টুউম্বা শহরটা দেখে আমাদের ধারনাই হয়ে গেছিল যে এখানে কোন বাঙালী নেই। ভাবখানা এই, এত দূরে বাঙালীরা কি জন্য আর আসবে। প্রথম দিন এসেই ফেসবুকের ওয়ালে সেল ফোনের নম্বরটা দিয়েছিলাম স্বপ্নজয়কে, সে সূত্রে বেশ কটা ফোনও পেলাম। সবচেয়ে মজা হোল ইউনির এক বন্ধুর আচমকা ফোন, জানতাম সে অষ্ট্রেলিয়াতেই পিএইচডি করতে এসেছে......কোথায় সেটা নিশ্চিত জানা ছিল না। ফোন করেই সে দিল ঝাড়ি, "টুউম্বা এসেছে আমাকে জানাবা না!" আমি তো যুগপত বিস্ময়ে আনন্দে "তুমি টুউম্বাতে নাকি!" আর যায় কোথায়! এতদিন কলিগরা জানতো মেলবোর্ন, সিডনি, ব্রিসবেন এ আমার পরিচিতজনরা আছে........এখন এই শান্ত নিরব শহরটাতেও একজনকে পাওয়া গেল। আনন্দে তো আমি আত্মহারা।
বন্ধু, বন্ধুপত্নী এবং তাদের মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে দেখা হোল পরপর কদিনই। বেশ জমিয়ে বাঙলা খাবারও খাওয়া হোল। এভাবেই আরো অনেকেরই দেখা পেয়ে গেলাম আমরা, একজন আবার আমাদের অফিসেরই পাশের অফিসে বসেন...........আবার আমাদেরই সিনিয়র প্রাক্তন কলিগ!
এর মাঝে আমরা একদিন ব্রিসবেন হাউজ অফ পার্লামেন্টে ক্রফোর্ডফান্ডের কনফারেন্স এ গেলাম...পলিসি লেভেলের কনফারেন্স...অনেক রাঘব বোয়াল টাইপ মানুষের সাথে দেখা হোল। বিকেলের সেশনে ঘুম থামাতে না পেরে আমি বেড়িয়ে হাটতে চলে গেলাম......ব্রিসবেন রিভারের উপর দিয়ে পায়ে চলা "গুডউইল ব্রিজ" ধরে হেটে এমাথা ওমাথা করে ফিরে এলাম। এই ব্রিজে শুধু পায়ে হেটে আর সাইকেল চলে।
প্রথম সপ্তাহটা ঘুরে বেড়িয়ে ভাল কাটছিল, সপ্তাহ শেষে আমার আরিয়ানার বাসায় যাবার কথা। ডনকে আর নিএলকে এই নিয়ে আমি জ্বালিয়ে মারছিলাম। জোয়েন অনলাইনে আমার আসা যাওয়ার টিকেট করে দিল, আর ডন মুহুর্মুহু মেইল করতে লাগলো কেমন করে আমি বাস ট্রেন করে আরিয়ানার বাসা অবধি যাব। এরমধ্যে গুগল মোটামুটি ভেজে খাওয়া হয়েছে পথ বোঝার আশায়। স্বপ্নজয়কে বলছিলাম যদি পথ হারাই! বেচারাকেও ভয় ধরিয়ে দিলাম আর কি! আরিয়ানা তখন সিঙ্গাপুরে, সেইদিন সন্ধ্যারাতেই ফিরবে, তাই একলা চলা! আমাদের শেষ ভরসা পথ হারালে ক্যাবে উঠে সোজা ওর বাসায় চলে যাব।
শুক্রবার বিকেলে নিএল আমাকে বাসে তুলে দিল। পথে নাআমি আপুকে মেসেজ পাঠালাম। বাস ব্রিসবেনে পৌছানোর পর ট্রেন স্টেশনে যেয়ে খুজে খুজে ট্রেন এ উঠে বসলাম। আমার নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন থামলো, ধারনা ছিল ট্রেন এর দরজা আপনা আপনি খুলবে, সে আশায় অপেক্ষা করতে করতে যখন ট্রেন চলা শুরু করলো তখন বুঝলাম কর্ম সাবার! পরের স্টেশনে নেমে পরলাম। ময়মনসিংহের কোন প্রত্যন্ত জাংশনের মতন ছোট্টএকটা স্টেশন এ ক'জন ভুল করে নেমে পড়েছি। ইনফরমেশন জানাবার জন্যও কেউ নেই।
নাআমি আপুকে ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করে ফেললাম, উনি বললেন ওখানেই থাকতে উনারা আমাকে ওখান থেকে উদ্ধার করবেন। এদিকে মিনিট দশেক পরে উল্টো পথে আরেকটি ট্রেন এসে পড়াতে আমি আর দেরী না করে চড়ে বসলাম। কে থাকে একা একা ঐ ভুতুড়ে স্টেশনে!
