জমিদার কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস?
হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো।
সূফি বরষণ
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গোটা মুসলমান সমাজকে নিষ্পেষিত ও নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেছিল ইংরেজ শাসকগণ। মুসলমান আমলে সকল প্রকার সরকারী চাকুরীতে সিংহভাগ ছিল মুসলমানদের। ইংরেজ এদেশের মালিক মোখতার হওয়ার পর ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সকল বিভাগের চাকুরী থেকে বিতাড়িত হতে লাগলো। শেষে সরকারের বিঘোষিত নীতিই এই হ’য়ে দাঁড়ালো যে, কোনও বিভাগে চাকুরী খালি হ’লেই বিজ্ঞাপনে এ কথার বিশেষভাবে উল্রেখ থাকতো যে মুসলমান ব্যতীত অন্য কেউ প্রার্থী হ’তে পারে। ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত আইন পাশ করে মুসলমান বাদশাহগণ কর্তৃক প্রদত্ত সকলপ্রকার জায়গীর, আয়মা, লাখেরাজ, আলতমগা, মদদে মায়াশ প্রভৃতি ভূসম্পদ মুসলশানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পথের ভিখারীতে পরিণত করে। একমাত্র বাংলাদেশেই অন্যূন পঞ্চাশ হাজার ও ইনাম কমিশন দ্বারা দাক্ষিণাত্যের বিশ হাজার লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের বহু লক্ষ টাকা আয়ের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি সরকার অন্যায়ভাবে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে প্রকৃত হকদারকে বঞ্চিত করে। সরকারের এসব দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেল ফলে বহু প্রাচীন মুসলিম পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষঅ ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যান্ত আইন দ্বারা মুসলমানদের অধিকার থেকে যাবতীয় জমিদারী, তালুকদারী, ইজারা প্রভৃতি কেড়ে নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বন্টন করা হলো। ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি উৎখাত হয়ে গেল। বাংলার কৃষকদের মধ্যে শতকরা পঁচাত্তর ভাগ ছিল মুসলমান। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার শ্রেণী হলো হিন্দু এবং জমির একচ্ছত্র মালিক। কৃষককুল হলো তাদের অনুগ্রহ মর্জির উপর একান্ত নির্ভরশীল। তাদের শুধু জমি চাষের অনুমতি রইলো, জমির উপর কোন অধিকার বা স্বত্ব রইলো না। হিন্দু জমিদারগণ প্রজাদের নানাভাবে রক্ত শোষণ করতে লাগলো। জমির উত্তরোত্তর খাজনা বৃদ্ধি, আবহাওয়া, সেলামী, নজরানা, বিভিন্ন প্রকারের কর প্রভৃতির দ্বারা কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমানদের কাছ থেকে দাড়ির ট্যাক্স, মসজিদের ট্যাক্স, মুসলমানী নাম রাখার ট্যাক্স, পূজাপার্বনের ট্যাক্স প্রভৃতি জবরদস্তিমূলকভাবে আদায় করতে লাগলো। যেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর প্রমুখ মনীষীগণ।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার অংগন থেকেও মুসলমানদেরকে বহু দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ব্যবসা ও শিল্পবাণিজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবদুল মওদূদ বলেণ, “দেশীয় কারিগর শ্রেণীকে নির্মমভাবে পেষণ করে দেশীয় শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনও বন্ধ করে দেয়া হয়। তার দরুন শ্রমজীবীদের জীবিকার পথ একমাত্র ভূমি কর্ষণ ব্যতীত আর কিছুই খোলা রইলোনা। আর ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বণিক-রাজের কুঠিরগুলিতে আশ্রয়ে নতুন দালাল শ্রেণীর ব্যবসায়ীও জন্মলাভ করলো বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, মুন্সী, দেওয়ান উপাধিতে। বহির্বাণিজ্যে ও অন্তর্বাণিজ্যে সবদিক দখল করে যে দালাল শ্রেণীর জন্মদান করলো, তারাও হয়ে উঠলো স্বার্থ ভোগের লোভে দেশীয় শিল্প ও কারিগরির প্রতি বিরূপ। এই নতুন আর্থিক বিন্যাসের ফলে যে নতুন ভূস্বামী ও দালাল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো, তাদের একজনও মুসলমান নয় –মুসলমানদের সে সমাজে প্রবেশাধিকারও ছিলনা এবং এই সম্প্রদায়ই ছিল বিস্তৃত গণবিক্ষোভ বা জাতীয় জাগরণের প্রধান শত্রু। এ কথা লর্ড বেন্টিংকও স্বীকার করে গেছেন-
