আগে বলা হতো পাগলে পালে ছাগল। এখন বলা হয়ে থাকে বুদ্ধিমানেরাই ছাগল পালে। কারণ দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে পরিকল্পিতভাবে ছাগল পালন করলে নিশ্চিন্তায় ভালো ফল পাওয়া যায়। ইদানীং নানা জাতের লাভজনক ছাগল পালনের কথা শোনা যাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল' ছাগল। এ ধরনের ছাগল কালো এবং দেখতে বেশ বড়সর হওয়ায় অনেক স্খানে এ জাতের ছাগলকে ‘বাংলার কালো বাঘ' বলে থাকে। ২০০৭ সালে কুষ্টিয়ায় প্রচুর পরিমাণে খামারী ব্ল্যাক বেঙ্গলের খামার গড়ে তুলেছেন। বিশেষ করে গত কুরবানী ঈদের আগে কুরবানীকে লক্ষ্য করে গরুর খামার করার পাশাপাশি অতি লাভজনক ব্ল্যাক বেঙ্গলের খামারও গড়ে তোলেন। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার খামারি ওমর আলীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ছাগলের খামার গড়ে তিনি প্রায় ৩৫ হাজার টাকা লাভ করেছেন। কুরবানীর আগে গরু ব্যবসায় মার খেলে ছাগল পালনের লাভকৃত অর্থ তাকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচায় বলে তিনি জানান। অবশ্য খামারের কাজে তার স্ত্রী জোবেদা খাতুনও নাকি তাকে নানা কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। এখন তাদের খামারে ২৭টি বড় ব্ল্যাক বেঙ্গল' ছাগল রয়েছে বলেও তারা জানান। আর সামান্য বড় হলে ভালো বাজার পেলে সেগুলো বিক্রি করে দেবেন। বাড়ির খামারে নাকি এসব কেনার জন্য লোকজনও আসেন। আর সামান্য বড় যেসব ছাগল আছে সেসব পুরোপুরি বড় করে বিক্রি করবেন। ওমর আলী দু:খের সাথে জানান, তিনি বছর কয়েক আগে বিদেশে গিয়ে ফেরত এসেছেন। তাতে প্রচুর অর্থ নষ্ট হয়েছে। দেশে এসে তার এক বুর পরামর্শে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। তার দেখাদেখি অনেক বেকার যুবকও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ কিস্তিতে ঋণ নিয়ে ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন। তাতে ওই স্খানে সেই আগের অভাব এখন আর নেই বললেই চলে। অনেকে নাকি চোরাচালান, পাচার ইত্যাদি ছেড়ে দিয়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার করা শুরু করে দিয়েছে। তারা বলছেন, এ ব্যাপারে সরকার যদি যথাযথ মনোযোগ ও গুরুত্ব দেয় তবে দেশের সকল জেলার প্রতিটি গ্রামের মানুষ অতি লাভজনক এর খামার গড়ে তুলতে আরো উৎসাহী হবে। তাতে খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ হবে। শুধু চুয়াডাঙ্গা নয় কুষ্টিয়া, যশোর ইত্যাদি জায়গায় ঘুরেও দেখা গেছে গ্রামে গ্রামে মানুষ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন। প্রায় সবার মুখেই এখন হাসির ঝিলিক। উটকে যেমন বলা হয়ে থাকে মরুভূমির জাহাজ তেমনি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে বলা হয়ে থাকে ‘গরীবের গাভী।' গাভী এই কারণে বলা হয়েছে যে, একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন করলে গাভী পালনের সমান লাভ পাওয়া যায়। এ জাতের ছাগল খাবার-দাবার তেমন বাছ-বিচার করে না। তাই খাবার নিয়ে খামারীদেরও ততো দুশ্চিন্তা করতে হয় না। তবে এসবের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় বলেই খামারীরা এসবকে তেমন কষ্টের মনে করেন না। এমনও দেখা গেছে, স্বল্প আয়ের গেরস্খের বর্গাদারের কাছ থেকে সহজ শর্তে ছাগল বর্গা নেয়ার স্খানীয় প্রচলিত রীতি এখনো ক্ষুদ্র ঋণের চেয়ে সহজ ও অধিকতর লাভজনক এবং সাবলীল। এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৯৭ ভাগ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল কম উপার্জনের গৃহস্খের দ্বারা লালিত-পালিত হয়ে থাকে।
