ভয়ংকর ঠান্ডা দিয়ে ফেব্রুয়ারী মাস শুরু হয়েছে । আমেরিকার নিউইয়র্কে এখন রাত সাড়ে ৭টা। আজ সারা দিন অবিশ্রান্ত তুষার ঝরেছে। গত কয়েকদিনের চেয়ে আজ শীত অনেক বেশী। এই মুহূর্তে তাপমাত্রা মাইনাস ৮ ডিগ্রি । কিন্তু অনুভূত হচ্ছে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কয়েক প্রস্থ গরম কাপড় গায়ে না চাপিয়ে বাড়ীর বাইরে বের হওয়ার কথা ভাবনাতেই কারোর আসবেনা এখন।
আজ বুধবার উইক ডে। অফিস ফেরত মানুষের স্রোত এই সময়ে অনেক কমে আসে। প্রোজেক্টের কাজ শেষ করতে দেরি হয়ে যায় শিউলির। শিউলি আহমেদ বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকায় এসেছে কয়েক বছর আগে। লেখাপড়া শেষ করে ম্যানহাটনের একটি আইটি কোম্পানিতে এসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার হিসেবে গত মাসে জয়েন করেছে। তাই এই শহরে চেনা জানা মানুষ তেমন একটা নেই।
পায়ে ওলের মোজার উপর ফোমের বুট জুতা । প্লাস্টিকের ভেতর মোটা ফোম মোড়ানো লং কোট গায়ে চাপিয়ে, মাথায় ওলের টুপি মাফলার দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে কোটের হুডি মাফলারের উপর তুলে নিউইয়র্ক মেট্রো রেল স্টেশনের দিকে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় সে। বিকাল পাঁচটা থেক ছয়টা পর্যন্ত মেট্রোরেল খুব ব্যস্ত থাকে। তবে এই সময়ে ট্রেন কিছুটা বিরতি নিয়ে আসে। পায়ের নীচে ঝম ঝম ট্রেনের শব্দ শুনে মেট্রো কার্ড চটজলদি পাঞ্চ করতে যেয়ে বা হাতের ঘড়ির কাটায় সময় দেখে নেয় সে।
ট্রেন স্টেশন থেকে বাড়ী যেতে তাকে বাস ধরতে হয়। বাসের সময়সুচির সাথে হাত ঘড়ির সময় ঠিক আছে। নাহ! দেরী হবেনা পরবর্তী বাসের জন্য। আপন মনে বলে শিউলি।
গন্তব্য স্টেশনে পৌঁছে দৌড়ে সাবওয়ে ষ্টেশনের সিঁড়ী দিয়ে নেমে আসার সময় মনে মনে প্রার্থনা করে বাসটা যেন মিস না হয়।
কুয়াশা ঝুলে আছে রাস্তার পাশের গাছপালার ভীড়ে। রাস্তার নিয়ন বাতির আলোয় চারপাশ দিনের মত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সাবওয়ে স্টেশনের নীচে রাস্তার পাশেই বাস স্ট্যান্ড। অবশ্য হেঁটেও বাড়ী অব্দী যাওয়া যায়।
বাড়ী যাওয়ার পথেই হাডসন নদী। হাডসনের তীর ধরে হাঁটতে তার ভীষণ ভাল লাগে। তবে কখনো সকালের তাড়াহুড়া বা প্রচন্ড ঠাণ্ডা এড়াতে মাঝে মধ্যে বাস নিতে হয়। আজকের ভয়ংকর ঠান্ডায় মনে মনে বাসের প্রার্থনাই করছিল সে। বাস স্ট্যান্ডে যেয়ে বুঝতে পারে কিছুক্ষণ আগেই বাস চলে গিয়েছে। পরের বাস আসবে আরও ১৫ মিনিট পর।
মাইনাস ৮ টেম্পারেচারে ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা মানে ঠান্ডায় জমে যাওয়া । তারচেয়ে হাঁটাই ভাল। বাড়ী আসার পথে হাডসন নদীর উপর বিশাল লোহার ব্রীজ। ব্রীজের উপর দিয়েই সব রকমের যান চলাচল করে। তার এক পাশে পায়ে হাঁটার মসৃণ রাস্তাও আছে। শিউলি কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করে --কি করবে ? হাঁটবে না দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে বাসের জন্য?
রাস্তা একদম নির্জন কোন মানুষজন নেই। তাছাড়া ব্রীজের উপর বাতাসের বেগে ঠাণ্ডা আরও বেশি হতে পারে। প্রচন্ড ঠান্ডা রাতের অন্ধকারকে আরও বেশী নিকষ করেছে । সাহসী মেয়ে শিউলি । তারপরেও দমে যায় সে। ঠান্ডা আর অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠে শিউলি।
গত কয়েকদিন ধরে তার সাথে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে। যদিও সে জানে এমন ঘটনার কোন বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা নেই। তারপরেও তার খুব ভাল লাগে।
ঘটনা হোল যখন সে একা থাকে বা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় কোন রকম বিপত্তির আশংকা দেখা দেয় তখন সে তার আশে পাশে একটি ছায়া মানব দেখতে পায়। চোখ বন্ধ করে তাকে অনুভব করতে পারে। আর তখনি তার সমস্ত আশংকা, সব রকমের ভয় কেটে যায়। সেই ছায়া মূর্তিটি ত্রাণকর্তা হয়ে তার পাশে থাকে সবসময়।
শিউলি মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে। কিছু মুহূর্ত ছায়া মানবকে গভীরে স্মরণ করে । হঠাত দেখতে পায় সে একা নয় । কেউ একজন ব্রিজের উপর তাঁর সাথে হাঁটছে। মনে প্রচন্ড শক্তি পায় সে । অদেখা ছায়া মানবকে গভীরে স্মরণ করে হাঁটা দেয়।
ব্রীজের কাছে আসার পর অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। যদিও এটাতে তার অবাক হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সে মোটেও অবাক হয়না কারন এই লোকটিকেই সে দেখেছে কিছুক্ষণ আগে। কালো লং কোটে আফ্রিকান-আমেরিকান একজন সাইকেলের উপর বসে।
তাকে দেখতে পেয়ে লোকটি বলল ---- "ব্রীজের উপরে ঠান্ডা নেই আমি ওদিকেই যাচ্ছি আমার সাথে এসো" লোকটি সাইকেল থেকে নেমে আরও বলল Do not be scared.
প্রচন্ড ভাল লাগায় মন ভালো হয়ে যায় তাঁর। অচেনা পথচারীর সাথে গল্প করতে করতে বাড়ির দিকে আসতে থাকে শিউলি। সে জানে অদৃশ্য থেকে একজন তাকে পাহারা দিয়ে রাখে সারাক্ষণ। অশুভ কোন কিছু তার সাথে কখনোই ঘটতে দিবে না সেই অদেখা আপনজন।
(ছবিটি আমার তোলা নিজের ক্যামেরায় )
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:০৬