“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বহু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে সত্য, তবে এর দ্বারা জনগণের উপর পূর্ণ কর্তৃত্বশালী বড়ো একদল ধনী ভূস্বামী সম্পদায়ের সৃষ্টি হয়। তার একটি বড়ো সুবিধা এই যে, যদি ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লবের ফলে শাসনকার্যের নির্বিঘ্নতা ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এই সম্প্রদায়ই নিজেদের স্বার্থে সর্বদাই ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখার জন্যে প্রস্তুত থাকবে”। [সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ (শতাব্দী পরিক্রমা), পৃঃ ৬২]।
এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ আরও একটু পরিষ্কার করে বলেন- “এ মতবাদের সমর্থক এ দেশীয় লোকেরও অভাব নেই। এই সেদিনও বিশ্বভারতীতে বাংলার জনগণ সম্বদ্ধে বক্তৃতাকালে কাজী আবদুল ওদুদ সাহেব বলেছেনঃ সেদিনে বাংলাদেশে অন্ততঃ বাংলার প্রাণকেন্দ্রে কোলকাতায় সিপাহী বিদ্রোহের কোন প্রভাব অনুভূত হয়তি। হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখার্জি এই বিদ্রোহ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, সিপাহী বিদ্রোহ কেবলমাত্র কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিপাহীদের কর্মমাত্র, দেশের প্রজাবর্গের সহিত তাহার কোনও সম্পর্ক নাই। প্রজাকুল ইংরেজ গভর্ণমেন্টের প্রতি অনুরক্ত ও কৃতজ্ঞ এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে”।
কাজী সাহেব আরও বলেন হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদকের মত যে মোটের উপর সেদিনের বাংলাদেশের মত ছিল, তার একটি ভালো প্রমাণ –বিদ্যাসাগর ও দেবেন্দ্রনাথের মতো স্বাধীনচেতা বাঙালীরাও সেদিন সিপাহী বিদ্রোহ সম্বন্ধে কোন রকম কৌতুহল দেখাননি। …সিপাহী বিদ্রোহ সেদিন শিক্ষিত বাঙালীকে সাড়া দেয়নি, অশিক্ষিত, হিন্দু বাঙালীকে নাড়া দেয়নি”। (সিপাহী বিপ্লবের পটভূমিকা, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ৫৮)।
করছি।
বাংলার নতুন হিন্দু জমিদারগণ হয়ে পড়েছিল ইংরেজদের বড়োই প্রিয়পাত্র। একদিকে তাদেরকে সকল দিক দিয়ে তুষ্ট রাখা এবং মুসলমানদিগকে দাবিয়ে রাখার উপরেই এ দেশে তাদের কায়েমী শাসন সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। সুতরাং সাধারণ শ্রেণীর মুসলমানদের উপর হিন্দু জমিদারগণ ন্যায় অন্যায় আদেশ জারী করার সাহস পেতো।
নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদেরকে যেমন ব্রাহ্মণেরা ধর্মকর্মে স্বাধীনতা ও মন্দিরে প্রবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিল, অনুরূপভাবে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমাদেরকেও নানান ভাবে করতো জুলুম অত্যাচার নির্যাতন ।
আবদুল গফুর সিদ্দিকী তাঁর গ্রন্থে বলেনঃ- পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু জমিদার ও উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিরক্ষর মুসলমানদেরকে বুঝাইলঃ তোরা গরীব। কৃষিকার্য ও দিনমজুরী না করলে তোদের সংসার চলে না। এমতাবস্তায় তোদের প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক ও বার্ষিক নামাজ এবং রোজ, হজ্জ, জাকাত, জানাজা, প্রার্থনা, মৃতদেহ স্নান করানো প্রভৃতি ধর্মকর্ম করিবার সময় কোথায়? আর ঐ সকল কার্য করিয়া তোর অর্থোপার্জন করিবার সময় পাইবি কখন এবং সংসার –যাত্রাই বা করিবি কি প্রকারে? সুতরাং তোরাও ধর্মকার্যগুলি করিয়া দিবে, তোদেরও সময় নষ্ট হইবেনা।