এই প্রজাতির ছাগল যেমন দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে তেমনি দ্রুত বড় হয়। এর কারণেই গরীব কৃষক ভাইয়েরা এতে বেশি আগ্রহী হয়। এমনো দেখা গেছে, অনেকে চাষাবাদের কাজ কমিয়ে দিয়ে এ জাতীয় ছাগল পালনে বেশি মনোযোগী হয়েছেন। বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ছাগলের ভাণ্ডার। প্রতিবছর এ দেশ এ জাতীয় ছাগল থেকে প্রায় সোয়া লাখ মেট্রিক টন গোশত পেয়ে থাকে। যা মোট গোশ্তের প্রায় ২৫ শতাংশ বলে জানা যায়। যারা শহরে বাস করেন তারা গ্রামের দিকে গেলেই এর কমবেশী প্রমাণ পাবেন। সঠিক পরিচর্যা, চিকিৎসা ও লালন-পালনে প্রশিক্ষিত হলে কোনো খামারীই এর খামার করে লোকসানের কবলে পড়েন না। যারা এর খামার করে তেমন লাভের মুখ দেখেননি দেখা গেছে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে তারা ভুল করেছেন। যশোরের পুলুমের আনিস সিকদার অন্যান্য খামারীদের লাভ দেখে ঝোঁকের বশে না জেনেই এর খামার করে আর্থিকভাবে ধরা খান। পরে স্খানীয় পশুসম্পদ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে বুঝতে পেরেছেন কোন এক জায়গায় তিনি ভুল করেছেন। পরে কর্মীর পরামর্শ মতো খামার করে মাত্র ৪ মাসেই সব লোকসানের টাকা উঠে আসে। এখন নিয়ম-কানুন না জানা অনেকেই খামার করা সম্বে নানা অজানা বিষয় জানতে আসেন আনিস-সিকদারের কাছে। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই দেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেশের মানুষ।
উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্খা, শ্রমের যথাযথ ব্যবহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টিমান বজায় রাখা, উপযুক্ত বাজার সৃষ্টি ইত্যাদির মাধ্যমে খামার করা বা উৎপাদন খরচ যেমন কমাবে তেমনি এর উৎপাদনও হতে পারে কাáিক্ষত পরিমাণে বা তার চেয়েও বেশি। এছাড়া উন্নতজাত সংরক্ষণ ও স্খানীয় উন্নত জাতের উৎস হিসেবে কাজ করে সেই মোতাবেক উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে অধিকতর মনোযোগী হলে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়। আসল বিষয় হচ্ছে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয় অনেক দেশেই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের খামার অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অন্যান্য দেশের মানুষ যেমন- ভারত, ইরান, সৌদি আরবের অনেক কৃষক জমি চাষ করার পাশাপাশি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খামার করে অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট সফলতা পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, উন্নত দেশের খামারীরা প্রায় আড়াই হাজার ব্ল্যাক বেঙ্গলের একটি খামার থেকে মাসে কম হলেও ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার আয় করতে পারেন। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরমিাণ প্রায় সাত-সাড়ে সাত লাখ টাকা। কোনো একটি খামারে কাজ শুরু থেকে তৃতীয় বছরেই ছাগল বিক্রিযোগ্য হয়। তবে এতে যেমন পুঁজি লাগে তেমনি পরিশ্রমের। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি সঠিক সেবা প্রদানের সুযোগ যেমন ঋণ সুবিধা, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা, যথাযথ প্রশিক্ষণ, বাজার সৃষ্টি ইত্যাদিতে এগিয়ে আসে তবে কোনো খামারী মনে হয় আর লোকসানের কবলে পড়বেন না। আদর্শ গ্রাম উন্নয়ন সংস্খা (আইআরডিসি) কুমিল্লার উপকণ্ঠে এ ধরনের একটি খামার স্খাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষদেরকে সম্পৃক্ত করারও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে উল্লিখিত স্খানের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা।
পশুখাদ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত না বাড়লে এর খামার করে আরো লাভবান হওয়া যেতো। ক্ষেতখোলা কমে যাওয়াতে আগের মত আর উন্মুক্ত স্খানে ঘাস পাওয়া যায় না। ভুষি, খৈল ইত্যাদির দাম কেজিতে প্রায় ৪-৫ টাকা বেড়েছে। অনেক স্খানে ঘাস শাকের মত আঁটি হিসেবে চড়া দামে বিক্রি হয়। ভুষা মাল ব্যবসায়ী সূত্রে বলা হয়েছে, তারা পাইকারী বাজার থেকে আগের চেয়ে বেশি দামে এসব কিনছেন। তাই একটু বেশি দাম না রাখলে নাকি ব্যবসা লাটে উঠবে। এসব নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তেমন নীতিমালা নেই। তাই মানুষের বাজারের অস্খিতিশীলতার মত পশু খাদ্যের বাজারেও বিরাজ করছে চরম অস্খিতিশীলতা। সার্বিক স্বার্থে এ সংক্রান্ত সব ভারসাম্যহীনতা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা জরুরি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। কেননা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালন রীতিমতো একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। এর ওপর রুটি-রুজি নির্ভর করছে দেশের প্রচুর সংখ্যক মানুষের।