দৌড়াদৌড়ি সোহাগের কখনই ভালো লাগে না। সত্যি কথা হল, সোহাগ কোন কিছুতেই তাড়াহুড়া করে না। বাস ছেড়ে দিচ্ছে, সঙ্গী সাথীরা পড়িমরি করে ছুটে বাসে উঠল, উঠে দেখে আরে সোহাগ তো নেই। খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ... দেখা গেলো সোহাগ তখন ও ঐ দুরে চায়ের দোকানে বসে কলা পাউরুটি চিবাচ্ছে!! পরীক্ষার ঘণ্টা বেজে গেছে,সবাই নোট, বই গুছিয়ে দৌড়ে এক্সাম রুমে সিটে বসতে ব্যস্ত, সোহাগ তখনও রিকশা’র মামার কাছ থেকে ২ টাকার ছিঁড়া নোট পাল্টাতে ব্যস্ত। ডিপার্টমেন্ট এর ফুটবল খেলায় একবার প্লেয়ার কম পড়ে গেলো, সবাই মিলে ধরল সোহাগকে, আয় বাপ তোকে কিচ্ছু করতে হবে না। কেবল দাড়িয়ে থাকবি আর মাঝে মাঝে বল আসলে লাথি মারবি, কিন্তু সোহাগ তো কোনভাবেই রাজি হবে না। পরে খেলার দিন কেয়া কান ধরে টেনে মাঠে নিয়ে নামিয়ে দিল। একটু পরেই গোল!!! সোহাগদের টিম গোল খেয়ে বসেছে, গোলকিপার গজরাচ্ছে , ডিফেন্স কই?? সবাই তখন ডিফেন্স এর খোঁজ করতেই দেখে সোহাগ মাঠের পাশে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। বলাবাহুল্য, সোহাগের খেলোয়াড় জীবনের এইটাই ইতি।
সোহাগের দোষ নেই, তার আব্বা আলেম মানুষ। অসংখ্য হাদিস আর কোরআনের আয়াত মুখস্ত কিন্তু তাঁর সবচেয়ে প্রিয় একটাই “ হে মানবজাতি, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া”, তাই সোহাগ কখনই তাড়াহুড়া করে না। সোহাগের নাম সোহাগ রাখায় ও মোতালেব সাহেব বড় বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বড় বোনের প্রবল আগ্রহ আর তাঁর স্ত্রীর নীরব কিন্তু কড়া সমর্থনে এইটাই টিকে গেলো। মোতালেব সাহেব কড়া মানুষ, কিন্তু তাঁর বড় বোন এর কথা কখনও অমান্য করেন না। তাঁর এই নিঃসন্তান বোন আর দুলাভাই তাঁকে মানুষ করেছেন। ফলে ঘরের একমাত্র সন্তানের নামের ব্যাপারে তিনি আর জোরাজুরি করেন নাই। আর সোহাগের আগে ও সোহাগের আর ও ২ বোনের জন্ম হয়েছিল, ২জনই আঁতুড়েই মারা যায়, তাই সোহাগের মায়ের ও খুব শখ ছিল এই বাচ্চাটাকে সোহাগ দিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলবেন। বেচারি সেই সুযোগ পান নি, সোহাগের বয়স যখন ৪, তখন কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সোহাগ মা হারা হলো, সোহাগ সেদিন যখন কান্না কাটি করছিল, তখন মোতালেব সাহেব হুংকার দিয়ে বলেছিলেন “কান্না থামা, পুরুষ মানুষের কাঁদতে নাই” সোহাগের ফুফু ফোঁপাতে ফোঁপাতে সোহাগকে সরিয়ে আনলেন, তার পর থেকে তার ফুফুই তাঁকে বড় করেছেন।
সোহাগকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়ে মোতালেব সাহেব তাঁর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করলেন, সেই সোহাগ যখন ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল তখন মোতালেব সাহেব বললেন এইসব জায়গায় যাইস না, ধর্ম ভুইলা যাবি, তখন সোহাগ গিয়ে তার ফুফুরে ধরল। আসমা বেগমের এখন অনেক বয়স হয়েছে তারপর ও যখন তিনি মোতালেব সাহেবকে ডেকে দু-চারটা কথা শুনানো শুরু করলেন, তখন সোহাগ আর তার ফুফা দুরে দাড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
অবশেষে সোহাগ ঢাকায় আসলো, এবং কিভাবে কিভাবে যেন হলের এক কোণায় একটু জায়গা ও করে নিল। আর তার সাবজেক্টের সবাই এই অর্বাচীন প্রাণীটাকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে নিল নিজেদের কাঁধে। প্রথমেই সোহাগ বড় বিপদে পরে গেল, ক্লাসে তার পাশেই এক মেয়ে এসে বসল যাকে দেখে পাড়ার মাস্তানরাও ২ হাত দূর দিয়ে হেটে যাবে। সেই মেয়ে এসেই সোহাগের পিঠে একটা গদাম লাগিয়ে বলল, আরে এই পুচকা এইখানে কি করে?!! সোহাগ একটা মোটামুটি মাইল্ড স্ট্রোক খেল,শেষ কবে সে কোন মেয়ের সাথে কথা বলছে সেটা মনেই করতে পারলো না।ঐ মেয়ে হাসতে হাসতে লুটিপুঁটি খেতে খেতে বলে “ আমি কেয়া,...... কলেজ থেকে, তুই কোথাকার?” সোহাগ কোনমতে বলল “...... মাদ্রাসা” কেয়া হেসে বলল “সমস্যা নেই, তোকে মানুষ করে ফেলব” গত ৫ বছর ধরে সোহাগ তাই মানুষ হচ্ছে, কেয়ার কাছ থেকে উঠতে বসতে ঝাড়ি,লাথি খেয়ে কথা বলতে শেখা, সুমনের কাছ থেকে সিগারেট এর বাল্যশিক্ষা, তন্ময়ের কাছ থেকে আধুনিক যৌনতা-১, মিমির কাছে মেকআপ, ফয়সালের কাছ থেকে প্রেম পিরীতি ও বালিকাদের মন হরণ –শর্ট কোর্স, মাসুমের কাছে চাপা, পারমিতার বদৌলতে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে শেখা... এখন বসে বসে অনার্সের রেজাল্টের অপেক্ষা আর প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আড্ডা।
সবার আগে সুমন আসে, তারপর তৌহিদ, তারপর সোহাগ ও আস্তে ধীরে আসে। এরপর মোটামুটি বাজার বসে যায়। সবার পরে আসে পারমিতা। তার পাজেরো যখন তাকে নামিয়ে দিয়ে যায়, তখন বেলা ১১ টা/ সাড়ে ১১ টা বাজে। পারমিতা আমেরিকা চলে যাবে, শুধু রেজাল্টের জন্য বসে আছে। মিমিটা ও এই ফাকে বিয়ে করে ফেলছে, এখন প্রতিদিন শপিং করতে বের হয় আর তার আগে আড্ডায় একটু ঢু মেরে যায়। সুমন ও একটা বায়িং হাউজে ঢুকবে ঢুকবে করছে আর বাকি সবাই এখনো বেকার, অফুরন্ত সময়। আজকে ও সবাই যখন ফয়সালের নতুন লাভ স্টোরি শুনছে আর অন্যদিকে তন্ময় তার ইদানিং কালের নতুন অভিসারের বর্ণনা দিচ্ছে, তখন আফসানা এসে হাজির হল
কেয়া বলল “আরে তুই?”
আফসানা একটু আলতো হাসল
“কই ছিলি এতদিন?”
“বাড়ি গিয়েছিলাম”
“ আসলি কখন?”
“এইত গতকাল, একটু গোছগাছ করা দরকার ছিল”
“মানে কি?”