দ্বীন ইসলামের শিক্ষা হইতে বঞ্চিত পশ্চিবঙ্গের কৃষক ও কৃষিমজুর শ্রেণীর মুসলমানেরা বাবুদিদের এই পরামর্শ আন্তরিকতার সহিত গ্রহণ করিল। ক্রমে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজেও এই ব্যাধি ছড়াইয়া পড়িল। এই সঙ্গে আজাজিল শয়তান এবং নফস আম্মারা তাহাদিগকে প্ররোচনা দান করিল। তাহারা বাবুদিগের কথার জবাবে বলিল, বাবু আপনি ঠিকই বলিয়াছেন। এতদিন আমাদিগকে এই প্রকার হিতোপদেশ আর কেহ দেন নাই। আমরা নির্বোধ, কিছু বুঝি না। আপনি আমাদের যাহা বিবেচনা করেন তাহা করুন। (শহীদ তিতুমীর, আবদুল গফুর সিদ্দিকী, পৃঃ ৫-৬)।
জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মতিকে বললো, তিতু ওহাবী ধর্মাবলস্বী। ওহাবীরা তোমাদের হযরত মুহাম্মদের ধর্মমতের পরম শত্রু। কিন্তু তারা এমন চালাক যে, কথার মধ্যে তাদেরকে ওহাবী বলে ধরা যাবে না। সুতরাং আমার মুসলমান প্রজাদেরকে বিপথগামী হতে দিতে পারি না। আজ থেকে তিতুর গতিবিধির দিকে নজর রাখবে এবং সব কথা আমাকে জানাবে।
অতঃপর কৃষ্ণদেব রায় গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায় এবং গোবরডাঙার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তিতুমীরের বিরুদ্ধে শাস্তিভংগের নালিশ করার জন্যে কিছু প্রজাকে বাধ্য করল। তারপর জমিদারের আদেশে মতিউল্লাহ, তার চাচা গোপাল, জ্ঞাতিভাই নেপাল ও গোবর্ধনকে দনিয়ে জমিদারের কাচারীতে উপস্থিত হয়ে নালিশ পেশ করলো। তার সারমর্ম নিম্নরূপ-
চাঁদপুর নিবাসী তিতুমীর তার ওহাবী ধর্ম প্রচারের জন্যে আমাদের সর্পরাজপুর (মুসলমানী নাম সরফরাজপুর) গ্রামে এসে আখড়া গেড়েছে এবং আমাদেরকে ওহাবী ধর্মমতে দীক্ষিত করার জন্যে নানারূপ জুলুম জবরস্তি করছে। আমরা বংশানুক্রমে যেভাবে বাপদাদার ধর্ম পালন করে আসছি, তিতুমীর তাদে বাধা দান করছে। তিতুমীর ও তার দলের লোকেরা যাতে সর্পরাজপুরের জনগণের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে না পারে, জোর করে আমাদের দাড়ি রাখতে, গোঁফ ছাঁটতে, গোহত্যা করতে, আরব দেশের নাম রাখতে বাধ্য করতে না পারে, হিন্দু-মুসলমানে দাংরগা বাধানে না পারে, হুজুরের দরবারে তার বিহিত ব্যবস্থার জন্যে আমাদের নালিশ। হুজুর আমাদের মনিব। হুজুর আমাদের বাপ-মা।
গোপাল, নেপাল, গোবর্ধনের টিপসইযুক্ত উক্ত দরখাস্ত পাওয়ার পর জমিদার কৃষ্ণদেব রায় হুকুম জারী করলো।
১। যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ওহাবী হবে, দাড়ি রাখবে, গোঁফ ছাঁটবে তাদেরকে ফি দাড়ির জন্যে আড়াই টাকা ও ফি গোঁফের জন্যে পাঁচ সিকা করে খাজনা দিতে হবে।
২। মসজিদ তৈরী করলে প্রথ্যেক কাঁচা মসজিদের জন্যে পাঁচশ’ টাকা এবং প্রতি পাকা মসজিদের জন্যে এক হাজার টাকা করে জমিদার সরকারে নজন দিতে হবে।
৩। বাপদাদা সন্তানদের যে নাম রাখবে তা পরিবর্তন করে ওহাবী মতে আরবী নাম রাখলে প্রত্যেক নামের জন্যে খারিজানা ফিস পঞ্চাম টাকা জমিদার সরকারে জমা দিতে হবে।
৪। গোহত্যা করলে তার ডান হাত কেটে দেয়া হবে –যাতে আর কোনদিন গোহত্যা করতে না পারে।
৫। যে ওহাবী তিতুমীরকে বাড়ীতে স্থান দিবে তাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
(শহীদ তিতুমীর –আবদুল গফুর সিদ্দিকী পৃঃ ৪৮, ৪৯; স্বাধীনতা সংগ্রাসের ইতিহাস, আবু জাফর পৃঃ ১১৯; Bengal Criminal Judicial Consultation, 3 April 1832, No. 5 and 6)।
মুসলমান প্রজাদের উপরে উপরোক্ত ধরনের জরিমানা ও উৎপীড়নের ব্যাপারে তারাগুনিয়ার জমিদার রাম নারায়ণ, কুরগাছির জমিদারের নায়েব নাগরপুর নিবাসী গৌড় প্রসাদ চৌধুরী এবং পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের নাম পাওয়া যায় –Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5 রেকর্ডে। (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।
বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে জমিদার রাম নারায়ণের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল যাতে জনৈক সাক্ষী একথা বলে যে –উক্ত জমিদার দাড়ি রাখার জন্যে তার পঁচিশ টাকা জরিমানা করে এবং দাড়ি উপড়ে ফেলার আদেশ দেয়। Bengal Criminal Judicial Consultancy, 3 April 1832, No.5; (Dr. AR Mallick, British Policy & the Muslims in Bengal, p.76)।
