“পৌষ গরমি বোশেখ জাড়া
প্রথম আষাঢ়ে ভরে গাড়া”
-অর্থাৎ, পৌষ মাসে গরম থাকলে এবং বৈশাখ মাসে ঠান্ডা থাকলে আষাঢ়ের প্রথমেই খুব বৃষ্টি হবে- ডোবা গাড়া জলে ভরে যাবে।
এরকম অসংখ্য প্রবাদ বা বচন এ অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। এগুলোর বক্তা একজন বিদুষী নারী যার নাম খনা। তাই এগুলো খনার বচন নামে পরিচিত।
খনার নাম প্রায় আমরা সবাই জানি। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাছে খনা অধিক পরিচিত। কৃষি, আবহাওয়া ও সংসার জীবনের নানা বিষয় নিয়ে খনার বচনগুলো এখনও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে এবং তার বচন বা শ্লোকগুলো নির্ভুলভাবেই প্রতিফলিত। ফলে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন কৃষকই খনার বচন সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু বেশিরভাগই মুখস্ত আওড়াতে পারে না। ফলে অনেক বচনই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে এবং নতুন করে সংগ্রহ করাও প্রায় অসম্ভব। বাংলা পঞ্জিকায় কিছু সংখ্যক খনার বচন দেয়া আছে। কিন্তু তার সংখ্যা একদমই কম। একারণেই সহস্রাধিক বচনের মধ্যে আমারা পাই বেশি হলেও দুই শত।
কে ছিল এই খনা ? এটাও অধিকাংশ বাঙালি জানে। খনা সম্পর্কে বাংলা ও উড়িয়া এই দুই ভাষাতেই কিংবদন্তি রয়েছে। খনা যার প্রকৃত নাম লীলাবতী ছিল লংকা দ্বীপের রাজকুমারী। লংকা দ্বীপবাসী তথাকথিত রাক্ষসগণ একদিন সবংশে তার পিতা মাতাকে হত্যা করে এবং শিশু রাজকুমারী লীলাবতীকে হস্তগত করে। ঠিক একই সময়ে, উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম জ্যোতির্বিদ পন্ডিত বরাহ ভুল গণনাবশত জানতে পারলেন যে তাঁর পুত্র অকালে মারা যাবে। তাই তিনি শিশু সন্তানকে একটি বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেন। বাক্সটি ভাসতে ভাসতে লংকা দ্বীপে পৌঁছালে দ্বীপবাসী শিশুটিকে উদ্ধার করে এবং লীলাবতীর সাথেই লালন-পালন করতে থাকে। দ্বীপবাসী শিশুটির নাম রাখে মিহির। উবয়েই দ্বীপবাসীদের নেতার আশ্রয়ে বড় হতে থাকে এবং শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্যোতিষ বিদ্যা আয়ত্ত করতে থাকে। একসময় লীলাবতী ও মিহির জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠল। লীলাবতী ও মিহির দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে যায় এবং বিয়েও করে তারা।
তখন লীলাবতী ও মিহির দ্বীপবাসীদের বন্দিদশা থেকে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। একদিন গণনা করে নিরাপদ দিন দেখে সাগর পাড়ি দিয়ে তারা চলে আসে ভারতবর্ষে। লীলাবতী জানতে পেরেছিল মিহির ভারতবিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্র। সুতরাং উভয়েই উজ্জয়িনী নগরে এসে নিজেদের পরিচয় দেয়। মিহিরের পিতা তাদের সানন্দে গ্রহন করেন।
এদিকে লীলাবতীর জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মহারাজ বিক্রমাদিত্য লীলাবতীকে রাজসভায় পন্ডিত হিসেবে আসন দান করেন। ফলে লীলাবতী অন্যান্য পন্ডিতদের ঈর্ষার কারণ হতে থাকে। ঈর্ষান্বিত হতে থাকে বরাহ এবং মিহিরও। একদিন পিতা-পুত্র মিলে পরামর্শ করল লীলাবতীর জিহবা কেটে নেবার। পিতৃ আদেশে মিহির লীলাবতীর জিহবা কেটে নেয়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে লীলাবতী মারা যায়। জিহবা কেটে নেবার আগে লীলাবতী মিহিরকে অনুরোধ করেছিল কিছু কথা বলার। মিহির সে সুযোগ দিলে লীলাবতী তখন কৃষি, আবহাওয়া তত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় তথ্য এবং মানবজীবনের বিভিন্ন কথা বলে যায়। যা পরবর্তীকালে বোবার বচন বা খনার বচন (খনা অর্থ হল বোবা) নামে পরিচিত। এটাকে সাধারণভাবে নেবার সুযোগ নেই। বরং বলা চলে চিরকাল ধরে টিকে থাকা পুরুষতন্ত্রের নোংরা আঘাত যা একজন নারীর সমৃদ্ধি মেনে নিতে পারে নি। সমাজ চিরকাল নারীকে অধস্তন করতে চেয়েছে, খনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। নারীর গৌরব বা খ্যাতি যেন পুরুষের কাছে অসম্মানের হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং পুরুষতন্ত্র দমিযে রাখতে চেয়েছে নারীকে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়- নারীকে দমিয়ে রাখতে একসময় নারীর সংবেদনশীল অঙ্গ ভগাংকুর কেটে দিয়ে নারীর খৎনা করানো হত। এবং পুরুষতন্ত্র দীর্ঘদিন এই বিভৎস প্রথা চালু রেখেছিল যাতে নারী যৌন ক্ষমতা অনুধাবন না করতে পারে। কিন্তু খনার মত এখনও নারী আপন যোগ্যতায় উঠে আসছে এবং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এটাই বড় কথা।
খনার বচনকে অবহেলা করার কোন কারণই নেই। কারণ খনার বিজ্ঞানভিত্তিক বচনগুলো এ অঞ্চলের জলবায়ু ও মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রসমূহের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত। কিন্তু কখনও এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। অথচ গ্রামের মানুষগুলো এখনও এই বচনগুলো মেনে চলে। নিঃসন্দেহে খনার বচনকে কেবল লোকবচন না বলে বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