কোন ভূমিকা দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। ইতিমধ্যেই আমরা সবাই "প্রজেক্ট রামপাল" সম্পর্কে জেনেছি এবং সুন্দরবনের উপর এর বিধ্বংসী প্রভাব অবশ্যি আঁচ করতে পারছি।
প্রথমেই আসি এই এনটিপিসির কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পের অতীত হালচাল নিয়ে। আমরা কি জানি ঠিক একই প্রজেক্ট ভারতের মধ্যপ্রদেশের নরসিঙ্গপুর জেলার ঝিকলি ও তুমরা গ্রামের ১০০০ একর জমির উপর একটি ২X৬ ৬০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু জনবসতি পূর্ণ এলাকায় কৃষি জমির উপর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় বলে ভারতের কেন্দ্রীয় গ্রিন প্যানলে এই প্রস্তাব অনুমোদন করে নি। এই ব্যাপারে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় এর এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটির এক সভায় বলা হয় যে বিদ্যুতকেন্দ্রটি যে স্থানে স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা মূলত কৃষিজমি প্রধান। সে স্থানটির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে দো'ফসলা কৃষি জমি। এটা নিয়ে গত ৮ই অক্টোবর ২০১০ এ ভারতের দ্যা হিন্দু পত্রিকায় ”মধ্যপ্রদেশে এনটিপিসি’র কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বাতিল” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়।
সুত্রঃ Click This Link
তাহলে সেই একই প্রকল্প আমাদের দেশে সুন্দরবনের মত জায়গায় অনুমোদনের সিদ্ধান্ত কি অতিরিক্ত ভারত প্রীতি নয় ? বাংলাদেশ ভারত জয়েন্ট ভেঞ্চারে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের(২*৬৬০) একটি বিদ্যূৎ কেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ণ বোর্ড(পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মান পাওয়ার কোম্পানি(এনটিপিসি) যৌথ অর্থায়নে প্রায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে। হাইকোর্টে ২ টি রিট থাকার পরেও সরকার কিভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে ? ইতমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা শুরু করে দিয়েছে।
এবার পরিবেশগত দিক বিবেচনা করে এই প্রকল্প অনুমোদন এর সিদ্ধান্ত কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। প্রকৌশলী কল্লোল মুস্তাফা বলেছেন-
"কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২০ কিমি এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়না। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দর বন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে যা সরকার নির্ধারিত সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিমি এনভাইরনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া(ইসিএ) থেকে ৪ কিমি বাইরে বলে নিরাপদ হিসেবে দাবী করা হয়েছে। অথচ যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে সেই ভারতেরই ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্যকোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। অর্থাৎ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংস কারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে, তার নিজ দেশ ভারতে হলে সেটা করতে পারতো না!"
এই প্রকল্পটির স্থান মূলত কৃষিজমির উপরে জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। সুন্দরবনের মত সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এইরকম একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আসলেই মেনে নেয়ার মত না। যে কারণে এনটিপিসি তার নিজ দেশ ভারতে এই প্রকল্প স্থাপনের অনুমোদন পাই নাই সেই কারণ গুলো কি আমাদের দেশে সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কি মি দূরের জায়গায় স্থাপনের খেত্রে কি প্রভাব পড়বে অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে তা কি খতিয়ে দেখা এবং বিবেচনা করা হয়েছে ?
