৩
'কাল রাতে ওকে স্বপ্নে দেখলাম। ওকে মানে আবিরকে। দেখলাম আবিরদের গ্রামের সেই বিশাল খেলার মাঠটা। ঝকঝকে দিন। ঘুড়ি উড়াচ্ছে আবির। আমাকে হাত ইশারায় ডাকলো ও। কিন্তু আমি তো ঘুড়ি উড়াতে পারিনা। সে বললো শিখিয়ে দেবে। খুব হাসছিলো ও। আপুর বিয়ের পর যেবার আপুর সাথে তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গেলাম, একদিন ঠিক একইভাবেই আমাকে ওর সাথে ঘুড়ি উড়াতে ডেকেছিলো আবির।'
এইটুকু পড়ে আমি চোখের সামনে দেখতে পাই খুব সাধারণ চিরায়ত বাঙ্গালী প্রেমের একটুকরো প্রতিচ্ছবি। পাথরকুঁচি ও এই আবিরের বাকী প্রেমকাহিনী বুঝতে আমার বাকী থাকেনা। আমার মনে পড়ে শৈলীর সাথে দেখা হবার প্রথম মুহুর্তটি। শৈলীর নিস্পাপ গোলগাল মুখটিতে প্রথম চুমু খাবার সেই মায়াময় প্রহর। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো বেচারী। আর আমি চলে আসবার আগের দিনটিতে সে কি কান্না পাগলীটার। কিছুতেই বুঝাতে পারছিলাম না ওকে যে আমি ওর কাছে ফিরবোই। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে ওর কাছে ফেরা হলো না আমার আর।
আমার এক্সিডেন্টের পর অচেতন ছিলাম যখন আমি হয়তো দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো বেচারী। এখনও প্রায়ই ফোন করে। আগে রোজ করতো আমিই এভোয়েড করা শুরু করি ওকে এরপর। হু হা করে সরিয়ে দিতে চাই আমার থেকে। আমার এই আশাহীন, ভবিষ্যৎহীন জীবনের সাথে জড়াতে চাইনা আমি আর আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে। শৈলী বলে বাড়িতে ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ওর বাবা মা মরিয়া হয়ে উঠেছে ওকে বিয়ে দিতে। কানা ঘুষা ও আমার লেখা কিছু চিঠি ওর বড়ভায়ের হাতে ধরা পড়ার পর তাদের নিশ্চিৎ হতে বাকী নেই আমার সাথে আসলেও কি সম্পর্ক রয়েছে তার। প্রতিবেশি হবার সুবাদে ও বাড়ির কারু আর জানতেও বাকী নেই আমার এ করুন পরিনতির কথা। নিশ্চয় জেনে শুনে কেউ তাদের মেয়েকে তুলে দিতে রাজী নন এই অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের কোনো পঙ্গু ছেলের হাতে।
অঝরে চোখ দিয়ে জল ঝরে আমার। এই এক বাজে হ্যাবিট হয়েছে আজকাল এক্সিডেন্টের পর থেকে। যখন তখন চোখে জল আসে মেয়েদের মত। মেয়েলী ব্যাপার স্যাপারগুলো বুঝি মন দূর্বল হলে চলে আসে মানুষের মাঝে। আমিও চাই শৈলী ভালো থাকুক। একজন সুখী বঁধু হোক সে, এরপর হয়ে উঠুক একজন গর্বিত মমতাময়ী মা। ধীরে ধীরে সংসারের নানা চক্রে অবশ্যই ভুল যাবে সে আমাকে একদিন। একজন দুঃখী মানুষের স্ম্বতি হয়ে বাঁচতে চাই না আমি আমার এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির কাছে। সে সুখী থাকুক, সুখী তাকে হতেই হবে। এরচেয়ে আমি পাথরকুঁচির দুঃখ নিয়ে ভাবি। ওর লেখাগুলোর উপর মনিটরের স্ক্রীনে আলতো আঙ্গুল বুলোই। যদি পারতাম তো আমার জীবনের বিনিময়েও হয়তো ফিরিয়ে দিতাম এই দুঃখী মেয়েটার সকল সুখ।
“সারাটা দিন যাও বা কাটে, যখন রাত্রী নামে চারিদিক শুনশান তখন যেন রাতের আঁধার গ্রাস করে আমাকে। আঁধারের মনে হয় এক ধরনের শূন্যতা আছে। তখন আমার আবিরের জন্য খুব কষ্ট হয়। আমি ওর দেওয়া আংটিটা চুপি চুপি বের করে বসে থাকি হাতে নিয়ে। মনে হয় আবির আমার হাত ধরে আছে। আমার চোখ থেকে পানি ঝরে। কত কত চোখের পানি যে শুকিয়ে আছে এই আংটির গায়ে! আমি একদিন এই আংটিটা আবিরকে ফিরিয়ে দেবো। সে যদি আমার মৃত্যুর পরেও হয়ে থাকে তবুও আমি বলে যাবো এই আংটিটা যেন কোনো না কোনো একদিন আবিরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
আংটিটা পেয়ে হয়তো আবির খুব অবাক হবে। কিন্তু ও কোনোদিন জানবেনা কত রাত্রীর কান্নার জল শুকিয়ে আছে ঐ আংটিটার গায়ে....."
