প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, আমার লেখাপড়া শুরু হয়, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে ছেলেদেরকে মেয়েদের সাথে ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত পড়ানো হত। ছেলেরা ক্লাশ সিক্স-এ উঠলেই লৌহজং পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে চলে যেতে হতে, এখানে ছেলে-মেয়েরা এক সাথেই পড়ে। এখানে পড়ার আগে দিঘলী বাজারের দুধপট্রি(তখন স্থানটা এই নামেই পরিচিত ছিল)বা মন্দিরের পশ্চিমে সুভাস দাদা ও টুলু দিদির মায়ের কাছে সতিনাথ বসাক এর বইটা বছর খানিক পড়েছিলাম, কাঠের শ্লেটে অ-আ শিখা শেষ করে স্কুলে বড় ওয়ানে ভর্তি হই। ঠাম্মাই আমাকে টুলু দিদির মায়ের কাছ নিয়ে যায়। সম্ভবত তারও আগে ছোট দিদি বা কারো সাথে দিঘলীর বোর্ড (উত্তর দিঘলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়)স্কুলে ভর্তি না হয়েও ক্লাশ করেছিলাম। এই বোর্ড স্কুল বাদ দিয়ে প্রতিদিন দিদির কোলে উঠে সংগ্রামবীর বোর্ড স্কুলে কেন গিয়েছিলাম—তা মনে করতে পারছি না।পিঠা-পিঠি ভাই-বোন, দিদি অনেক হাঁটতে পারত, আমি বেশিক্ষণ হাঁটতে পারতাম না, পায়ে ব্যথা হত, তাই দিদিকে কিছুক্ষণ পরপর আমাকে কোলে নিত। আগের স্কুল কেন ত্যাগ করেছিলাম, মনে করতে না পারলেও, সংগ্রামবীর স্কুল চিরতরে ত্যাগ করার কথা মনে আছে। স্কুলের পড়া-লেখায় মন না টানলেও আমার মত শত শত বাচ্চাদের দেখে স্কুলে আসতে মন চাইতো। একদিন স্কুলের দরজা বাইরে থেকে কে বা করা যেন ছিটকানি লাগিযে দিয়েছে। সেই সাথে কোন কোন ক্লাশে বাচ্চাদের ভয়ানক চিৎকার শুনা যাচ্চে। আমাদের ক্লাশের সামনে পূর্বদিকে ক্লাশ টু। সেই ক্লাশের উত্তর পাশে শিয়াল সিঁদ কেটে রেখেছিল রোজার মাসে। স্কুল বেশিদিন বন্ধ হলেই শিয়ালরা ক্লাশে ঘুমাত। মাটি ভরাট করে কোন লাভ হয় না, স্কুল বেশিদিন বন্ধ হলেই শিয়াল আবার সিঁদ কাটে।যাই হোক, কয়েকটি ছেলে টিনের বেড়া দেওয়া ফুটা দিয়ে বলে গেল, ‘বড় সুই দিয়া সবাইরে হাতের মধ্যে টিকা দিতাছে, লগে বিলাই দুধও দিতাছে।’ শুনে সেই যে থেমে থেমে কান্না শুরু করলাম, ইনজেকশন দিয়ে বাসায় এসে কান্না থামেনি, তবে কান্না থামার ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে বিলাই দুধ খেতাম। বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে (এবং সম্ভবত আগেও)স্কুলের উত্তরের বাড়িতে দিদিমণির কাছেও পড়তাম।
ক্লাশ থ্রিঃ
আমি যখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ি, তখন ক্লাশের পাঠ্যবইয়ে ‘সুখি মানুষ’ নামে একটা গল্প (বা নাটক বোধহয়)। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় করার ব্যাপারে আমার লজ্জা-শরম ছিল খুবই কম।কোন শিক্ষিকার অনুরোধে নাকি নিজেই তা মনে করতে পারছি না, একদিন ক্লাশে অভিনয় শুরু করে দিলাম। গল্প বা কবিতা লেখার চর্চা থাকলে ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল না। আর ছবি তুলে রাখার বিষয়? ক্যামেরা নামক যন্ত্রের সাথে তখনও আমার দেখাও হয়নি। আমার সাথে কে বা কারা অভিনয় করেছিল, তাও মনে করতে পারছি না। ক্লাশের বন্ধু-বান্ধবরা হা করে আমার অভিনয় দেখল। কোন বন্ধু বলেই বসল, পাকনা…। নাটক শেষ হবার পর এক বান্ধবী তো বলেই ফেলল, কিরে স্বপ্না, তোর কি লজ্জা-শরম কিছু নাই? বলে রাখা ভাল, আমি পাকনা ছিলাম না কোনকালে, এখনও না; তবে লজ্জা-শরমহীন বোকা ছিলাম, এখনও আছি…।
ক্লাশ ফাইভঃ
যখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি, তখন কোন এক ক্লাশের ফাঁকে রাজ্জাক আর আমি রবি ঠাকুরের ডাকঘর নাটকে অভিনয় করি।এখনো দু’একটা ডায়লগ মনে আছে, দইওয়ালা, ও দইওয়ালা, তুমি কোথায় যাও?...। মনে করবেন না, পঁচা ছাত্র ছিলাম। ক্লাশ ফাইভে, আমার রোল নং-২। আর ক্লাশে সিক্স-এ যথন উঠি, তখন রোল নং-১। যদিও সিক্স-এ ফাস্ট বয় এর ক্ষমতা দেখাতে পারিনি, কারণ ক্লাশ ফাইভের পর এখানে আর ছেলেদের পড়ানো হয় না।
--ক্ষুধিরামের দেশে, ১৯৮৭ সাল, মৃত অবস্থায় নায়কের কোলে
ক্লাশ সেভেনঃ
কাউয়া পাড়ায়(নিকটে দিঘলী বাজার ও কদম বাবার মাজার থাকায় এখানে জনবসতি বেশি, কাকের মত কা-কা হয়ও বেশি) বিপুদের দখিনের ঘরে মমতাজ উদ্দিনের বকুলপুরের স্বাধীনতা নাটক আমার নির্দেশনায় রিয়ারচাল শুরু হয়। রাজার চরিত্রে আমিই অভিনয় করেছি। বেশ টাকা খরচ করে কালাইবেপারীর বাড়ির পশ্চিমের ছোট মাঠে নাটক ভালভাবেই মন্চত্ব হল আর আমিও বড়দের চোখে পড়লাম। এর আগে বা পরে মানিকদের বাড়িতে সাহিদা আপার নির্দেশনায় ‘চিনি চাচার কাচারি’তে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছি।
সময়টা ১৯৮৭ সাল, লৌহজং কিশোর সংগে শুভ আহমেদের নির্দেশনায় মান্নান হীরার ‘ক্ষূদিরামের দেশে’ নাটক মন্চত্ব হবে, একজন বালক বা কিশোর ছেলে দরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পানি বিক্রেতা বাদশা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। আমার ডাক পড়ল। অতি সুনামের সাথে অভিনয় করলাম। তারপর ওরা কদম আলীতে প্রায় দেড় মাস রিয়ার্চাল দিলাম, শেষ পর্যন্ত নাটকটা ১৯৮৭-৮৮ তে হল না, সম্ভবত ১৯৮৯ সালে হয়েছে, কিন্ত ততদিনে আমি বড় হয়ে গেছি, ওজন বেড়ে গেছে, আমাকে কোলে বা কাঁথে নেওয়া প্রধান চরিত্রের জন্য কষ্টকর, তাই পাড়ার ছোট ভাই রতন অভিনয় করল।১৯৯০ সালে শৈলেন গুহ নিয়োগীর ‘ফাঁস’ নাটকে চুলে পাউডার আর মুখে দাঁড়ি লাগিয়ে নায়িকার বাপের চরিত্রে অভিনয় করলাম।
একাদশ শ্রেণিঃ
নটরডেম কলেজে এসে নটরডেম নাট্য সংসদে কাজ করলে নানা কারণে অভিনয় করা হয়নি। কোন এক সূত্র ধরে আসাদুজ্জামান নূরের কাছে গিয়েছিলাম, উনি ডিসেম্বর মাসে তাদের ওয়ার্কসপে যোগ দিতে বলেছিলেন, কিন্তু তার আগেই সুবচন থিয়েটার ঢুকে পড়ি। বেইলী রোডে তখন ওদের ‘রাষ্ট্র বনাম’ নাটক ঘনঘন মন্চত্ব হচ্ছে। আর আমরা সপ্তাহে ২দিন কঠিন নিয়মের মধ্য দিয়ে ওয়ার্কসপ করছি। ওয়ার্কসপ শেষে খোকন ভাইয়ের নিজের লেখা নাটক ‘ নিজস্ব সংবাদদাতা’ বরিশালের চোর এর চরিত্রে অভিনয় করেছি কিন্ত বেইলী রোডে মহিলা সমিতিতে আমার নাটক করা হয়নি। ঢাকার থাকা-খাওয়ার তখন আমার চরম অবস্থা, সন্ধেবেলা টিউশনি করতে হয়, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, শেষ পর্যন্ত আমার নাট্য জীবন স্বপ্নের সিঁড়িতে ঝুলে রইল।
কুকুরের লেজ চুঙ্গায় ঢুকিয়ে রেখে সোজা করলেও অনেকদিন পর চু্ঙ্গা সরালে লেজ বাঁকাই থাকে।১৯৯৬-৯৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কাওসার এর নির্দেশনায় আবার ফাঁস নাটকে কাজ শুরু করলাম, ওর নির্দেশনা পছন্দ হয়নি বলে আমি আর কাজ করিনি।কাওসারও সুবচন থিয়েটার থেকে কাজ শিখেছে।
২০০২ সালে এলাকার এক ছোট ভাইকে আবুল কালাম আজাদ ভাইয়ের কাছে দিয়ে আসলাম, পরে হয়তো আমি যাব। ছোট ভাই বিয়ে করে বউয়ের চাপে এসব ধর্মবিরোধী কাজ-কাম সব ছেড়ে দিল। আমারও আর যাওয়া হল না। তারপরও ২০০৮ সালে পুরান ঢাকায় আবার একটা দল গঠন করলাম। লৌহজং এর পয়সা স্কুলে রশীদ শিকদারের পৃষ্টপোষকতায় জুয়েল, কামাল, কবিরকে নিয়ে মান্নান হীরার নাটক ‘বৌ’ মন্চত্ব করলাম। ২০০৯ সালে জুয়েলের লেখা নাটক ভিক্টোরিয়া পার্কে মন্চত্ব করলাম। তারপর আর না..। সুযোগের অভাবে আমার মত কত চরিত্র যে বনফুলের মত ঝরে যায়্, কেউ তার খবরও রাখে না।