এইরকম তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পূর্বে একটা পরিবেশগত সমীক্ষা (ইএসি) করা হয় যাকে ফিজিবিলিটি স্টাডি বলা হয়ে থাকে। এই স্টাডি করার লক্ষে পিডিবি এই ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার দেয় এবং সেই স্টাডির ফল ২০১১ এর এপ্রিলে পিডিবি'র কাছে জমা দেয়ার কথা থাকলে তা আদৌ জমা দেয়া হয়েছে কিনা বা হলে প্রকাশ করা হয়েছে কিনা তা আড়ালে আছে।
সুত্রঃ Click This Link
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুর পর থেকেই সেখানে "রামপাল কৃষিজমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ" গঠিত হয় যারা শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে। সংবাদ সম্মেলন করে তারা বলে-
" প্রস্তাবিত এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিশাল এলাকার মধ্যে বসতবাড়ি, ধানী জমি, মৎস খামার, চিংড়ি চাষ প্রকল্প, সবজি ক্ষেত, গরু-মহিষ উৎপাদন খামার, দুগ্ধ খামার, মসজিদ মাদ্রাসা মক্তব কবরস্থান ও অন্যান্য ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতি মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার মাছ, ধান, গরু-মহিষের মাংস এই এলাকা থেকেই উৎপাদন করা হয়। কৃষি জমি অধিগ্রহনের এই উদ্যোগের সাথে সাথে আমাদের রুটি-রুজির সংস্থান আর বাপ-দাদার ভিটে-মাটি সবই যেতে বসেছে। ... বিদ্যূৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে হয়তো কিছু লোকের কর্মসংস্থান হবে কিন্তু জমি অধিগ্রহণের ফলে কৃষি জমি ও কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত যে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কর্মহীন আর উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে তাদের সবাইকে পুনর্বাসন করা আদৌ সম্ভব নয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে হয়তো কিছু টাকা মিলবে কিন্তু তা দিয়ে নতুন করে কৃষি জমি কেনাও দূরহ। এ অনিশ্চয়তা থেকে আমরা কৃষি জমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছি।”
সুন্দরবনের উপর পরিবেশগত প্রভাব কেমন হবে তা জানার জন্য যখন ইন্টারনেট এ ঢুঁ মারলাম তখন আঁতকে উঠলাম। সেটা পরে বলছি তবে তাঁর আগে একটা ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। সবার নিশ্চয় সিডর আর আইলা এর ভয়ানক রুপের কথা মনে আছে। এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত আছি। আরও বেশি জানার থাকলে ইন্টারনেট এ পেয়ে যাবেন। তবে যেই জন্য এই সিডর আর আইলার কথা বলছিলাম তার কারণ হল এই সুন্দরবনের জন্য এই দুর্যোগ গুলো আরও ভয়ঙ্কর রুপ নিতে পারে নাই। দুর্যোগের সময় চাদরের মতই উপকূলীয় এলাকাকে আগলে রাখে এই সুন্দরবন। সুন্দরবন নিজে ক্ষত বিক্ষত হয়ে রক্ষা করেছিল মানুষের জীবন ও সম্পদ। সেই ধাক্কা কাটিয়ে আবার সে দাড়িয়ে গিয়েছে।
২০০৯-২০১০ সালে সহকারী বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বনসেবা বিভাগের প্রতিবেশ গবেষক ড্যানিয়েল সি ডোনটো সুন্দরবনে কার্বনের পরিমাণ নির্ধারণের ওপর এক সমীক্ষা পরিচালনা করেন। সেই সমীক্ষার তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালে আঘাত হানা ঘূর্নিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে সুন্দরবনের নদী-সমুদ্রসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু সুন্দরবনের কারণে ঝড় দুটি মানববসতি এলকায় আসার আগেই অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সিডর ও আইলার পর আবহাওয়া বিভাগ থেকে জানানো হয়, সুন্দরবন না থাকলে সিডরের ধাক্কাটা আসত খোদ রাজধানী পর্যন্ত। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে সিডরের গতি প্রতিঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার থেকে কমে ২০০ কিলোমিটারের নিচে নেমে গিয়েছিল। প্রকৃতি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস’ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর তাৎক্ষণিক এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা অনুযায়ী, সুন্দরবনের কারণে আইলার বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার ও জলোচ্ছাসের উচ্চতা চার ফুট কমে গিয়েছিল।
এবার আসি এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব কেমন এবং তাতেই আমরা আঁচ করতে পারব সেটা কেমন প্রভাব ফেলবে আমাদের সুন্দরবনের উপর.
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশের উপর প্রভাব নিরূপণকে (ইআইএ) মনগড়া ও প্রহসনমূলক উল্লেখ করে রিপোর্ট প্রত্যাক্ষান করেছেন পরিবেশবিদ ও তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইয়ীদ সেমিনারে বলেন, যে কোনো কিছু করতে গেলে তার খারাপ দিক থাকে। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে প্রথম থেকেই বিতর্ক উঠেছে। সবকিছু পলিটিক্যালি বা টেকনিক্যালি না দেখে জনগণের কথাও ভাবা উচিত।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল আলম বলেন, ইআইএ রিপোর্টের ভিত্তিতে সেখানে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা যাবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মাণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।এরই মধ্যে যৌথ কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এতো সবের পরে ইআইএ কে প্রহসন ছাড়া আর কি বলা যায়?
