২০১১ সালে হিন্দি ছবি জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা দেখেছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম '' আহ,জীবনটা যদি এমন হত,বন্ধু-বান্ধব সহ ঘুরে বেড়াতাম আর পালিয়ে বেড়াতাম গতানুগতিক ব্যস্ততা থেকে ...... " এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই আমার স্পেন প্রবাসী বন্ধু রাসেল এবং লন্ডন প্রবাসী অজয়ের সাথে স্কাইপি তে কনফারেন্সে নিজের এই স্বপ্নের কথা দুই বন্ধুকে ব্যক্ত করেছিলাম।অনেকটা খেয়ালিপনার বসেই বাকি দুই বন্ধু বলে বসলো তুই লন্ডন চলে আসার পর আমরাও একসাথে ঘুরতে বের হব, চিন্তা করিস নাহ। কে জানে,আল্লাহ সেদিনই আমাদের মনের আকুতি শুনবেন.........
২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস,জীবনের তরী লন্ডনে ভাসালাম।মফস্বলের ছোট্ট শহরে বেড়ে উঠা এই আমি প্রাসাদ সম অট্রালিকার শহরে এসে অনেকটা ঘোরে পড়ে গেলাম,চারদিকে হাজার মুখের ভিড়ে নিজেকে বড় অচেনা মনে হতে লাগলো......... ব্যস্ত লন্ডনের ব্যস্ততার সাথে পা মিলিয়ে ডুবে গেলাম পড়াশুনা আর কাজে।পরিচিত কোন মানুষ ছাড়া নতুন কারো জন্য লন্ডনে কাজ পাওয়াটা কতোটুকু কষ্ট সাধ্য কাজ সেটা কেবল যারা লন্ডন থাকে কেবল তারাই জানে (সেই গল্প আরেকদিন করবো) ...... কিভাবে কেটে গেলো ৯ টা মাস টেরই পেলাম নাহ। হঠাৎ করে একদিন রাসেলের সাথে স্কাইপিতে আবার কথা বলতে বসলাম,কথার এক পর্যায়ে ও বলল কিরে আসবি নাহ ??? ব্যস, পরীক্ষার মধ্যেই পড়াশুনা আর ভিসার প্রসেসিং শুরু করে দিলাম।যদিও অনেক ভয়ে ছিলাম ভিসা পাবো কিনা কারণ যেই পরিমাণ ছাত্র নামধারী মানুষ লন্ডন থেকে ইউরোপ পালিয়েছে তাতে এখনও যে আমাদেরকে সেঞ্জেন ভিসার জন্য আবেদন করতে দিচ্ছে সেটাই বড় ভাগ্য। দুর্ভাগ্যবশত, অজয় নিজের ভিসা বাড়ানো নিয়ে ঝামেলায় ছিল তাই আমার সাথে যোগ দিতে পারে নি।এদিকে ভিসা প্রসেসিং এর সাথে চলতে থাকলো আমাদের দুই বন্ধুর কথা মালা............ প্রথম কোথায় যাবো, কি করবো,এরকম হাজারো প্রশ্ন বোধক চিহ্ন মনে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ভিসার জন্য কাগজ পত্র জমা দিলাম।কাগজ জমা দেয়া আর ভিসা হাতে পাওয়ার মাজের এক সপ্তাহ যে কিভাবে কেটেছে সেটা ঐ অবস্থায় না থাকলে কেউ বুঝবে না............ আল্লাহর রহমতে নির্দিষ্ট দিনে ভিসা পেলাম এবং দিলাম উড়াল ভেনিসে ..................