তিতুমীর কৃষ্ণদেব রায়কে একখানা পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, তিনি কোন অন্যায় কাজ করেননি, মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন। এ কাজে হস্তক্ষেপ করা কোনক্রমেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা প্রভৃতি মুসলমানের জন্যে ধর্মীয় নির্দেশ। এ কাজে বাধা দান করা অপর ধর্মে হস্তক্ষেপেরই শামিল।
তিতুমীরের জনৈক পত্রবাহক কৃষ্ণদেব রায়ের হাতে পত্রখানা দেয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তাও পাঠক সমাজের জেনে রাখা প্রয়োজন আছে –তা এখানে উল্লেখ করছি।
পত্রখানা কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করলে পত্রবাহক চাঁদপুরের তিতুমীর সাহেবের নাম করে। তিতুমীরের নাম শুনতেই জমিদার মশাইয়ের গায়ে আগুন লাগে। রাগে গর গর করতে করতে সে বল্লো, কে সেই ওহাবী তিতু? আর তুই ব্যাটা কে?
নিকটে জনৈ মুচিরাম ভান্ডারী উপস্থিত ছিল। সে বল্লো, ওর নাম আমন মন্ডল। বাপের নাম কামন মন্ডল। ও হুজুরের প্রজা। আগে দাড়ি কামাতো, আর এখন দাড়ি রেখেছে বলে হুজুর চিনতে পারছেন না।
পত্রবাহক বল্লো, হুজুর আমার নাম আমিনুল্লাহ, বাপের নাম কামালউদ্দীন, লোকে আমাদেরকে আমন-কামন বলে ডাকে। আর দাড়ি রাখা আমাদের ধর্মের আদেশ। তাই পালন করেছি।
কৃষ্ণদেব রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ব্যাটা দাড়ির খাজান দিয়েছিস, নাম বদলের খাজনা দিয়েছিস? আচ্ছা, দেখাচ্ছি মজা। ব্যাটা আমার সাথে তর্ক করিস, এত বড়ো তোর স্পর্ধা? এই বলে মুচিরামের উপর আদেশ হলো তাকে গারদে বন্ধ করে উচিত শাস্তির। বলা বাহুল্য, অমানুষিক অত্যাচার ও প্রহারের ফলে তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ হলো আমিনুল্লাহ। সংবাদটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মুসলমানরা মর্মাহত হলো, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে প্রবল শক্তিশালী জমিদারের বিরুদ্ধে কিছুই করতে না পেরে তারা নীরব রইলো।
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম হিসাব করে বের করে যে, বাংলাদেশের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ একেবারে নিষ্কর অর্থাৎ লাখেরাজ হয়ে রয়েছে। এরপর থেকেই ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নানা বাহানায় এইসব জমি খাজনাযুক্ত করার জন্য (অর্থাৎ হিন্দুদেরকে দিয়ে লাভবান হওয়ার জন্য) এক ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখে।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, এমআর আখতার মুকুল, প্রকাশকাল ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮)।
মুসলমানদের শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত জমি-সম্পত্তির উপর ব্রিটিশ আর হিন্দুদের শকুনি দৃষ্টি পতিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতেই ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৯৩ সালে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু করে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ছূফী-দরবেশ, আলিম-উলামা উনাদের নিকট থেকে এসব লাখেরাজ জমি কেড়ে নিয়ে তা ব্রিটিশদের অনুগত হিন্দুদেরকে দেয়া হয়।
তৎকালীন ভারত সরকারেরই একজন ইংরেজ সদস্য চার্লস মেটকাফ ব্রিটিশদের এই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সম্পর্কে ১৮২০ সালে মন্তব্য করেছিল যে, “এ নীতি হচ্ছে অন্যায় অবিচারের চূড়ান্ত; কোনো দেশেই এরকম নীতির নজির নেই যেখানে সমস্ত জমিজমা যাদের প্রাপ্য তাদেরকে না দিয়ে অন্য এক গোষ্ঠীর হিন্দু বাবুদের হাতে তুলে দেয়া হলো যারা নানা দুর্নীতি ও উৎকোচের আশ্রয় নিয়ে দেশের ধনসম্পত্তি চুষে খেতে চায়।” (সূত্র: কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, পৃষ্ঠা ৭৯)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:১৮