আফসানা একটু লাল হল
“ ইয়ে, মানে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, আগামী শুক্রবার বিয়ে”
ততক্ষণে তন্ময়ের ঘটনা বলা শেষ, মোটামুটি সবাই আফসানার কথা শুনে হুল্লোড় করে উঠল, “ মানে কি?” “দাওয়াত দিলি না?” “আজাইরা ৫ বছর পড়লাম?” “শালা কিপটুস, এখনই খাওয়া”
ফয়সালের অবশেষে টনক নড়ল, গল্প থামিয়ে বলল “ কি বলছ, আমার সাথে প্রেম না করেই বিয়ে করে ফেলবি? জামাইরে কি ডায়ালগ দিবি?”
তন্ময় ও বলল, “ এখন ও সময় আছে, একটু এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে যা, না হলে তো জামাই সাহেব বাসর রাতে হতাশ হবে”
এইবার সবাই হুল্লোড় করে উঠল, “ আসলেই তো!” “ তোর জামাই কি রকম? আদনান সামি নাকি ঋত্বিক ?”
আফসানা ততক্ষণে লাল হয়ে গেছে। কেয়া এগিয়ে আসল,” যা যা ডায়ালগ দিছ না, জানি তো কেরামতি ২ মিনিটে নেতাই পরছ আবার ডায়ালগ দেছ!!!”
সোহাগ আলোচনায় অংশ নিল না, আফসানার উপর তার রাগ আছে, পুরা অনার্স লাইফে এই মেয়ে তারে কোন পরীক্ষায় হেল্প করে নাই। অবশেষে ফাইনালে যখন ফেইল আর ঠেকাতে পারে না, তখন আবার ও জিজ্ঞেস করলো, মেয়ে কোন উত্তর দেয় না!!! সোহাগ ভালো করে খেয়াল করে দেখল, গত ৫ বছরে এই মেয়ে তার সাথে কোন কথাই বলে নাই।
সোহাগ হঠাৎ বলে উঠল “ভালো আছো, আফসানা?”
আফসানা সোহাগের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল হঠাৎ , কিন্তু কিছুই বলল না।
সোহাগ ঠোঁট উলটালো।
আফসানা বলে উঠল “ আমি যাই, তোমাদের সবার দাওয়াত রইল”
“বিয়ে কই, এখানে না বাড়ি?”
“বাড়ি, আমি আজকেই যাচ্ছি”
“কয়টার বাসে?”
“১০ টার বাসে, শ্যামলী তে”
“সাবধানে যাস”
“যাইরে, খোদা হাফেজ”
একটু পরে কেয়া উঠে এসে বলল, “গাধা ছেলে, হেলায় এরকম মেয়ে হারালি?”
সোহাগ না বুঝে তাকিয়ে রইল।
“আরে গাধা, এই মেয়ে যে তোকে গত ৫ বছর ধরে পছন্দ করে সেটা কি তোকে বানান করে বুঝাতে হবে?!! ওফ,ছেলেগুলা এত গাধা হতে পারে!! ”
সোহাগ বেইল দিল না, কেয়ার কথার কোন দাম আছে!!!
--------------
সোহাগ টিউশনি শেষ করে রাস্তায় এসে দাড়াল, রাস্তা পাড় হয়ে উল্টো দিকের বাসে উঠবে। হঠাৎ তার সামনে একটা “ ডি-লিংক” দাড়ালো, সোহাগ কি বুঝে উঠে পড়ল। রাস্তায় আজ প্রচণ্ড জ্যাম, রাত সাড়ে ৯ টায় কেবল কলেজ গেট পাড় হয়েছে। সোহাগ আর পারল না, গাড়ি থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করল। হঠাৎ বামদিক থেকে একটা গাড়ি এসে হার্ডব্রেক করল, একটুর জন্য বেঁচে গেলো সোহাগ। ড্রাইভার বের হয়ে শুরু করল গালাগালি।
সোহাগ ভ্রুকুটি ও করলো না, সে আবার ও দৌড়াতে শুরু করল, তাঁকে যে করেই হোক ১০ টায় বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে......
আজ তার বড়ই তাড়াহুড়া......
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১:৩৭