সেইরকম যখন মশিউরের সাথে ধানমন্ডি, জিগাতলা এইসব এলাকা নিয়ে কথা হয় দুজনেই ফিরে যাই যার যার স্মৃতিকাতর স্থানে। যদিও দুজনের পছন্দের জায়গাগুলো আলাদা, অনুভূতিগুলো আলাদা। সে হয়তো আবেগ কাতর হয়ে ফিরিস্থি দেয় ধানমন্ডিতে, সাতমসজিদ রোডে কোন কোন রেস্ট্যুরেন্টগুলো ডেটিং প্লেস হিসেবে দূর্দান্ত ছিল, আমার দৌড় ক্লাশ পালিয়ে সিটি কলেজ থেকে হেঁটে হেঁটে নিউমার্কেট যাবার উত্তেজনা অবধি। তার স্মৃতিতে ধানমন্ডি লেকের পাশের বকুল গাছটা আর আমার মনে পড়ে বিডিআর ক্যাম্পাসে ৫ নং গেইটের কাছের পুকুর ধার জুড়ে বকুলের সারি, স্কুলের জানালা থেকে দৃশ্যমান দেবদারু গাছ, সিনেমা হলে যেয়ে সিনেমা দেখা। দু'জনে হয়তো কারো কথা কেউ মন দিয়ে শুনিনা তবে দু'জনেই আপন মনে বলে যাই ফেলে আসা সেই দিনগুলোর কথা, সেই পথ, সেই শহরের কথা।
ঢাকা শহর নিয়ে আমার প্রবল উচ্ছাস আমি সবসময় প্রকাশ করে এসেছি, এই শহরটার সাথে আমার নাড়ীর বন্ধন। তার মধ্যে জিগাতলা, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, চাদনীচক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চাঙ্খারপুল এসব এলাকার সাথে কেমন একটা আলাদা আদর মাখা অতীত জড়ানো। অনেক বদলে গেছে এই পথ ঘাট, বিচ্ছিরি ঘিঞ্জি হয়ে গেছে, তবু যখন দু'নম্বর রোড দিয়ে যাই, মনে পড়ে যায় শীতের সকালে দুয়াশা ঘেরা লেকের পাশ দিয়ে কলেজ যাবার স্মৃতি।
অনেক দিন পরপর যাওয়া হয় ওদিকটাতে। গেলে বাড়ীর সবার সাথে গল্প কোনমতে সেরে ছুট দেই ঘুরে বেড়ানোর জন্য। কখনো একা কখনো কেউ সাথে থাকে। জিগাতলা যাওয়া হয় অনেক কম আজকাল। এবার একদম হঠাতই এজতেমার কারনে তিনদিন ছুটি পড়লো, এর আগের সপ্তাহেও তিনদিন ছুটি ছিল, জাফনাকে পটালাম চল নানুর বাসায় ঘুরে আসি, পিচ্চি ঘুম থেকে উঠে বিরাট চিন্তায় পড়লো, যাবে কি যাবে না। অনেকক্ষন পর বলছে আম্মু আমি খুব কনফিউজড নানু বাসায় যাব কি যাব না। ছুটির দিন মানেই আমার গড়াগড়ি করবার দিন। আমি খুশীই হলাম জাফনা কনফিউজড হওয়াতে। খুশী মনে অনেক আরাম করে, এরপর অনেকদিন পর রান্নাঘরে সময় কাটালাম।
এ সপ্তাহে শরীরটা ভাল লাগছিল না, গলাটা খচখচ করছে, সেটার সাথে দলেবলে হালকা জ্বরজ্বরও লাগছে। তাই এবার কোথাও না যেয়ে বাসায় অনেক রেস্ট নেব ভাবছিলাম। তবু ঐ যে ছুটি দুদিনের বেশী হলে মাথায় পোকা ঢোকে একটু জিগাতলা যাই, কতদিন আব্বাকে দেখিনা! সকালে ঘুমভাঙ্গা চোখে জাফনাকে বললাম যাবে নানু বাসায়? সে বলল যাবে। তাকে আর কনফিউজড হবার চান্স না দিয়ে বললাম তাহলে শিগগীর ওঠো, নাস্তা কর, কাপড় গোছাও, শাওয়ার নাও...লেটস গো। সেও তুমুল উদ্দমে ছুটাছুটি শুরু করলো। সব কিছু সেরে তৈরী হতে হতে বেলা প্রায় বারোটা, আরেক প্রস্থ চা খেয়ে নিলাম। শুক্রবার বলে রাস্তায় জ্যাম কম, তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম। আব্বার সাথে কতক্ষন গল্প করে ওপরে উঠতে শুরু করলাম, বাকিদের সাথে দেখা করার জন্য। জাফনা ও বাড়ীতে গেলে তার খেলা সঙ্গীদের নিয়ে তুমুল ব্যস্ত থাকে। তাই সে আমার থেকে আলাদা হয়ে গেল। যখন ক্ষিধে পেল তখন আমাকে ডাকতে এল। আমি আম্মুর সাথে কুটুর কুটুর গল্পে মশগুল।
বিকেল হতেই বাইরে যেতে ইচ্ছে করছিল, মনে হল পারভীন আপাকে ফোন করি। ফোন করা মাত্র আপা তো হৈচৈ করে বলে “চলে আসো, ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে হাঁটবো আর চটপটি খাব।” আপু আবার পাঁচ মিনিটে রেডি হতে পারেন




