিভ করে সালাম বিনিময়ের পর খালা জিজ্ঞেস করলেন,
-কিরে তুই এখনো বাইরে?
-হ্যাঁ খালা,অনেক জ্যাম রাস্তায়!
-হায়রে,ওদিকে মেয়েটা না জানি কি করছে!আমি ফোন করেছিলাম,কাজের মেয়েটা বললো,বাড়ীওয়ালার মেয়েটা নাকি এসে নিয়ে গেছে ওদের বাসায়,আচ্ছা আসিফ,এভাবে আর কতোদিনরে?এভাবে কি চলে?
আসিফ চুপ থেকে বলল,
-আমি তো চেষ্টা করছি,ট্রান্সফার হয়ে বাসার কাছাকাছি পোষ্টিং নিতে,হয়ে গেলে খুব একটা চিন্তার কিছু নেই আর!তখন ইরা কে সামলাতে বেশি সমস্যা হবে না।
-গাধার মতো কথা বলিস না!একটা বাচ্চা কিভাবে পালতে হয় জানিস কিছু?মা ছাড়া বাচ্চা মানুষ করা যায়?বাসায় একজন মুরুব্বী নেই,নিজে থাকিস অফিসে,ঐটুকু দুধের বাচ্চাটা কি করে সারাদিন থাকে কাজের মেয়ের কাছে শুনি?''
এই জাতীয় কথা গত চার মাস ধরে শুনতে শুনতে আসিফ ক্লান্ত হয়ে গেছে!চারপাশে সবার একই কথা,'আবার বিয়ে করো,আর কিছু না হোক,মা মরা বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হলেও!' কিন্তু আসিফ কোন কিছু ভাবতে পারে না!
আর কি করেই বা পারবে? কলেজে থাকতে সে নিজেও মাকে হারিয়েছে,ক'দিন পর ভাই-বোনের দিকে তাকিয়ে বাবা বিয়ে করেছিলেন,কিন্তু তারপরের দিন গুলো ওদের জন্য সুখের ছিলো না!সৎ মায়ের সংসারে একের পর এক অশান্তির কারণে বাধ্য হয়ে মা হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলো সে। তারপর বলতে গেলে একাই কাটিয়েছে অনেক গুলো বছর। পড়াশুনা শেষ করে চাকরী নেয়ার বছর খানেক পরেই বড় খালা বিয়ে দিয়েছিলেন মিরার সাথে।
আসিফের মনে হয়েছিলো এতো বছর করা কষ্টের বিনিময়েই বোধ করি আল্লাহ তার জীবনে সুখ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন,তার জীবনে দিয়েছিলেন মিরার মতো কাউকে,যাকে নিয়ে আসিফ নতুন করে শুরু করেছিলো সব কিছু।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছে বোধহয় তা ছিলো না,আর তাই তো আসিফকে রেখে,সাজনো সংসার রেখে,ইরার মতো একটা ফুঁটফুঁটে পরীকে রেখে চারমাস আগে রোড একসিডেন্টে মিরা চলে যায় চিরদিনের জন্য।
আসিফ ইরার মুখের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলো আবারো বিয়ে করার কথা,কিন্তু নিজের জীবনের দুঃসহ দিন গুলোর কথা মনে করে সাহস পায়নি! নিজের ফেলে আসা অতীতের মতো ইরার জীবনটা হোক তা চায়নি সে। অন্যদিকে ঠিক মতো ইরার যত্ন নিতে পারছে না দেখে মনে মনে আফসোস আর অপরাধবোধেরও শেষ নেই তার! কি এক উভয় সংকটের মধ্যে সারাটা সময় পার করছে সে!