একফোটা জল গড়িয়ে পড়ে টপ করে আমার ট্যাবের স্ক্রিনে। মেয়েটার লেখার ক্ষমতায়, তার আবেগ প্রকাশের দক্ষতায় আমি চমৎকৃত হয়ে যাই। আমার হাতের অনামিকার সাদা হয়ে থাকা আংটির অংশটায় চোখ পড়ে আমার। আমিও শৈলীকে দিয়ে এসেছিলাম আমার এই একই স্মৃতি। শৈলীও কি আমার আংটিটা হাতে নিয়ে কাঁদে? আমার আবার মন খারাপ হতে থাকে শৈলীর জন্য। তবে আমি ঝেঁড়ে ফেলতে চাই সে কল্পনা। শৈলীর আমাকে নিয়ে ভাবা দুঃখ ভাবলে বরং জগতে ও তার জীবনে দুঃখ বই আনন্দ বাড়বে না এক ফোটা। বরং যত তাড়াতাড়ি সে ভুলে যেতে পারে আমাকে ততই মঙ্গল।
পাথরকুঁচি লিখেছে,
"আমি যখন কাঁদি-
আমার পাথর চোখের কোনা দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ে। অক্ষিবিহীন পাথর চোখে জল গড়াতে পারে এ আমার জানা ছিলো না।
তবে কি আমার জীবন্ত চোখটির দুঃখে আমার পাথর চোখও কাঁদে?"
আমার চোখ পাথরকুঁচির মত পাথরের তৈরি নয় তবুও ওর লেখা পড়ে আমার চোখে অবিরল জল ঝরে। আমার জীবন্ত চোখগুলি পাথর হয়ে ওঠে। পাথর চোখের দৃষ্টি দিয়ে আমি ছুঁয়ে যাতে চাই পাথরকুঁচির দুঃখটাকে। আমি মনোস্ত করি ওর সাথে যে কোনো মূল্যে যোগযোগ করবার।
৪
পাথরকুঁচিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি আমি। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবার পর থেকেই সে লা পাত্তা। সে আর লিখছে না বেশ কিছুদিন হলো। কি হলো মেয়েটার? আমি মনে মনে ওর জন্য এক অস্থিরতা বোধ করতে শুরু করি। বলতে গেলে দিনের ২৪ ঘন্টার মাঝে ১৬ ঘন্টাই ল্যাপটপ অন রাখি আমি সাইড টেবিলের উপরে। বাকী ৮ ঘন্টাও অন রাখতাম কিন্তু এটি হসপিটাল হওয়ায় ডক্টর এবং নার্সের কিছু কড়া নির্দেশ একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও মানতে হচ্ছে আমাকে।
সতেরো দিন পর হঠাৎ একদিন সকালে দেখি পাথরকুঁচি আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছে। আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে অতি কষ্টে নিজেকে দমন করি আমি। খুব আনন্দ নিয়ে দিনটি শুরু হয় আমার। আমি আয়েশ করে হসপিটালের দেওয়া বাটার ব্রেড, পোচড এগ আর দুই পিস আপেল খেয়ে এক হাতে কফির মাগ আরেক হাতে ল্যাপটপ টেনে নিয়ে বসি। পাথরকুঁচিকে মেসেজ পাঠাই,
থ্যাংকস ফর এক্সেপ্টিং মি এ্যজ আ ফ্রেন্ড। পাথরকুঁচি মেসেজটা সিন করে কিন্তু কোনো রিপ্লাই দেয় না। অদ্ভুৎ নীরবতায় সময় পার হতে থাকে। তার তরফ থেকে কোনো রিপ্লাই আসে না। আমার অস্থিরতা রিতীমত প্যালপিটিশনে রূপান্তরিত হয়। আমি বুঝতে পারিনা কোনো উত্তর দিচ্ছে না কেনো মেয়েটা! নিজের আত্মসন্মান ভুলে আবারও মেসেজ পাঠাই আমি, আর ইউ দেয়ার? এবারও সিন করে সে কিন্তু উত্তর দেয় না। লজ্জা এবং অপমানবোধে রক্তিম হয়ে উঠি আমি।
এমন সময় আমার সকল অস্থিরতা, অবষন্নতা ও বিষাদীয় আবেগের অবসান ঘটিয়ে পাথরকুঁচি মেসেজ রিপ্লাই করে।
- হাই। স্যরি ফর লেট রিপ্লাই।
- ইটস ওকে কেমন আছেন পাথরকুঁচি? আপনার নামটা বড় সুন্দর!
পাথরকুঁচি নিরুত্তর থাকে। অধীর হয়ে উঠি আমি।আবার বলি,
-আপনি রিসেন্টলি একটা লেখা লিখছেন। কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতাম।
পাথরকুঁচি যথারিতী নিরুত্তর।
- প্রশ্নটা করতে পারি?