আপুর প্রিয় নস্টালজিক স্থান হল ঢাকা ভার্সিটি এলাকা, হবে নাইবা কেন সেখানে উনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অন্যতম মধুর দিনগুলো কাটিয়েছেন। আমরা নীলক্ষেত পর্যন্ত গাড়ীতে গেলাম এরপর রিকশা নেব। রিকশাওলারা উল্টাপাল্টা দাম চাওয়া শুরু করলো, দাম শুনে মেজাজ খারাপ, আমি তো আর উঠি না, শুধু সামনে চলছি। একটু এগুতেই একটা রিকশা কম দাম চাইল। উঠতে উঠতে আমি বললাম, পারুপা দুই মটকু কে দেখে ভেবেছে যা দাম বলুক না কেন উঠে পরবো

আমরা টিএসসি পর্যন্ত রিকশা করে গেলাম। টিএসসির ডাস এর পেছনে আলোচনা সভা চলছে। কবিতা আবৃত্তি হবে মনে হল। আমাদের সেরকম নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই। ইচ্ছে মতন ঘুরে বেড়ানো ই প্ল্যান। প্রথমেই আমি বললাম ভুট্টা ভাজা খেতে হবে। ভুট্টা ভাজা খেতে চাইলেই খাওয়া যায় না, ভুট্টা ভাজবে তারপর খেতে হবে। কয়লার আগুনে সেই ভুট্টা ভাজার আবার রয়েছে কিউ। তবে ভাগ্য ভাল মাত্র একজনের পরে আমাদের সিরিয়াল। এক সময অপেক্ষার শেষ হল, দুজন দুটো ভুট্টা নিয়ে কুড়মুড় করে খেতে খেতে শুরু হল এদিক ওদিক হাঁটা।

হাঁটছি আর গল্প করছি। চারপাশের উচ্ছল মানুষজন দেখতে ভাল লাগছিল। একটি মেয়ে চমতকার একটা শাড়ী পড়ে অপেক্ষা করছে। কি মিষ্টি লাগছে। আরেকজন তো অপেক্ষা করতে যেয়ে অপরজনকে দিচ্ছে মুঠোফোনে কঠিন ঝাড়ি

হাঁটার সময় যে বিষয়টা যন্ত্রনা দিল তা হল ডাস্টবিন পর্যাপ্ত না হওয়াতে এলোমেলো নোংরা স্তুপ করে রাখা, আর সারা ফুটপাত জুড়ে পয়কার্য সম্পাদন করে রাখা। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমি বলেই ফেললাম এখানে একটা পাবলিক টয়লেট কেন বানায় না!