ইরার মুখটা অসম্ভব মায়াবী মনে হয় আরশির কাছে,ঠিক ওর মায়ের মতো হয়েছে। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালেই মনটা ভরে যায় যেনো,এমন মায়াবতী একটা মেয়ে এই অবুঝ বয়সেই মা কে হারিয়েছে,ভাবতেই বুকটা কষ্টে ভরে যায় আরশির।সে ইরার নাম দিয়েছে 'ইরাবতী',ইরা-মায়াবতীর সংক্ষিপ্ত রূপ।ইরাবতীর দিকে তাকালে আরশির মনের চোখে আরেকটা মুখ ভেসে উঠে! অনেক বছর আগের সেই ছোট্ট 'রাত্রীর' মুখটা।
৮বছর বয়সে ক্যান্সারে নিজের মা কে হারিয়েছিলো আরশি,ছোট বোন রাত্রীর বয়স তখন দেড় কি দুই বছর। আরশির এখনো মনে আছে,আম্মু মারা যাবার ক'দিন পর এসে নিঃসন্তান সেঝ খালা রাত্রীকে নিয়ে চলে যান সুদূর লন্ডনে। যাবার সময় ওর কোল ছেড়ে যেতে চাইছিলো না রাত্রী,খালা এক রকম জোর করেই নিয়ে গিয়েছিলেন...!! আজ এতো গুলো বছর পরেও কাঁদতে থাকা সেই ছোট্ট নিস্পাপ রাত্রীর মুখটা আরশির মনে ভাসে! বছর খানেক পর বাবা বিয়ে করেছিলেন আবার,কিন্তু রাত্রীকে আর ফিরিয়ে আনা হয়নি,কতো রাত যে বোনের জন্য চুপিচুপি কেঁদে কাটিয়েছে তা শুধু সে ই জানে। একসময় তিথী আসল দুনিয়ায়,ওকে কোলে নিয়েই রাত্রীর জন্য হাহাকার করা বুকে স্বান্তনা খুঁজে ফিরেছে আরশি।
কিন্তু কেন জানি মনে হয়,আজ এতো বছর পরে এসে সে যখন ইরাকে বুকে চেপে ধরে,কেমন জানি পূর্ণতা অনুভব করে যেটা অনেক বছর আগে রাত্রীকে কোলে নিলে মনে হতো! আর তাই যতক্ষন সে বাসায় থাকে,যতক্ষন ইরাবতীর বাবা না আসে,ততোক্ষন সে ইরাকে নিয়ে সময় কাটায়। যদিও আশে-পাশের লোকজন,এমনি আম্মা-তিথীও বিষয়টা বেশি ভালো চোখে দেখেন না,খুব বিরক্ত বোধ করেন,তার উপর আরশি নিজে একটা অবিবাহিত মেয়ে হয়ে,আরেকজনের বাচ্চার জন্য এতো দরদ বোধ করবে,এই বিষয়টা সবাই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে! আরশি সবই বুঝে কিন্তু সেসবে মাথা ঘামায় না!তার ইরাবতীর মুখের হাসি দেখলেই সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।
আরশি জানে না,ইরার জন্য ওর এই ভালোবাসাটাকে কি বলবে?কিংবা ইরার বাবা যখন আবার বিয়ে করবেন,তখন ইরাকে ছাড়া সে কিভাবে থাকবে! কিন্তু এতটুকু সে বুঝে,তার নিঃসঙ্গ আর কষ্টের আঁধারে জমা এই জীবনটাতে ইরাবতী হচ্ছে একখন্ড চাঁদের হাসি!
আসিফ বরাবরের মতোই খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে তিথীদের বাসার কলিংবেল চাপল। এই পরিবারে কোন ছেলে নেই বলে,চাচা ছাড়া আর কারো সাথে খুব একটা কথা তার কখনো হয়নি,যদিও মীরার সাথে চাচার বড় মেয়ে আরশির খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো,সেই সুবাদেই ইরা কে সে আরশির কাছে থাকতে দেয়। কিন্তু তার সাথে কখনোই খুব একটা কথা তার হয়নি।
দরজা খুলেই ক্লাস এইটে পড়ুয়া তিথী আসিফকে দেখে বরাবরের মতো হড়বড় করে বলা শুরু করলো,
-এই আপনার আসার সময় হলো?আপনার মেয়েটা তো আমার বোনকে জ্বালিয়ে শেষ করে ফেলছে,আরেকটু হলে পাগল বানিয়ে ছাড়তো!!কি যে দস্যি মেয়ে আপনার,উফফ...নালিশ দিয়ে শেষ করা যাবে না,বুঝলনে?
