বর্তমান সময়ে দর্শন এবং সমাজতত্ত্বের দুনিয়ায় সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী বাঙালি কে? আপনি চিনেন বা না চিনেন এই ব্যাক্তির নাম "গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক"। কলিকাতায় জন্ম নেয়া এই বর্ষিয়ান নারী বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদার "অফ গ্রামাটোলজি"র ইংরেজি অনুবাদক এবং সাব অল্টার্ন এক্সপার্ট হিসাবে বেশি খ্যাতিমান হলেও তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ একটু ভিন্ন কারণে। আর তা হলো তার নিজস্ব "নারীবাদি" চিন্তা ভাবনা, যেই চিন্তা ভাবনাকে অধুনা "পোস্ট কলোনিয়াল ফেমিনিজম" বলে চিহ্নিত করা হয়। তসলিমা নাসরিনের মতো আলগা এবং উটকো খ্যাতি আকর্ষক আলোচনা তিনি করেন না, প্রকৃত গবেষনা করেন। এই কারণে "নারীবাদ" নিয়া অত্যন্ত মৌলিক একজন গবেষক হওয়া সত্ত্বেও আমরা অনেকেই তাকে চিনিনা। এক্ষনে, ইভটিজিং নিয়া আলোচনায় গায়ত্রী চক্রবর্তীকে কেন টেনে আনলাম? এর উত্তরের জন্য পাঠককে মনযোগ দিয়া পরবর্তি আলোচনাটুকু অনুসরণ করতে হবে।
ক্ষমতা ও ক্ষমতা কাঠামোঃ
ক্ষমতা কাঠামো শব্দটার সাথে যাদের পরিচয় নাই তাদের এই বিষয়ে কিঞ্চিত ধারণা দেই। প্রতিটা সমাজে ব্যাক্তি এবং শ্রেণীর মধ্যে একধরণের ক্ষমতা সম্পর্ক বিরাজমান। মানুষে মানুষে এবং শ্রেণীতে শ্রেণীতে এই ক্ষমতা সম্পর্কের বেশকিছু স্তর আছে। একটা গোটা সমাজের প্রতিটা মানুষ এবং শ্রেণীর তাই ক্ষমতার স্তর বিন্যাস সাজিয়ে একটা ক্ষমতা কাঠামো দাঁড় করানো সম্ভব। মার্ক্সিস্ট সমাজ বিজ্ঞান এই ক্ষমতা সম্পর্কের সহজ সরল একটা ব্যাখ্যা দেয়। বুর্জোয়া, পাতি বুর্জ়োয়া, প্রলেতারিয়েত এহেন কিছু বৃহত শ্রেনীর মধ্যে ক্ষমতা সম্পর্ক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মার্ক্সিস্ট আলোচনায় একটা সমাজে ক্ষমতা কাঠামোর ব্যাখ্যা করা হয়। তবে, বর্তমান যুগে এসে ক্ষমতা কাঠামোর মার্ক্সিস্ট ব্যাখ্যাকে অতি সরলীকরণের দোষে অভিযুক্ত করা হয়। প্রথমত, এই জাতীয় ক্ষমতা কাঠমোতে শ্রেণী যত গুরুত্ব পেয়েছে, ব্যাক্তি তত গুরুত্ব পায় নাই। গুরুত্ব পায় নাই নারী, বেকার, হিজরা এহেন আরো নানাবিধ শ্রেণী। আর এছাড়াও সমাজে বৃহত ২/৩ টা শ্রেণীই শুধু নাই, বরং শ্রেণীর সংখ্যা অনেক এবং শ্রেণীগুলোর মধ্যে সম্পর্কও অনেক বেশি জটিল। একটা সমাজে তাই এক না বরং একাধিক ক্ষমতা কাঠামো বিদ্যমান। অবশ্য এইসব একাধিক ক্ষমতা কাঠামো মিলিয়ে একটা বৃহত কাঠামো তৈরি করা সম্ভব। একটা ক্ষমতা কাঠামোতে দুইজন ব্যাক্তি বা দুইটা শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতা সম্পর্ক মূলত প্রভু-দাস, শোষক-শোষিত, নেতা-অনুসারী এইরকম সম্পর্কের মাধ্যমে বিচার করা যায়।
