এক সময় বাংলায় সুফি-সাধকদের ব্যাপক আগমন ঘটেছিল। ইতিহাস বলে, বাংলার মানুষ এই সুফিদের হাত ধরেই ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। সুফি-সাধকদের মধ্যে ইসলামে শেখ ফরিদ খুব পরিচিত ও প্রিয় নাম। খ্যাতিমান আধ্যাত্মিক কবি, সাধক ও পীর-মুর্শিদগণের অন্যতম একজন শেখ ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ আত্তার। এই সুফি সাধক ও কবির আসল নাম আবু হামিদ বিন আবু বকর ইব্রাহিম। কিন্তু ইরানের নিশাপুরের এই কবি লিখতেন ফরিদউদ্দিন আত্তার নামে। "আত্তার" শব্দের মানে ভেষজবিদ। তার পিতা ছিলেন একজন ওষুধ বিক্রেতা। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ওষুধ বিক্রিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। পেশাগত কারণেই তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন। কথিত আছে যে প্রতিদিন তার কাছে অন্তত ৫০০ জন রোগী আসতেন। রোগীদের তিনি তার নিজের তৈরি ওষুধ দিতেন।
বর্তমান ইরানের খোরাসান প্রদেশস্থ’ নিশাপুর শহরে ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ এবং ১২২১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর জন্মমৃত্যুর দিনক্ষণ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেরই বিশ্বাস তিনি প্রায় শত বছর বেঁচে ছিলেন ।তরুন বয়েসেই হজ করেছেন আত্তার। গিয়েছেন মিশর দামাস্কাস ভারত সহ আরও অনেক স্থানে। সবই জ্ঞানান্বষনে। ভ্রমন শেষে স্থায়ী হন নিশাপুরেই। ১২২০ সালে মঙ্গোলদের অভিযানের সময় নিহত হন কবি। নিশাপুরেই কবির সমাধিটি রয়েছে।
তিনি কিছু আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে দীর্ঘদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। গবেষণার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করেন,তা কবিতার আকারে লিখে গেছেন তিনি। ফরিদ উদ্দিন আত্তার অন্তত ৩০ টি বই লিখে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন ফার্সি মুসলিম কবি, যিনি সুফিবাদ এবং ফার্সি কবিতার উপর একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছেন। ইরান-তুরস্কে তিনি মহত্তম সুফি কবি হিসেবে পরিচিত। তার একটি বিখ্যাত বই হচ্ছে "মানতিকে তাইয়ার" বা "পাখির সমাবেশ"। তার বই ‘তাজকেরাত-উল-আউলিয়া’ বাংলায় খুব জনপ্রিয় একটি বই।
তিনি গবেষণার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করেন,তা কবিতার আকারে লিখে গেছেন। আত্তারের কবিতা রুমিসহ বহু আধ্যাত্মিক কবির জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রঃ) কিশোর বয়েসে বয়োবৃদ্ধ শেখ আত্তারের সাক্ষাৎ ও দোয়া লাভ করেন। তিনি শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার সম্পর্কে লিখেছেন :
“আত্তার করেছেন সফর প্রেমের সপ্তনগর
আমরা এখনও ঘুরছি এক কানা গলির ভেতর।”