- আচ্ছা করেন।
মনে হয় অনিচ্ছাসত্বেও উত্তর দিচ্ছে পাথরকুঁচি। আমি ওর সব কিছুই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখি।
- আপনার লেখাটা আমি মন দিয়ে পড়ি। বলতে গেলে লেখাটার জন্য আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি জানেন?
- না জানিনা।
- তার সরল স্বীকারক্তিতে মুগ্ধ হই আমি। খুব সাবধানে ও যেন একটুও হার্ট না হয় সেভাবে যতখানি লিখে প্রকাশ করা যায় সেভাবেই বলি-
- আচ্ছা এটা কার গল্প? কে এই পাথরকুঁচি।
আশ্চর্য্য নির্লিপ্ততায় সে জবাব দেয়-
- এটা পাথরকুঁচির গল্প আর পাথরকুঁচি একজন দূর্ভাগা মেয়ে।
তার এই কথার পর আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না ব্যাথায় বুক ভেঙ্গে আসে আমার।
আমি তন্ন তন্ন করে ফেসবুক প্রফাইলে ওর আদার ইনফরমেশন বা ছবিগুলো খুঁজতে চেষ্টা করি। কিন্তু নীরেট দেওয়ালের মত সব কিছুই আড়াল থেকে যায় আমার সামনে। ওর ওয়ালে ওর লেখাগুলি ছাড়া কোনো ব্যাক্তিগত তথ্য নেই। সুনিপুন দক্ষতায় ঢেকে রেখেছে নিজেকে এই মেয়ে। পাথরকুঁচি মেয়েটা দেখতে ঠিক কেমন হতে পারে? এ ভাবনা আক্রান্ত করে আমাকে। আমি আমার কল্পনায় হাসিখুশি দু,বেনী ঝুলানো একটি ১৭/১৮ বছরের মেয়েকেই দেখি। যে হাসছে। ঘুড়ি উড়াচ্ছে একটা অল্প বয়সী ছেলের সাথে। কল্পনার প্রথম ভাগটায় পাথরকুঁচি বড় প্রানচ্ছল জীবন্ত এর পরেই আমি ওর মন মরা চেহারাটা দেখি যে মেয়েটা ঘুরে বেড়াচ্ছে একা একা হসপিটালের করিডোর দিয়ে। যার মুখের হাসি চিরতরে থেমে গেছে। নিভে গেছে এক চোখের আলো। মুখের একপাশে বয়ে চলে সে কোনো কদর্য্য কাপুরুষের স্মৃতি।
পাথরকুঁচি বেশ খানিকটা সময় চুপ থাকে। ওর লেখা প্রকাশ করে কিছুক্ষণ পর।
আমি ছাদের সিড়িঘরে সিড়ির উপর একা একা বসে থাকি। একরকম অদ্ভুত শীতলতা এই বন্ধ সিড়িঘরে। একধরনের বদ্ধ সোদা গন্ধও আছে এ সিড়িঘরটিতে। আমার নানাবাড়ির ছাদের সিড়িঘরটাও তালা দেওয়া থাকতো। সেখানেও ঠিক এমনি গন্ধ ছিলো। ধান সিদ্ধ করা ডোল রাখা থাকতো সেখানে। তার এক অন্যরকম গন্ধ। তপ্ত গনগনে ছাদের উপর যখন বৃ্ষ্টি পড়ে তখনও এক পোড়া পোড়া গন্ধ ওঠে। সে গন্ধটুকুও আমি চোখ বুজে মনে করতে চেষ্টা করি। আমি অতীতের মাঝে নিজেকে খুঁজতে থাকি। দ্বিতীয় জীবনে আমার কোনো আনন্দ নেই। সোনালী অতীতের সেই প্রথম জীবনের সুখস্মৃতিগুলিই আমার একমাত্র আনন্দের উপকরণ।
আমার খুব ইচ্ছে হয় আমার নিজের জীবনের সকল সুখের বিনিময়ে ওর জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দিতে। লেখাটা পড়ে আমি ওকে নক করি।
- পাথরকুঁচি আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।
আমাকে অবাক করে দিয়ে পাথরকুঁচি এক আশ্চর্য্য কথা বলে-
- আমি কারও বন্ধু হতে পারিনা।
আমি মোটেও দমে না গিয়ে বলি ওকে-
- আপনি পারেন না নাকি অন্য কারও যোগ্যতা নেই আপনার বন্ধু হবার।
পাথরকুঁচি নিরুত্তর থাকে। আমি একা একা লিখে চলি এর পর। বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কি, বন্ধুত্ব আসলেই কি? আমাদের জীবনে বন্ধু চিনতে ভুল বার বারই হতে পারে তাই বলে একজন প্রকৃত বন্ধুই হতে পারে একে অন্যের অনুপ্রেরণা।
পাথরকুঁচি হু হা করে যায়। বুঝি যে খারাপ অভিজ্ঞতার কালো ছায়া ওকে গ্রাস করেছে তা থেকে সহজে ওকে বের করে আনা সম্ভব না। তবুও নিজেই প্রতিজ্ঞা করি আমি আমার শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও আমার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। এই মেয়েটিকে খুশি করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন করতে রাজী আছি আমি।
পাথরকুঁচি এবং অতঃপর.....১০ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৬