ক্ষমতা কাঠামো বিষয়টা ভালোমতো বুঝতে হলে এবং আমাদের পরবর্তি আলোচনায় অগ্রসর হতে গেলে “ক্ষমতা” নামক জিনিসটা নিয়া কিঞ্চিত আলোচনা করা প্রয়োজন। কন্টেম্পরারি ফিলোসফিতে “পাওয়ার ফিলোসফি” খুবি গুরুত্বপূর্ণ যায়গা দখল করে রাখলেও এই বিষয় নিয়া এই প্রবন্ধে ব্যাপক আলোচনার অবকাশ নাই। “ক্ষমতা দর্শন” ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে গেলে ফ্রেডেরিক নিৎসে এবং মিশেল ফুকোর মতো দুইজন অত্যন্ত ভিন্ন ধাচের দার্শনিকএর বক্তব্য বোঝা জরুরি। এহেন কষ্টসাধ্য কাজ বাদ দিয়া আমরা শুধুমাত্র ক্ষমতা দর্শনের সামান্য “সার” বক্তব্যকে এইখানে গুরুত্ব দেব। সেই সার বক্তব্য হলো, “ক্ষমতা” শব্দটাকে আমরা যতই নেগেটিভ শব্দ হিসাবে ব্যাবহার করি না কেন এবং যতই একে শোষনের মূল হাতিয়ার হিসাবে চিহ্নিত করি না কেন আমাদের সমাজ কাঠামোতে “ক্ষমতা”কে এড়ানোর কোন উপায় নাই। ক্ষমতাই বর্তমান সমাজকে এর বর্তমান চেহারা দিয়েছে। আর “ক্ষমতা” মাত্রই খারাপ না। উদাহরণ স্বরুপ শোষক-শোষিত ক্ষমতা সম্পর্ককে আমরা খারাপ বলে চিহ্নিত করলেও নেতা-অনুসারী ক্ষমতা সম্পর্ককে আমরা ঠিক খারাপ বলে চিহ্নিত করতে পারি না। বরং সমাজ জীবনে জরুরি বলেই চিহ্নিত করি, যদিও নেতা-অনুসারী সম্পর্কেও “শোষন” পুরাপুরি অনুপস্থিত থাকে না। একটা সমাজের যে কোন শ্রেণী এবং সেই শ্রেণীর উপর সমাজের অন্য কোন শ্রেণীর “অন্যায় শোষন” নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেই সমাজের ক্ষমতা কাঠামো এবং সেই ক্ষমতা কাঠামোতে সেই শ্রেণীর অবস্থান তাই পরিস্কার ভাবে বোঝা বাঞ্চনীয়। ইভ টিজিং মহামারি নিয়া আলোচনা করতে গেলে তাই বাঙালি সমাজের ক্ষমতা কাঠামো এবং সেই ক্ষমতা কাঠামোতে “নারী” নামক শ্রেণীর অবস্থানটা পরিস্কারভাবে বোঝা বাঞ্চনিয়।
এছাড়াও বাঙালি সমাজে ক্ষমতা কাঠামো এবং সেই ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অবস্থান খোজ়ার আগে ক্ষমতার রুপ এবং প্রকাশভঙ্গি নিয়া সামান্য আলোচনা করা দরকার। ক্ষমতার সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, এবং প্রকাশভঙ্গি নিয়া বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। এই বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যেহেতু আমি কোন স্বিকৃত বিশেষজ্ঞ না, তাই একেবারে নিজস্ব ধারণা প্রকাশ করা থেকে বিরত হচ্ছি। ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে বিশেষজ্ঞরা ভায়োলেন্স, সম্পদ, জ্ঞান এহেন আরো বেশ কিছু মাধ্যমের কথা বলেন। তবে ভায়োলেন্স বা উৎপিড়ন যে ক্ষমতা প্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম এই বিষয়ে সকল বিশেষজ্ঞই একমত। আগের যুগে ভায়োলেন্স প্রধানত শারীরিক আগ্রাসন বা উৎপিড়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে শারীরিক প্রতিদ্বন্দিতা, দৈহিক শক্তি প্রদর্শন ইত্যাদিকে বর্বর এবং অসভ্য হিসাবে চিহ্নিত করায় ভায়োল্যান্স প্রকাশে ভাষার ব্যাবহার এমন একটা অবস্থানে পৌছেছে যার কোন উদাহরণ মানবেতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকেই হয়তো এরি মধ্যে বুঝে গেছেন যে ইভটিজিং এর পেছনে শ্রেফ যৌন চেতনা বা যৌন বিকারই কাজ করে না বরং ক্ষমতা প্রকাশের তাড়নাও বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রবন্ধের প্রথম পর্বেই আমি ইভটিজিং আর যৌন নির্যাতনের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও পার্থক্য টেনেছি মূলত এই ভাষিক উৎপিড়নের উপর ভিত্তী করেই। এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করেই একেবারে ইদানিং কালে এসে বাঙালি পুরুষ বিশেষ করে নারী জাতির উপরই ভাষিক উৎপিড়নের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য ব্যাপারোয়া হয়ে উঠলো কেন? এর উত্তরটা খুঁজতে গেলে আমাদের আধুনিক বাঙালি সমাজের ক্ষমতা কাঠামো এবং সেই কাঠামোতে নারীর অবস্থানটা বুঝতে হবে সবার আগে।
আমাদের ক্ষমতা কাঠামো ও নারীর অবস্থানঃ
এই বিষয়ে আলোচনা যাতে দীর্ঘায়িত না করতে হয় তাই ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। “গরু একটি গৃহপালিত পশু। ইহা তৃণভোজী। ইহার চারটি পা, দুইটি কান, দুইটি চোখ, দুইটি শিং এবং একটি লেজ আছে”। ছোট বেলার এই গরু’র রচনা একেবারে ঠিক এইরকম শব্দ বা বাক্য আকাড়ে আমরা বাঙালিরা সবাই পড়েছি, পূর্ব পশ্চিম দুই বাঙলাতেই। এখন ঘটনা হলো, গরু জিনিসটার যে ৪টা পা আর ২টা শিং আছে তা আমরা অনেকেই রচনা পড়ার আগে থেকেই জানি। আর গরু সম্বন্ধে জানতে হলে যে ঐ রচনার বাক্য, শব্দ, দাড়ি, কমা বইয়ে যেমন আছে তেমনি একেবারে মাথার ভেতরে ছবি তুলে রাখার মতো মুখস্ত করে রাখতে হবে এমন কোন কথা তো নাই। তাহলে আমরা কেন এই কাজ করেছি। আসলে আমরা তো করি নাই, আমাদের করতে বাধ্য করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে? এর মাধ্যমে কি আমরা গরু সম্বন্ধে বাড়তি কোন জ্ঞান লাভ করেছি? যেই ভাবসম্প্রসারণগুলো পরীক্ষার খাতায় মুখস্ত লিখে দিয়ে এসেছি সেগুলোতে যেই নৈতিকতার শিক্ষা আছে তা নিয়া চিন্তা করতে আমাদের কেউ শেখায় নাই। সেই ছোটবেলা থেকেই আমাদের মাথা খাটানো থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। আমাদের শেখানো হচ্ছে কিভাবে অনুসরণ করতে হবে, অনুকরণ করতে হবে। এই ধরণের শিক্ষাপদ্ধতি ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি সেই ব্রিটিশ আমলে আমাদের জন্য তৈরি করেছিল। কারণ, চিন্তা করতে সক্ষম বাঙালি তাদের দরকার ছিল না। তাদের দরকার ছিল মাছি মারা কেরানি, যেই কেরানি দেখে দেখে কপি করতে গিয়ে খাতায় লেগে থাকা মরা মাছিটা পর্যন্ত কপি করে। যেই কেরানির কোন প্রভু বা নেতাসূলভ অস্তিত্ব নাই, যে নেহায়েতই অনুকরণ এবং অনুসরণপ্রিয় দাস। ব্রিটিশ উপনিবেশের সৈন্য সামন্ত এই দেশ ত্যাগ করলেও আধুনিক মুক্তবাজার অর্থ ব্যাবস্থা এবং উপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামো এখনো প্রাক উপনিবেশি অঞ্চলেরমানুষদের দাস বানিয়ে রেখেছে। বিষয়টা আরো ভালোভাবে বুঝতে গেলে আধুনিক যুগে ক্ষমতার একটা প্রয়োগ পদ্ধতি ভালোভাবে বুঝতে হবে। মিশেল ফুকো এর নাম দিয়েছেন “ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার”। ফুকোর মতে আধুনিক দুনিয়ার শাসক শ্রেণী অথবা আধিপত্ববাদী