পাখির সঙ্গে ফরিদউদ্দিন আত্তারের সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত নিবিড়। তার লেখা ‘মানতিকে তাইয়ার’ বা পাখিদের সম্মেলন বইটি এক ঝাঁক পাখি (আসলে কতগুলি মানবাত্মা) একটি আধ্যাত্বিক পাখির নেতৃত্বে উড়ছে। আল্লাহ পাক হযরত সুলায়মানকে (আ.) পাখির ভাষা বুঝার ক্ষমতা দিয়েছিলেন।কুরআনের সুরা নামলের ২০-২২ নং আয়াতে হুদহুদ পাখি এবং নবী হযরত সুলাইমান (আঃ) এর সম্পর্কে বলা হয়েছে। হজরত সুলাইমানের (আ.) পোষ মানাতো হুদহুদ পাখি। তিনি পশুপাখিদের কথা বুঝতে পারতেন। হুদহুদ সুলাইমানের (আ.) অত্যন্ত অনুগত ছিল। মাথায় খুব সুন্দর একটা ঝুঁটি - ঝুঁটির হলদে বাদামি পালকের মাথাটা কালো দেখতে অনেকটা রাজমুকুটের মত আরবি নাম হুদহুদ গ্রামীন নাম কাঠকুড়ালি । হুদহুদ সুলায়মান বাদশাহর হয়ে ‘সাবা’র রাণী বিলকিসের সংবাদ সংগ্রহ করে আনা আর দূত হিসেবে পত্র পৌঁছে দেয়ার বিবরণ আছে কুরআন মজীদে। প্রেম ও প্রাণের ভাষা ফারসিতে লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘মানতিকুত তায়র’ এর মূল চরিত্রে রয়েছে এই হুদহুদ আর পুরো কাব্যগ্রন্থটি সাজানো হয়েছে পাখিদের সংলাপ দিয়ে ।
পাখিরা একদিন সমবেত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে মতবিনিময় করছিল। প্রত্যেকের অভিমত ছিল, আমরা জীবনভর সীমোর্গ নামের অদৃশ্য এক পাখির নাম শুনে আসছি। সীমোর্গই নাকি দুনিয়ার সকল পাখির প্রাণের প্রাণ। তার দেখা পেলেই সার্থক হবে দুনিয়ার পাখিদের জীবন। কিন্তু আমরা যে কেউ তার সাক্ষাত পেলাম না। আমাদের জীবনটাই তো ষোলআনা মিছে। পাখিদের এই সমাবেশে প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা দিল হুদহুদ। বলল, সুলাইমান (আ.) এর দূত হিসেবে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। আমিই তোমাদের নিয়ে যেতে পারব সেই সীমোর্গ এর দেশে, তার একান্ত সান্নিধ্যে। পাখিরা সানন্দে ডানা ঝাপ্টে তাকে বাহবা দিল। হুদহুদ বলল, তবে সীমোর্গের দেশে যেতে হলে আমাদেরকে অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। বহু গিরিসংকট পাড়ি দিতে হবে। বিশেষত নানা দূঃখ কষ্ট সহ্য করে সাতটি প্রান্তর পার হতে হবে। হুদহুদ জোর দিয়ে বলল, এই সাত প্রান্তর পার হলেই সীমোর্গ এর দরবার পাবে। এসব প্রান্তরের নাম (১)‘তলব’=অন্বেষা (২)‘প্রেম’ (৩)‘মারফত’=তত্ত্বজ্ঞান (৪)‘এস্তেগনা’ =অমুখাপেক্ষিতা (৫)‘তাওহীদ’= এককত ¡(৬)‘হায়বত’ =বিহ্বলতা (৭)‘দারিদ্র ও ফানা।
সাতটি উপত্যকা পেরিয়ে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে পাখিগুলি নিজেদের ক্ষুদ্রত্ব আর ভয় উপলব্দি করছে। ৩০ টি পাখি শেষমেষ গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারে। এবং তারা টের পায় যে -তারা নিজেরাই সী-মোরগ! ফার্সিতে তিরিশকে বলা হয় সী। তিরিশ পাখি অর্থাৎ সী-মোরগ! এই কাব্যগ্রন্থ এক বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক পথ নির্দেশনার গ্রন্থ যা রূপক হিসেবে পাখিদের ভাষা ও আচরণে বলা হয়েছে। তারা জীবন, জগত, সৃষ্টিরহস্য বিষয়ে এবং বিশেষত ভালোবাসা বিষয়ে অপূর্ব সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়।