আসিফ মুচকি হেসে বলল,
-ভাগ্যিস,তোমাকে জ্বালায় না!যাইহোক,কোথায় সে,দাও নিয়ে যাই'' আসিফের কন্ঠ শুনে আরশি তিথীকে ডেকে বলল,ইরা এখন খাচ্ছে শেষ হলে উপরে দিয়ে আসবে। আসিফ উপরে চলে গেলো,ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে তার মনে হলো,যা খাচ্ছে তার চেয়ে না খাওয়াই ভালো!!এইরকম খাবার এর চেয়ে হোটেলের রান্নাও অনেক ভালো! ভাগ্যিস,আরশি ছিলো,না হলে ইরাটা কে যে কি খেয়ে দিন কাটাতে হতো কে জানে!আসিফ ভাবতে ভাবতে কিছুটা অবাক হয়!!তিথীকে যেমন দেখেছে,আরশি মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ তার বিপরীত। খুব চুপচাপ,আর আত্ননির্ভর্শীল মনে হয়েছে,আজ এতো গুলো দিন ধরে সে ইরাকে সঙ্গ দেয়,রাত নেই দিন নেই,যখনই দরকার হয় ইরার জন্য হাজির কিন্তু কোন দিন বিরক্তির কোন ছাপ দেখেনি সে! মেয়েটা বেশ ভালোই,কিন্তু শুধুমাত্র ইরার জন্যই হয়তো।

আরশি গত দু'দিন যাবত বলতে গেলে সারাটা সময় ধরেই বারান্দায় বসে আছে!! সারাটা ক্ষন সে অপেক্ষায় আছে,কখন কলিংবেলটা বাঁজবে! দু'দিন আগে ইরাকে নিয়ে খালার বাসায় গেছে আসিফ,খালা ইরাকে দেখতে চেয়েছেন তাই। কথাটা শুনে আরশির খুব রাগ লেগেছে!''কেন যাবে ইরাকে নিয়ে?নিজে যাচ্ছে যাক,ইরাকে নিয়ে কেন যাবে?'' পরক্ষণেই আবার মনে হয়েছে,তার মেয়ে সে নিয়ে যেখানে খুশী যাবে,এতে আরশির রাগ হওয়ার কি আছে?! কিন্তু ইরাকে না দেখে থাকতে হবে মনে হতেই বুকটা বার বার গুমরে কেঁদে উঠছিলো!যাওয়ার সময় লজ্জার মাথা খেয়ে আরশি নিজেই আসিফের কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার চেয়ে রাখে,আর দু'দিনে কতো বার যে সে আসিফকে ফোন করেছে তার হিসেব নেই!!
''ইরা কাঁদছে কি না,ইরা খেয়েছে নাকি,ওর খিঁচুরীতে ঝাল যেনো দেয়া না হয়'' এমন হাজারো খবর বলার-জানার জন্য,ইরার কন্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থেকেছে আরশি। ইরাকে ছাড়া পুরো বাসাটাই ওর কাছে অসহ্যকর ঠেকছে যেনো!ওর এমন ছটফটানি দেখে আম্মা-তিথি খুবই বিরক্ত! এমন করছে কেন মেয়েটা?মনে হচ্ছে সে ই ইরার মা!কলিংবেলের আওয়াজ শুনলে ওর ছটফটানি দেখে তিথী বলেই ফেলেছে,
'মনে হচ্ছে,তোমাকে ইরার বাবার সাথে বিয়ে দিতে হবে!!আগেই বলেছি,এতো মায়া বানিও না পরের মেয়ের জন্য,নাহ শোননি,এখন বুঝ!' ওর সাথে সায় মিলিয়ে আম্মাও বলেছেন,'আমিও কতো না করেছি,কিন্তু এই মেয়ে তো শোনেই না কারো কথা!মেয়ে মানুষের মন হচ্ছে মায়ের মন,বাচ্চার জন্য মায়া লাগবেই,কিন্তু তাই বলে আরেকজনের বাচ্চার জন্য??এসব পাগলামী বন্ধ কর,না হলে কিন্তু ঝামেলায় পড়বি!''