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলে সুন্দরবনের কি পরিমাণ ক্ষতি হবে তার, কোনো সঠিক বিশ্লেষণ নেই রিপোর্টে।
পরিবেশবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ইআইএ’র আগে পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে জমি দখল করা হয়েছে। একে ইআইএ না বলে ইএমপি (পরিবেশ ব্যবস্থাপনা প্লান) বলাই উচিত। শীতের সময় উল্টোদিকে বাতাস বয়ে যায়। তখন সুন্দরবন থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই ও ধোয়া সুন্দরবনের ক্ষতি করবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে রিটকারী আইনজীবী অ্যাড. তাহসিন বলেন, রিট থাকা অবস্থায় একের পর এক চুক্তি করে সরকার আইন ভঙ্গ করেছে।
পরিবেশবিদ ড. আবদুল মতিন বলেন, ‘‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদরা একটি সমীক্ষা করে দেখিয়েছেন, সুন্দরবনের কি পরিমাণ ক্ষতি হবে। তারা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। কিন্তু এসব রিপোর্টকে আমলে নেওয়া হয় নি। সরকার যদি দরোজা-জানালা বন্ধ করে থাকে, তাহলে আমাদের করার কিছু নেই।’’
প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা বলেন, সুন্দরবন এলাকার বাতাসে ক্ষতিকারক সালফার ও নাইট্রোজেনের মাত্রা বর্তমানে প্রতি কিউবিক মিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রাম রয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে ঘনত্ব ৫৩.৪ মাইক্রোগ্রামে গিয়ে ঠেকবে। এতে বিপন্ন হয়ে পড়বে সুন্দরবনের অস্তিত্ব।
সুত্রঃ Click This Link
রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানীকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই পরিবহন করা হবে! এ জন্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রায় সারা বছর ধরে হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করবে।
সরকারি পরিবেশ সমীক্ষা ইআইএ)অনুযায়ী, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সমুদ্র পথে আমদানী করতে হবে। আমাদানীকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে মংলা বন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দর বনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সুন্দর বনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিমি নদী পথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে!
সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই স্বীকার করা হয়েছে, এভাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে-
১) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুড়া, ভাঙা /টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানি সহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নি:সৃত হয়ে নদী-খাল-মাটি সহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে;
২) সুন্দরবনের ভেতরে আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা উঠানো নামানোর সময় কয়লার গুড়া, ভাঙা কয়লা পানিতে/মাটিতে পড়ে- বাতাসে মিশে মাটিতে মিশে ব্যাপক পানি-বায়ু দূষণ ঘটাবে;
৩) চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুইপাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে;
৪) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দ দূষণ হবে;
৫) রাতে জাহাজ চলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণী সহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের উপর মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি।
সুন্দরবনের ভেতরে দিয়ে কয়লা পরিবহণের এই সব ফলাফল বর্ণনা করে আবার সমীক্ষায় আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে জাহাজ চলাচলের আন্তর্জাতিক আইন, বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ইত্যাদি মেনে চললে, জাহাজ ধীর গতি চলাচল করলে, অপ্রয়োজনে শব্দ না করলে ও সার্চ লাইটের অপ্রয়োজনীয় ব্যাবহার নিয়ন্ত্রণ করা হলেই নাকি এইসব ভয়ংকর ক্ষতির প্রভাব সুন্দরবনের পরিবেশের উপর মাইনর বা সমান্য হবে!
(সূত্র: প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ সমীক্ষা, Impact of coal transportation, transshipment and handling, page 293-294)
পরিবেশের উপর এর প্রভাব এত বেশি যে তা এখানে লিখলে লিখা আরো বড় হয়ে যাবে। তাই একটু জানতে হলেও প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফার এই নোটস টি একটিবার চোখ বুলানোর অনুরোধ রইল-
Click This Link
আরো একটি উল্লেখযোগ্য যে বিষয় হল সেটা হল মানবিক বিপর্যয় ! তা কেমন ? ১৮৩০ একর ধানী জমি অধিগ্রহণের ফলে ৮ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মসংস্থান হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ জনের, ফলে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ পরিবার। শুধু তাই নয়, আমরা প্রতি বছর হারাব কয়েক কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন।
হুম আমি মানছি , এবং আমরা সবাই অনুভব করি যে বিদ্যুত আমাদের জন্য কতটা জরুরী। কিন্তু এই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত উত্পাদন বিশ্বে কতটা গ্রহণযোগ্য বলে আপনার মনে হয় ? একটিবার সার্চ করে দেখুন শুধু। নিজেই পেয়ে যাবেন !
যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ২০১০ সালে দেশটির মোট কার্বন ডাই-অক্সাইডের ৮১ ভাগ উদগীরণ করেছে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো, যা থেকে মোট শক্তির মাত্র ৪১ ভাগ পাওয়া গেছে। এ বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী সকল দেশেই কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
এ ধরনের কয়লাভিত্তিক প্রকল্প প্রতি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। রামপালের প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা নিঃসন্দেহে মেটানো হবে পশুর নদ থেকে। পশুর নদের পানি নোনা ও মিঠা জলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রয়োজন মেটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই নদীটির সঙ্গে ওই গোটা অঞ্চলের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যের সংযোগ রয়েছে।
এসব তো গেল সব পরিবেশবাদী ভাবনা। এই সরকারের আমলে বিদ্যুতের কম উন্নয়ন হয় নাই। উন্নয়ন হয়েছে অনেক কিন্তু এরপরেও কিন্তু আমরা নিন্দুকেরা বিদ্যুতের বাড়তি দাম মেনে নিতে পারি না।এটা খুবই স্বাভাবিক।সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয়ের মধ্যে তা যদি না থাকে তবে বাড়তি দাম সহ্য করা দুস্কর।আচ্ছা ভেবে দেখেছেন কি এই রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র আপনাকে কয়টাকা তে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত দিবে ?
যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতিটন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের জন্য কয়লা আমদানি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে পিডিবি এখান থেকে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে সেটা নিশ্চিত।রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে দুদেশের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫% পিডিবি, ১৫% ভারতীয় পক্ষ এবং ৭০% ঋণ নেওয়া হবে। যে নিট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০% হারে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে একটা ফর্মুলা অনুসারে।
এই রামপাল প্রকল্প এমনি আত্মঘাতী এক সিধ্বান্ত হতে চলেছে যার ভবিষ্যত আসলেই ভয়ানক।কোন দিকেই আমাদের লাভ নাই। কিভাবে এই প্রকল্প আমাদের অনুকূলে হয় ? না অর্থনৈতিক ভাবে, না মানবিক ভাবে, না পরিবেশগত ভাবে ? প্রকল্পে ১৫% বিনিয়োগে ভারতীয় মালিকানা ৫০%। বিদ্যুতের দাম পড়ছে দ্বিগুণেরও বেশি।যে প্রতিষ্ঠানকে ভারতীয় মধ্য প্রদশ অনুমতি দেয় নি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সেই প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে আদালতে রিট থাকার পরেও অনুমতি দিয়ে সব কাজ শুরু করে দেয়া হয় ? ক্ষতি হবে আমাদের, পরিবেশ মরবে আমাদের, প্রতি ইউনিট দাম বেশি দিয়ে কিনব আমরা, উচ্ছেদ হবে ৭৫০০ পরিবার, বারোটা বাজবে কৃষিজ সম্পদের, আর ৫০% মালিকানা ভারতীয় কোম্পানির ? তাও আবার ভারতীয় ই কোম্পানিকে এত এত লাভের কর ও দিতে হবে না ? আমাদের সুন্দরবন কি "বানের জলে" ভাইসা আসছে ?
এখনই সময় সবার সচেতন হবার। আগে তো জানতে হবে এর ভয়াবহ রূপ, এরপর সচেতনতা নিজ থেকেই তৈরী হবে। ঢাকা থেকে সুন্দরবন অভিমুখে রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে আজ থেকে শুরু হয়েছে লং মার্চ। আমাদের ভালবেসে নাম দেয়া "সুন্দরবন" কে আমরা রক্ষা করবই।
বিদ্যুত উত্পাদন কেন্দ্রের অনেক আরো অনেক উপায় এবং বিকল্প থাকতে পারে কিন্তু সুন্দরবনের বিকল্প একমাত্র সুন্দরবন।
তথ্য সূত্র:
# Final Report on Environmental Impact Assessment of 2x (500-660) MW Coal Based Thermal Power Plant to be Constructed at the Location of Khulna
Click This Link of 2x (500-660) MW Coal Based Thermal Power Plant at Rampal in Bagerhat District, Khulna.pdf
# Environmental Impact Assessment for The Proposed 1320 MW Super Critical Coal based Thermal Power Plant at Kukurda In Raigarh Thesil and District in Chhattisgarh State
Click This Link -Executive Summary.pdf
# NTPC’s coal-based project in MP turned down
Click This Link