পাখিদের সমাবেশ ও অভিযাত্রার এ গ্রন্থ শুরু হয়েছে রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা বাক্য দিয়ে- এ গ্রন্থের শুরুতে হামদ, না’ত ও প্রচলিত দোয়া-দরুদের পর মূল কাহিনীতে বলা হয়েছে-
চন্দ্রবিহীন এক মধ্য রাতে চীন দেশে সীমোরগ (ফার্সিতে তিরিশকে বলা হয় সী। তিরিশ পাখি অর্থাৎ সীমোরগ! ) তার রূপের বাহার মেলে ধরল। সীমোরগের পাখা থেকে একটি পালক ছুটে পড়ল জমিনে। পালকের রূপের আলোতে চমক লাগল দেশ-বিদেশ ও সারা জাহানে। এতরূপ দেখে দেশের পাখিরা জমা হল বিশাল ময়দানে। সবার এক কথা- পৃথিবীর সব দেশেই রাজা-বাদশাহ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বাদশাহ নেই। এ কারণে চলছে সবখানে অরাজকতা, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অশান্তি, যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, বৈষম্য, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি। আমাদের প্রয়োজন একজন ন্যায়বিচারক দরদী বাদশাহ। কিন্তু কোথায় পাব তাকে? কে নিয়ে আসবে এমন একজন প্রজ্ঞাবান প্রজাবান্ধব বাদশাহ কাছে। পাখিদের এমন সব কথাবার্তা ও কোলাহলে উপস্থিত হল হুদহুদ। হুদহুদ অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান ও কষ্টসহিষ্ণু পাখি। সব পাখিই তার গুণাবলীতে মুগ্ধ। সবাই মিলে তাকে ধরল এবং তাদের দাবির কথা জানাল। হুদহুদ পাখিদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং তাদের মনের কথা বুঝে নিল। সমবেত পাখিরা তাকেই নেতা ও মুখপাত্র হিসেবে মনোনিত করল। কেন না হুদহুদ হজরত সুলায়মানেরও ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত পাখি। সবার কথা ও দাবি শোনার পর হুদহুদ বলল, আমাদের জন্য একজন যোগ্যতম বাদশাহ বা সম্র্রাট হওয়ার মতো পাখির প্রয়োজন। যার যোগ্যতা রয়েছে কেবল সীমোরগের। সীমোরগ এক আধ্যাত্মিক কল্পিত পাখির নাম। ফার্সি সাহিত্যে সীমোরগ বলা হয় ইনসানে কামেল ও পীরে কামেলকে যিনি রাব্বুল আলামিন আল্লাহ পাকেরই খাঁটি প্রতিনিধি ও প্রতিচ্ছবি।
হুদহুদ পাখিদের বলল, সীমোরগের সন্ধান ও সাক্ষাৎ পাওয়া এত সহজ নয়। সীমোরগের রাজ্যে যেতে হলে অত্যন্ত কঠিন ও সংগ্রামময় অভিযান জরুরি। সীমোরগ থাকে “কুহে কাফে।” কুহে কাফে যেতে হলে আমাদের এ দেশ ও এ বেশ ছাড়তে হবে। আমাদের নফসানী লেবাস ও রেশ থাকা অবস্থায় কুহে কাফে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেখানে যেতে না পারলে সীমোরগের দীদার লাভও অসম্ভব।
এ অভিযান ও অভিযাত্রা নিয়ে পাখিদের মাঝে শুরু হল নানা তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদ। প্রত্যেকেই যার যার স্বার্থ, যুক্তি ও অবস্থানের আলোকে নিজেকে এ অভিযান থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালাল। বুলবুল, ময়ূর, চড়ুই, কবুতর, ঘুঘু, দোয়েল, হাঁস, কাক, শুকুন, বাজ, ঈগল প্রভৃতি হাজার হাজার নামের পাখি সাত মরু-বিয়াবান পাড়ি দেয়ার নাম শুনেই ছিটকে পড়তে ও সটকে পড়তে যুক্তি দেখাতে লাগল। হুদহুদ সবাইকে তার জ্ঞান-প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। বলল, আমাদের নাজাত ও মুক্তির একমাত্র পথই এ সংগ্রামী অভিযানে জীবনপণ করে নামা। নইলে এই অরাজকতাপূর্ণ, অশান্তির ও ধ্বংসাত্মক পৃথিবীর কারাগার থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আত্মত্যাগ ও সংগ্রামই একমাত্র উপায়। লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বাধীনতা ইত্যাদি সাত ভয়াবহ ময়দান পাড়ি দিতেই হবে। তবেই আমরা চিরন্তন শান্তিময় জীবন পাব এবং সীমোরগের পরশ লাভে ধন্য হব।