শ্রেণী গণমানুষকে শাসন এবং শোষন করে একধরণের ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকা, টিভি, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষের ওপর ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতার প্রয়োগ করা হয়। এই ক্ষমতার এক পাশে থাকে শাসক আর আরেক পাশে থাকে শাসিত। এই শাসক আর শাসিতের মধ্যে যদি নেতা এবং অনুসারির সম্পর্ক না থাকে তাহলে এই সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় পুরোপুরি শোষনের সম্পর্ক। এই অবস্থায় ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা হয়ে ওঠে শোষনের হাতিয়ার। আমাদের ছোট বেলায় “গরুর রচনা” দিয়ে শুরু হয় ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এই শোষনের শুরু। তারপর থেকে তা চলতেই থাকে ভর্তি যুদ্ধ, ভালো সাবজেক্ট, ভালো ক্যারিয়ারের প্রচারিত ধারণা, ডিজুস কালচার, কর্পোরেট কালচার এহেন নানাবিধ ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে। যার ফলাফল অনুকরণ এবং অনুসরণপ্রিয় দাস জাতি, যে জাতি চিন্তা করতে পারে না, বুদ্ধি খাটাতে পারেনা। এ জাতির পুরুষ প্রজাতি সাফল্য বলতে বোঝে প্রভুসম পশ্চিমা পুরুষের অনুসরণ এবং অনুকরণ করা, তাতেও এই দাসত্বের আনন্দ পুরাপুরি নেয়া হয় না, শতভাগ হয় সেই প্রভুর দেশে গিয়ে সরাসরি প্রভুর কামলা খাটলে। এই ব্যাবস্থা এবং অবস্থা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের ক্ষমতার ভাগিদার এদেশিয় সরকার নিজেদের সুবিধার্থেই টিকিয়ে রেখেছে। “বাঙালি পুরুষ”কে যদি একটা শ্রেণী বলা হয় তাহলে বর্তমান বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামোতে সেই শ্রেণী নেহায়েতই একটা দাস শ্রেণী।
এখন এই দাস "বাঙালি পুরুষ" শ্রেণী যে কিনা নিজেই নিজের দাসত্বের খবর রাখে না সে সেই ছোট বেলা থেকে বড় হতে হতে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে উৎপিড়ন আর আগ্রাসনের, তার সুস্থ্য সাভাবিক জীবনের উপায় নাই, দাস হিসাবে টিকে থাকতে গিয়েও তাকে প্রতিদিন মানবেতর সংগ্রাম করতে হচ্ছে । একজন দাসের জীবন অবশ্য এই শোষন উৎপিড়ন স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। প্রতিরোধহীন শোষন এবং উৎপিড়নের গভীর মনস্তাত্বিক প্রভাব আছে, এই ধরণের পরিস্থিতি জন্ম দেয় জটিল কিছু মনোবিকারএর। এই মনস্তাত্বিক প্রভাব এবং ভায়োল্যান্সের জবাবে ভায়োল্যান্স প্রয়োগ করার ব্যার্থতার বিষয়টা আমরা পরবর্তি পর্বে আলোচনা করবো।
এক্ষনে বোঝা দরকার, "বাঙালি নারী" বলতে যদি আমরা একটা শ্রেণী ধরে নেই তবে সেই শ্রেণীর অবস্থান আমাদের সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে কেমন হবে? এই ক্ষেত্রে গোটা পুরুষতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যাবস্থায় নারীর অবস্থান এবং তারপর বাঙালি সমাজের ক্ষমতা কাঠামোয় নারীর অবস্থান নিয়ে আলোচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে আমি মার্ক্সবাদী