এরপর স্টেশনে বাসের জন্য অপেক্ষা। নাআমি আপু একটা টেনশনের ডিপো, তার উপর বেচারাকে আমি এত ঝামেলায় ফেলেছিলাম যে উনি আমাকে একটু পর পর ফোন করছিলেন, বাসে উঠবার তিনি শান্ত হলেন। বাস আমাকে নামিয়ে দিল, গুগল এবং আরিয়ানার নানা পোস্টে দেখা বের কিনারা ধরে হেটে ওর বাড়ী পৌছে গেলাম। ওদের বাড়ীর কেয়ার টেকার কে ফোন করলাম, চমতকার মহিলা এবং তার হাসবেন্ড নীচে নেমে আমাকে বাড়ী পর্যন্ত পৌছে দিল। আরিয়ানা
ব্যাগ পত্র রেখে আমি আরিয়ানার ছবির মতন সাজানো বাড়ীটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে বারান্দার চমতকার বসবার যায়গাটায় বসে বসে নীচে মানুষজনের উইকেন্ডের কোলাহল দেখছিলাম। ওটা ছিল বাকী দিনগুলোতে আমাদের আড্ডাঘর। একটা করে টেক্সি আসে আর আমার মনে হয় এই বুঝি আরিয়ানা এল। নাআমি আপু ফোন করে নিশ্চিত হয় পৌছলাম কিনা। ডন, নিএল আর স্বপ্নজয়কে জানিয়ে দিই পৌছবার খবর।
একসময় সেল ফোনটা বাজে। আরিয়ানা পৌছতে পেরেছে, বৃষ্টির জন্য প্লেন ল্যান্ড করতে পারছিল না। আরো খানিক পরে এল, ব্যাস শুনশান হয়ে থাকা ঘরটা ঝলমল করে উঠল। দুজনে কলকল কলকল। এত বড় জারনি করে এসে আবার রান্না বসাল, রান্না শেষে দূজনে ব্যালকনির আড্ডঘরে বসে ধুমসে খাওয়া আর গপ্প। খাওয়া শেষ করে আবার আড্ডা সাথে ফেসবুকে প্রতি মিনিটের আপডেট দেয়া চলছিল সমান তালে। বাজছিল প্রিয় গান। সামনে সাগরের হিম হিম বাতাস আর ঢেউয়ের ছপছপ শব্দ।
এই সামুতে আরিয়ানার সাথে পরিচয়, সেই পরিচয় কিভাবে আমাদেরকে বিনিসুতোয় বেধে ফেলেছে তা আমরা নিজেরা ও বলতে পারবো না। সেই যে একবার ঢাকায় আমার ছোট্ট ঘরে দিনভর রাত দুপুর জুড়ে আমরা নিজেদের অনেক না বলা কথা নিজের অজান্তেই দুজনকে বলে ফেললাম....সেই থেকে এই বাধনটা শক্ত একটা ভিতের উপর দাড়িয়ে গেল। মনে মনে আমি জেনে গেলাম...পৃথিবীর এক প্রান্তে একজন আমার জন্য শুভকামনা নিয়ে বসে আছে সমস্ত অন্তর জুড়ে। সেই থেকে আমরা পরস্পরের সত্যিকারের বন্ধু হলাম। ব্রিসবেনে তাই ওর সাথে দেখা করা ওর বাড়ী থাকা এগুলো ভাবা সহজ ছিল...সেটার কৃতিত্ব ও তার, অস্ট্রেলিয়া যাবার আগ পর্যন্ত কত যে ফোন করছে. প্লান করছে, আমাকে নিয়ে উতকন্ঠা করছে যে, এই মেয়েটাকে ভাল না বেসে পারা যায় না, আপন না ভেবে পারা যায় না। আবার এটাও হতে পারে আমাদের মন মানসিকতার মিল এই চটজলদি সম্পর্কের সূচনার জন্য দায়ী।
ব্রিসবেনে ওর স্বপ্ন মাখা বাড়ীটার বিশাল ব্যালকনিতে বসে আমাদের গল্প যেন পাখা মেলল। এত মন খুলে এত উচ্ছল হয়ে সমমনা, সমব্যাথী একজনের সাথে এতটা সময় পার করা হয় না বহু বহু দিন। আমরা আনন্দে ভাসলাম, ও আমাকে দিয়ে দিল অনেকটা জীবনীশক্তি। কৃতজ্ঞ আমি ওর কাছে, ওর ভালবাসার কাছে, প্রতি পদে পদে।
পারভীন আপা এর মাঝে কুটুস কুটুস করে কমেন্ট করেন, উনাকে ফোন করে তুমুল হৈচৈ করা হোল, এরপর সুরঞ্জনা দিদিকে ফোন করে সেই একই হৈচৈ। আমাদের দুই জনের নামের শেষেই দিদি পাগলী শব্দটা জুড়ে দিল। নাআমি আপুর হিংসিত ধমক ”ঘুমাতে যাও”।
রাত গড়িয়ে যায় আমাদের গল্প যেন থামে না! মন খুলে আড্ডা দেয়া বুঝি একেই বলে। একসময় মনে হোল সাগর পাড়ে একটু ঘুরে আসি.........রাত তখন বারোটাও বেশী। বেড়িয়ে দেখি শীতের কি কামড়! সাথে টিপটিপ বৃষ্টি। পড়িমড়ি করে ছুটে আবার ফিরে এলাম....আরিয়ানা হিহি করে কাপছে শীতে। আর আমরা দূজনেই হেসে কুটিকুটি।
আরো অনেক রাত অবধি চলল আমাদের গল্প। এক সময় মনে হোল এবার বিছানায় যাওয়া দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১১ সকাল ১০:৪৮