ওদের কথার কোন জবাব আরশি দেয়নি। কি বলবে সে?সে নিজেও তো অবাক!এমন কেন করছে সে? তার ইরাবতী আরেকজনের বাচ্চা,ওর কোন দরকার নেই এতো ব্যাকুল হবার,কিন্তু সে কেন পারে না?কেন ইরার কান্না শুনলে অস্থির হয়ে যায়? আরশি লাইট অফ করে বারান্দায় বসে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে! ওর বারবার মনে হয়,ইরার সাথে ওর রক্তের সম্পর্ক নেই তো কি হয়েছে,আত্নার টান আছে!ইরাকে দেখলে,নিজের মা হারানোর কষ্টটা কমে আসে,ছোট বোন রাত্রীকে ছাড়া থাকার কষ্টটা কম অনুভব হয়,অন্যদিকে ইরাও ওকে দেখলে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠে,মা কি জিনিস এই বাচ্চা না বুঝলেও বার বার ওকেই মা মা বলে ডাকে,একটা বাচ্চা যতোই অবুঝ হোক,এমনি এমনি কি কাউকে মা বলে ডাকে? এই এতো মায়া-ভালোবাসা এই সব কিছু কি স্রেফ আপন পরের হিসেবেই চলবে?কোন মূল্য নেই এসবের,শুধু মাত্র এই জন্য,যে সে ইরার কেউ না?!! আরশি কিছু ভাবতে পারে না আর,বুকের ভেতরে কান্নার ঝড় উঠতে থাকে শুধু!

সন্ধ্যার আগে আসিফ ইরাকে নিয়ে ফিরলো,ইতস্তত করতে করতে দোতালায় কলিংবেলে চাপ দিতে নিয়েও দিলো না,চুপচাপ ঘুমন্ত ইরা কে কোলে নিয়ে উপরে চলে গেলো। রাত দশটার দিকে ইরার কান্নার শব্দ পেয়ে এক প্রকার দৌড়েই তিনতলায় এসে নক করলো আরশি,আসিফ দরজা খুলতেই অনুমতির অপেক্ষা না করেই ভেতরে ঢুকে কোলে তুলে নিলো ইরাকে। কি এক রাগে অভিমানে লাল হয়ে গেছে আরশীর মুখটা,ক্ষুব্ধ কন্ঠে আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
-কেমন মানুষ আপনি?এসেছেন,কিন্তু একটা বার জানালেনও না!আমি কি অস্থির হয়ে আছি এদিকে সে খবর আছে?
আসিফ শান্ত কণ্ঠে বলল,
-সরি,আমি ভাবলাম,জার্ণি করে এসেছি শুধু শুধু আপনাদেরকে আর ডিস্টার্ব না করি,আর ও তখন ঘুমাচ্ছিলো।
-ডিস্টার্ব?আমার অস্থিরতাটা কে আপনার কাছে ডিস্টার্ব মনে হয়?আপনি কি বুঝবেন?ছোট বেলায় এমন ইরার মতো আমিও মা হারিয়েছি,ছোট্ট বোনটা থেকেই অনেক দূরে,আজ এতো বছর পর ইরাকে কোলে নিতে পারলে যে আমি কি শান্তি পাই সেটা কি আপনি বুঝবেন?বুঝবেন না,কেউ বুঝবেন না আপনারা!আপনারা তো শুধু...
বলতে বলতে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে আরশীর,ফুলে উঠা চোখ দু'টো আবারো অশ্রুতে ভরে উঠে। কিছু না বলে, ইরাকে কোলে নিয়ে দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে আসে,পেছন থেকে অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে আসিফ।
ধীরে ধীরে তার সেই অবাক চোখে খেলা শুরু করে,কিছু পাওয়ার আনন্দ আর নির্ভরতার খুশী,অনেক দিন পর বুক চিরে বেরিয়ে আসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস।

[আরশিদের মতো কিছু মানুষ আছে বলেই,ভালোবাসা শব্দটার সাথে শ্রদ্ধাবোধ জড়িয়ে আছে,ভালোবাসাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় নানা ভাবে। যদিও আমাদের সমাজে,কোন অবিবাহিত মেয়ের সাথে বিবাহিত-বাচ্চার বাবার বিয়ে হলে,সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা কারো হয় না,অনেক সময় ধরেই নেয়া হয়,'নিশ্চয়ই লোকটার টাকা দেখে মেয়েটা রাজী হয়েছে,দোজবর জামাইর বউ হতে!!' কিন্তু যদি কোন বিবাহিত-বাচ্চার মায়ের সাথে অবিবাহিত ছেলের বিয়ে হয়,তাহলে সেটা হয় সমাজের জন্য 'উদাহরন' 'উদার মানষিকতার পরিচয়'!কিন্তু এতো কিছুর পরেও অন্তরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমরা খুঁজে পাই,এই আরশিদের মাঝেই]
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৩৩
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×