বাংলা একাডেমিতে বইমেলার জন্য স্টল বানানোর প্রস্তুতি দেখলাম। ফ্রেব্রুয়ারী জুড়ে আমার রাজ্যের কাজ সেই কথা মনে পড়াতে আবার মন খারাপ হল। কবে যে বইমেলাতে আসার সুযোগ পাব! দিশা বইমেলা চলার সময় এলে কত মজা হত বারবার ভাবছিলাম আর বলছিলাম দুজনেই সে কথা।
টিএসসির কাছে এসে পারুপার ইচ্ছে ভেতরে ঢুকবে। এই টিএসসি পারু আপার জন্য কঠিন পছন্দের। ভাইয়া উনাকে এখানে প্রথম প্রপোজ করেছিলেন


বাইরে বেরুতে দেখা গেল সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। পারু আপা বলে “আরে ঢুকলাম দিনে, বেরুলাম রাতে!” এরপর যাই খেতে চাই হয় আমার দোষে, না হয় পারুপার জ্বালায় আর খেতেই পারি না।
যেমন পারুপা ডিম খেতে গেলে আমি বারণ দেই।



আমি আইসক্রিম শেষ পর্যন্ত খেয়েই ফেলব এমন ভাব করতে করতে পারুপা আমাকে থামায়



আমি উনাকে কটন ক্যান্ডি খেতে দিই না





আর উনি আমাকে ঝালমুড়ি।




খাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফুল বালিকা এসে হাজির, নামমাত্র দামে তার ফুলগুলো আমাদের হয়ে গেল।

আমরা খাবারগুলো কিভাবে যে নেব সাথে পড়লাম বিরাট ঝামেলায়। হাত মোট চারটা, খাবারের প্লেট আর কফির কাপ মিলে হর পাঁচটা, পরে আমি সবগুলো এক প্লেট এ ঢেলে চার হাতে বহন করে একটা যায়গা খুঁজে নিয়ে আয়েশ করে খেতে বসলাম।

খেতে খেতে আফসুস করলাম প্যাং প্যাং সাথে এইসব জায়গায় এলে এই সব হাবিজাবি কিচ্ছু খেতে দিবেনা, কেবল মাত্র ইচ্ছে মতন চা খেলে কোন আপত্তি নেই।
আমরা খেলাম, ইচ্ছেমতন পরচর্চাও করলাম খানিকটা




খাওয়া শেষ করে আমরা আবার শুরু করলাম হাঁটা । টিএসসি থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিল এরপর উল্টো হাঁটা, হাঁটতে হাটতে নীলক্ষেত। ব্রিটিশ কাউন্সিল রোড দিয়ে হাঁটার সময় পারুপাকে অনেক মজার কথা শোনালাম। এখানে একদিন আমার জন্য ওয়েট করতে যেয়ে প্যাং প্যাং যে তার বিচ্ছু বাহিনী খবর দিয়ে জড়ো করে একশেষ, এরপর দেখা গেল, “কাবাব মে হাড্ডি” নিয়ে সে মহা বিপদে আছে; না পারে কইতে না পারে সইতে


এইরকম গল্পের ফুলঝুড়ি ফোটাতে ফোটাতে আমরা নীলক্ষেত পৌঁছলাম। রিকশায় উঠেও গল্পের কোন শুরু নেই শেষ নেই অবস্থা করতে করতে আমরা ধানমন্ডি পৌঁছে গেলাম, দুজনে এবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যার যার ঘরে ফিরে এলাম। এরপর আবার জিগাতলা গেলে আরো সময় নিয়ে হান্টু হান্টু করতে বের হব সেই কথাই রইল আমাদের।