ফরিদ উদ্দিন আত্তার তার চিত্তাকর্ষক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ এ গ্রন্থে উল্লেখ করেন- ----
অবশেষে পাখিদের সমাবেশ থেকে হাজার হাজার পাখি রওয়ানা হল কুহে কাফের দিকে হুদহুদের নেতৃত্বে। ভয়াবহ সাত মরু-বিয়াবান পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার পাখি মারা গেল, হারিয়ে গেল এবং নানা আকর্ষণ ও ফাঁদে আটকে পড়ল।
শত শত মঞ্জিলে হুদহুদ সঙ্গী-সাথীদের উপদেশ ও পথনির্দেশ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করতে লাগল। সাহসী এ বীর পাখিরা দীর্ঘ কঠিনতম পথ পরিক্রমা শেষে যখন কুহে কাফে পৌঁছাল তখন তাদের সংখ্যা দাঁড়াল মাত্র তিরিশে। ফার্সিতে তিরিশকে বলা হয় সী। তিরিশ পাখি অর্থাৎ সী-মোরগ! সী-মোরগ বা তিরিশ পাখি যখন কুহে কাফে মহান বাদশাহ সীমোরগের রাজ্যে পৌঁছাল তখন তাদের অবস্থা কাহিল, প্রাণ যায় যায়। পথে পথে হাজার হাজার সঙ্গী পাখি বিদায় নিয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে। কত হৃদয়বিদারক এ কাহিনী। কিন্তু সবাই ঠিকানাবিহীন গহীন অন্ধকার যুলমতের দেশে ও দীনহীন বেশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
শেষতক সী-মোরগ বা তিরিশ বীরবিক্রম পাখি অধীর চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগল অন্তরের আরাধ্য সী-মোরগের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য। সেখানে ছিল এক বিশাল অতিস্বচ্ছ হ্রদ। অপেক্ষামাণ সী-মোরগেরা হ্রদের স্বচ্ছ সলিলের দিকে এগিয়ে গেল। একী! সী-মোরগের সবার চেহারাই হ্রদের পানিতে ফুটে উঠেছে। প্রত্যেকেই নিজের ছবিতে দেখল মহামান্য ন্যায়বিচারক অতিশয় দরদী সী-মোরগের হুবহু চেহারা। তারাতো বিস্ময়ে হতবাক! তখন ছবি-প্রতিচ্ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে যার যার দেহের দিকে তাকিয়ে দেখে তারাই এখন সী-মোরগ! সী-মোরগের সন্ধানে, ধ্যানে, স্মরণে ও অভিযানে গিয়ে তারাই হয়ে গেছেন সী-মোরগ। কুহে কাফের সী-মোরগ। চিরশান্তির সী-মোরগ। একত্ব ও একাকারের তাওহিদী হ্রদের প্রশান্তি, দরদ ও ইশকে তারা মাতোয়ারা।
তাদের চোখে-মুখে, কানে ও সর্বাঙ্গে এবং রূহে সর্বত্র বাজছে এক মধুর তান-
“আমি এক আহাদ, অদ্বিতীয় সামাদ-
আমাকেই বানাও তোমার একক লক্ষ্য ও প্রেমময় প্রাসাদ-
আমার উপস্থিতিই যথেষ্ট হোক তোমার মনে-
আমিই তোমাদের মাওলা-মাবুদ বরণ করো অনিবার্য জেনে-
দমে দমে জপো আমার নাম
বিভোর থাকো হু আর আল্লাহু স্মরণে।”