এবং নারীবাদি লেখিকা মিশেল ব্যারেটের মতামত প্রনিধানযোগ্য মনে করি। মিশেল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অবস্থান বোঝাতে "রিসার্ভ আর্মি অফ লেবার" বলে একটি টার্ম ব্যাবহার করেন। এর অর্থ হচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক পূজিবাদী সমাজে নারী এমন একটা ব্যাকআপ বা রিসার্ভ শ্রমশক্তি যাকে উৎপাদন ব্যাবস্থার বিচারে বেকার বলে অভিহিত করা যায়। উল্লেখ্য, মার্ক্স "রিসার্ভ আর্মি অফ লেবার" টার্মটা পূজিবাদী সমাজে বেকারদের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করেছেন। ব্যারেট উদাহরণ দেন যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন যুদ্ধাবস্থায় নারীদের কাজের গন্ডি পরিবর্তিত হয়ে যায়। এসময় নারীদের পুরুষালী কাজ করানো হয় এবং এটা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করা হয়। কিন্তু যুদ্ধ থেমে গেলেই নারীকে ফিরে যেতে হয় আগের অবস্থানে। Women's Oppression Today: The Marxist/Feminist Encounter নামক পুস্তকে মিশেল ব্যারেট এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। তার শেষ বক্তব্য ছিল এই যে এমনকি মার্ক্সবাদি কায়দায় সমাজতান্ত্র কায়েম করলেও নারীমুক্তি সম্ভব না, কারণ পুরুষ প্রলেতারিয়েত আর নারীর মাঝেও বৈষম্য আছে। ১৯৮০ সালে এই পুস্তক প্রথম প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এই পুস্তকের সর্বশেষ প্রকাশনায় নতুন এক অধ্যায় যুক্ত হয়েছে যেখানে মিশেল দাবি করেন তার পুস্তকের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল এই যে তিনি শুধু "নারী" শব্দটা ব্যাবহার করেছেন, একটা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। জাতি, বর্ণ, স্থান এইরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যে বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের মধ্যে ক্ষমতা কাঠামোয় বিরাট পার্থক্য তৈরি করে এটা তার বইয়ে অনুপস্থিত। মিশেলের এই উপলদ্ধি সঠিক। আর এইখানেই আমাদের জন্য হাজির হন গায়ত্রী চক্রবর্তী।
গায়ত্রী চক্রবর্তীর দেরিদা প্রেম আমার পছন্দ না, “সাব অল্টার্ণ” নিয়া তার চিন্তাতেও আমার আপত্তি আছে। কিন্তু পোস্ট কলোনিয়াল কায়দায় পশ্চিমা নারীবাদের সমালোচনা করে তিনি আমাদের ভূখন্ডের নারীদের বোঝার ক্ষেত্রে বলতে গেলে একেবারেই নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছেন। গায়ত্রীর মতে “পশ্চিমা নারীবাদ” পুরোপুরি তথাকথিত নারীবাদ। কারণ, আমাদের ভুখন্ডের নারী যে শুধুমাত্র পুরুষদের হাতেই নির্যাতিত তাই না, বরং আমাদের ভুখন্ডের পুরষদের মতোই উপনিবেশিক শোষনের শিকার। পশ্চিমের নারীদের উপনিবেশের শোষন সহ্য করতে হয় না, বরং তারা উপনিবেশের লাভের ভাগিদার। এহেন উপনিবেশী নারী যখন নারীবাদের নামে আমাদের ভুখন্ডের অত্যাচারিত এবং নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়ায় তখন তাতে অনেক ফাক থাকে, গলদ থাকে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন নারীবাদি এনজিও নারীদের উপর পুরুষদের দৈহিক এবং মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিয়মিত কাজ করে গেলেও এই দেশের সাহিত্য, টিভি, বিজ্ঞাপনে এদেশের নারীদের গায়ের রঙ নিয়ে যে বর্বর বর্ণবাদী প্রথা নারীদের প্রতিনিয়ত মানসিক ভাবে নির্যাতন করছে, বিভিন্ন রাসায়নিক ভাবে ক্ষতিকর কসমিউটিক পণ্য ব্যাবহার করতে বাধ্য করছে, সেসব ক্ষেত্রে তাদের পুরোপুরি নিশ্চুপ দেখা যায়।
এই অবস্থায়, বাঙালি নারীর অবস্থান বিচার করতে গেলে একি সাথে বিশ্ব অর্থ ব্যাবস্থার ক্ষমতা কাঠামোতে বাঙালি নারীর অবস্থান এবং বাঙালি সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে তার অবস্থান এই দুইটাই বিচার করতে হবে। মিশেল ব্যারেটকে মাথায় রাখলে বর্তমান বিশ্বের ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অর্থ ব্যাবস্থায় বাঙালি গৃহবধু নেহায়েতই “বেকার” বা রিসার্ভ আর্মি। এই রিসার্ভ আর্মি যখন “বেকার” না থেকে উৎপাদন ব্যাবস্থায় অংশগ্রহন করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে তখন একটা মজার ব্যাপার হয়। পশ্চিমা উপনিবেশের নির্ধারিত এবং নির্দেশিত প্রতিযোগিতায় হাপিয়ে ওঠা ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত বাঙালি পুরুষের কাছে তখন স্কুলগামী, অফিসগামী নারী হয়ে দাঁড়ায় অনাকাঙ্খিত প্রতিযোগী, প্রতিদ্বন্দী। এই প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের সাথে যুক্ত হয় নারী এবং যৌনতা বিষয়ে ভিক্টোরিয়ান মন মানসিকতা আর তার বিরুদ্ধে আক্রমনের প্রকাশ ঘটায় সে তার অবদমিত যৌন আবেগের ফলে তৈরি হওয়া যৌন বিকারের মধ্য দিয়ে। পুরো ব্যাপারটা যা দাঁড়ায় তাকে আমরা বলছি ইভটিজিং। কিন্তু ভিক্টোরিয়ান মনমানসিকতা, যৌন বিকার আর কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার যুগপত যোগফলই ইভটিজিংএর পেছনে প্রভাব ফেলে না। এর বাইরেও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় প্রভাবক কাজ করে। ঠিক কি কারণে নানারকম ভাষিক ভায়োল্যন্সকেই আজকের বাঙালি পুরুষ নারীদের ওপর নির্যাতনের জন্য ব্যাবহার করছে তা বুঝতে গেলে সেই প্রভাবককে খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে তাই আমাদের বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোয় বাঙালি নারীর অবস্থান খুঁজলেই হবে না। বরং আমাদের বাঙালি সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে একজন পুরুষ একজন নারীর উপর কিভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা বোঝ খুব জরুরি। উপনিবেশের নির্যাতনের শিকার বাঙালি পুরুষ ঠিক কিভাবে নারীর উপর নিজের ক্ষমতার চর্চা করে এবং ঠিক কি কারণে এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে, এবং ঠিক কি কারণে এই ক্ষমতার চর্চা “ভাষিক ভায়োল্যান্স” বা ইভটিজিং এর রুপ নেয় তা বুঝতে হলে পাঠকদের পরবর্তি পর্ব অনুসরণ করার অনুরোধ করছি।
(চলবে)