ভেনিস শহর।
ভেনিস,এই সম্পরকে নতুন করে আর কি বলবো ??? জগত বিখ্যাত এই শহরকে কেউ বলেন ভাসমান শহর,কেউ বলেন ব্রিজের শহর আবার কেউ বা বলেন গন্ডলার শহর...... এছাড়াও রোম্যান্টিক শহর হিসেবেও ভেনিস এর ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। ভেনিসের গড়পত্তন হয় 1421 A.D তে এবং পরে এটি ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিনত হয়।পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বণিকের দল ছুটে আসতো ভেনিসের উদ্দেশে বেচা কেনা করবার জন্য। ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে ভেনিসের পতন অনেক আগে ঘটলেও বর্তমানেও ভেনিস ঠিক আগের মতই বিখ্যাত কেবল এর নির্মাণশৈলীর কারনে,ভেনিস যতটুকু না একটি শহর তার চেয়েও বেশি একটি দ্বীপ। ১১৮ টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এই শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে ১৫০ টির মত ছোট বড় খাল... এই খাল কিংবা ক্যানালগুলোর পাড়েই তৈরি হয়েছে হাজারো দালান,শহরের বাসিন্দাদের যোগাযোগ তথা চলা ফেরার সুবিধার্থে প্রায় ৪০০'র মত ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল। এসব কিছু মিলিয়েই ভেনিস,লক্ষ লক্ষ পর্যটকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু যেটা কিনা বিশ্বের একমাত্র শহর যেখানে মার্সিডিজ কিংবা ফেরারি মূল্যহীন কারণ শহরের মুল বাহন হচ্ছে গন্ডলা নামক বিশেষ ঐতিহ্যবাহী নৌকা।
গন্ডলা.........
আমার ফ্লাইট দেরি হবার সুবাদে আমি ভেনিস গিয়ে নেমেছিলাম রাত ১২ টায়। বলাবাহুল্ল্য,ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্টের দিকে তাকিয়ে এমন ভাব করেছিলেন যে যদি সুযোগ থাকত তাহলে উনি ঢুকতে দিতেন না।যাই হোক, সেখানে আমার মামা ছিলেন আমাকে রিসিভ করার জন্য,এয়ারপোর্ট থেকে ভেনিস মুল শহর প্রায় আধা ঘণ্টার দূরত্ব। বাসে চড়ে ভেনিস ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তেই দেখলাম বিশাল একটি ব্রিজের অপর প্রান্তে একটি আলো ঝলমল শহর দেখা যাচ্ছে,আমার মামা সাথে সাথে আমাকে বললেন ঐ জলরাশির অপর পাড়ের শহরটিই ভেনিস। মুলত এই বিশাল ব্রিজটিই ভেনিসকে মুল ভু খণ্ডের সাথে যুক্ত করে রেখেছে।
বাস থেকে যখন ভেনিসে নামি তখন রাত ১২টা ৩০,ভেনিসে পা ফেলার সাথে সাথেই দেখি বড় একটি ক্যানাল তখনি বুঝলাম কেন এই শহর পৃথিবীর লাখো পর্যটকের তীর্থস্থান............ বাসায় যাবার জন্য মামার যেই বন্ধু আসবে আমাদেরকে পিক করতে আসার কথা উনার একটু দেরি হচ্ছিলো এই ফাঁকে মামা বলল,ভাগ্নে একটু পিঁজার স্বাদ চেখে দেখ ?? মামা ভাগ্নে দুইটা পিঁজার পিস হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম ভেনিসের রাস্তায়............ আহ সেই দৃশ্য,বলে বুঝানর মত নয়।রাতের বেলাতেও হাজারো পর্যটক ভেনিসের রাস্তায় ঘুরাঘুরি করছে,কিছু কাপল আবার পাড়ে বসে পা চুবিয়ে রেখেছে ক্যানেলের পানিতে,মাঝে মাঝে ওয়াটার বোটগুলো শব্দ করে ছুটে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি বোনাস হিসেবে আছে আকাশে চাঁদ ,বলতে দ্বিধা নেই মাত্র আধা ঘণ্টাতেই আমি ভেনিসের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।
রাতের ভেনিস।
মামার বাসায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম রাত ২ টায়,খেয়ে দেয়েই দিলাম ঘুম কারণ পরদিন সকাল ১০ টায় রাসেলকে রিসিভ করতে হবে এবং এরপর শুরু হবে আমাদের ঘোরা ঘুরির পালা.................. ( চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৩ ভোর ৬:৫৬