কথাগুলো মানতিকুত তাইর (পাখিদের কথা) নামক কাব্যগ্রন্থে হুদহুদ পাখির সংলাপ। গ্রন্থটির রচয়িতা বিশ্ববিখ্যাত সাধক কবি শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার। প্রেম ও প্রাণের ভাষা ফারসিতে লেখা এ কাব্যগ্রন্থর মূল চরিত্রে রয়েছে হুদহুদ। আর পুরো কাব্যগ্রন্থটি সাজানো হয়েছে পাখিদের সংলাপ দিয়ে।
ফারসি দুটি শব্দের সমন্বয়ে সি-মোরগ গঠিত। সি অর্থ ৩০ আর মোরগ অর্থ পাখি। তার মানে ৩০টি পাখি সি-মোরগের দরবারে গিয়ে ৩০টি পাখিই দেখতে পেল। এ কাহিনীকাব্যের মূল বার্তা হলো, তোমার হৃদয়ের আয়নাকে স্বচ্ছ ও পবিত্র কর, তাহলে দেখবে, তোমার হৃদয়পটে তিনি উদ্ভাসিত। এখানে শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার মূলত আধ্যাত্মিক সাধনার পথে সাধককে যেসব স্তর অতিক্রম করতে হয় তাকে পাখির সংলাপে সাত স্তরে সাজিয়ে মনোজ্ঞ সরল ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। উল্লেখিত পঙক্তিতে তিনি আরও বলেন, ফানার স্তরের পর আর সাধনা করা নিষেধ। তিনি বলছেন, এ তো গেল পরম আরাধ্যের লক্ষ্যে সাধনার কথা। কিন্তু যদি ওদিক থেকে আকর্ষণ এসে যায়, তাহলে তোমার হুঁশ-জ্ঞান লুপ্ত হয়ে তুমি সম্পূর্ণ আকর্ষিত হয়ে পড়বে। তখন যদি তুমি বিন্দু হও, আপন দয়ায় তিনি তোমাকে সিন্ধুতে পরিণত করে দেবেন। (সুবাহানাল্লাহ)
শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহ.) এর স্মরণে
সাত প্রান্তর পার হলে
দরবার পাবে
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
گفت ما را هفت وادی در ره است
چون گذشتی هفت وادی، درگه است
গোফত মা’রা’ হাফ্ত ওয়া’দি দর রাহ্ আস্ত
চোন গুযশতি হাফ্ত ওয়াদি দরগাহ আস্ত
বলে, সাত প্রান্তর আছে আমাদের সাধনার পথে,
এই সাত প্রান্তর পার হলে তার দরবার পাবে।
هست وادی طلب آغاز کار
وادی عشق است زان پس بیکنار
হাস্ত ওয়াদিয়্যে তলব আ’গাযে কা’র
ওয়াদিয়ে এশ্ক আস্ত যান পস বে কিনা’র
‘তলব’ এর প্রান্তর হল যাত্রার সূচনা,
‘প্রেম’ এর প্রান্তর পরে, নাই তার সীমানা।
پس سیم وادیست ازآن، معرفت
پس چهارم وادی، استغنا صفت
পস সিয়ম ওয়া’দিস্ত আয অ’ন মা’রেফত
পস চাহা’রম ওয়া’দি এস্তেগ্না সেফাত
তৃতীয় প্রান্তর আসে ‘মারফত’ এরপর,
চতুর্থ ‘এস্তেগনা’ অমুখাপেক্ষিতার প্রান্তর।
هست پنجم، وادی توحید پاک
پس ششم، وادی حیرت صعبناک
হাস্ত পঞ্জুম ওয়াদিয়্যে তওহীদে পা’ক
পস শশুম ওয়া’দি হায়রত সা-বনা’ক
পঞ্চম প্রান্তর আসবে পবিত্র ‘তাওহীদ’
ষষ্ঠ প্রান্তর ‘হায়রত’ বিহ্বল শাদীদ।
هفتمین، وادی فقراست و فنا
بعد ازین وادی، روش نبود ترا
হাফতুমিন ওয়াদি ফক্র আস্ত ও ফানা’
বা-দ আযিন ওয়া’দি রবেশ ন বুয়াদ তোরা’
সপ্তম প্রান্তর ‘দারিদ্র ও বিনাশ-ফানা,
এর পরের প্রান্তরে তোমার সাধনা মানা।
ورکشش افتی، روش گم گرددت
گر بود یک قطره قلزم گرددت.
ওয়ার কাশিশ উফ্তি রবেশ গুম গর্দদত
গর বুয়াদ য়্যক কাতরা কুলযুম গর্দদত
যদি আকর্ষণে পড়ে যাও ভুলে যাবে পথ,
যদি হও এক ফোঁটা হবে সমুদ্রবৎ।
কথাগুলো ‘মানতিকুত তায়র’ কাব্যগ্রন্থে হুদহুদ পাখির বক্তৃতার অংশ।
(প্রিয় সহব্লগার রিদওয়ান হাসান এর মন্তব্যে উৎসাহিত এই পর্ব লেখা)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ৮:০১