১
“আমি পাথরকুঁচির গল্পটা লিখবো। তার দ্বিতীয় জীবনের গল্প। লেখাটা লিখবো আমি খুব ধীরে, সময় নিয়ে। তড়িঘড়ি করতে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে । প্রথম জীবনের স্মৃতিটা আমাকে কাঁদাবে। চোখে ঝরবে অবিরল ধারায় অশ্রু। আমার এই একটা মাত্র জীবিত চোখ এত ধকল সইতে পারবেনা। যদি কেউ কখনও আমার এই লেখাটা পড়ে। মানে খুব হেলাফেলায় বা খুব মন দিয়ে। তবে এ জায়গাটিতে এসে সে যত বড় অমনোযোগী পাঠক হোক না কেনো ঠিক ঠিক বুঝে যাবে এ গল্পের নায়িকা এবং লেখিকা একই ব্যাক্তি। আর সেটা আমি। হ্যাঁ এটা আমার গল্প এবং আমিই সেটা লিখতে চাই।“
ঠিক এ জায়গাটায় এসে নড়ে চড়ে বসি আমি। আজ কদিন ধরে কিছু একটা লিখছে মেয়েটা এই গল্প কবিতার অনলাইন পেইজটিতে। প্রথমে শুরুটায় খুব সাদামাটা সাধারণ কোনো কাহিনী মনে হওয়ায় ততটা মন দিয়ে পড়িনি কিন্তু আজ একটু খটকা লাগলো। মনে মনে ঠিক করলাম একে ফলোতে রাখতে হবে। আসলেই কি বলতে চায় সে? ভাবনা রেখে আবার পড়তে শুরু করি-
“যদি কখনও কেউ আমার এ লেখা নাও পড়ে তবুও আমি নিজের জন্য লিখবো। নিজের জন্য আমাকে লিখতে হবে। ডক্টর প্যাট্রেসিয়া আমাকে বলেছেন আমার কাউন্সেলরের কথা শোনা উচিৎ আর আমার এই দ্বিতীয় জীবন নিয়ে সকল হতাশা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য কাউন্সেলর আমাকে সর্বদা যা কিছু উপদেশ দেন তার মধ্যে এই গল্প লেখার আইডিয়াও ছিলো।“
বাহ! সত্যি নাকি। মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করি হতাশা ঝেড়ে ফেলবার জন্য লেখার চাইতে বড় বন্ধু আসলেও আর কেই বা হতে পারে! একটি সুদীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মেয়েটা আরও কি লিখেছে সে ব্যপারে মনোযোগী হয়ে উঠি। ফিরে যাই তার লেখার শুরুতে। লেখাটা সে শুরু করেছিলো এভাবে-
“আমি একটি গল্প লিখছি। এ গল্পের নায়িকা চিরায়ত আর দশটা গল্প নাটকের নায়িকাদের মত আকর্ষনীয়া নয়। সাধারনত গল্প, নাটক বা সিনেমার নায়িকারা হয় ভীষন সুন্দরী, আভিজাত্যে উজ্জ্বল। অধিকাংশ সময়ই অভাব তাদেরকে স্পর্শ করে না। তারা থাকে আত্মপ্রত্যয়ী, বিলাসী দুনিয়ার যত সৌন্দর্য্য আছে তাই দিয়ে গড়া।“
সাবলীল বর্ণনায় ডুবে যাই তার লেখার মাঝে। মেয়েটা লিখেছে,
“এ গল্পের নায়িকার নাম দিলাম আমি পাথরকুঁচি। পাথরকুঁচি কখনও কারো নাম হয় বলে আমি শুনিনি। মনে হচ্ছে এটা খুব আনকমন নামই হবে। কিন্তু পাথরকুঁচির জীবনটাও তো বেশ আনকমন। আর তাছাড়া তার হৃদয় এখন পাথরের। শুধু তাই নয় নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা চোখের কোটরে খুব সুন্দর করে চিকিৎসকেরা বসিয়ে দিয়েছেন আর একটি পাথর চোখ। বাকী ভালো চোখটা দিয়ে সে দূরের ঝাঁউবন দেখে।“
চমকে উঠি আমি। মেয়েটা কি জন্মান্ধ নাকি কোনো কারণে চোখের আলো হারিয়েছে সে? কিন্তু সে যাইহোক, এ বেদনার অনুভুতি তো আমার জানা। হাজার প্রশ্ন ঘুরতে থাকে আমার চারিধারে। মনে পড়ে জীবনের দূর্বিসহ অন্ধকার দিনগুলোর কথা। দুঃসহ কষ্টের দুরহ দিন ও রজনীগুলি। দূর! দিন বলছি কেনো? অন্ধ মানুষের কাছে আসলে দিনরাতের প্রভেদ নেই। তাদের সামনে ২৪ ঘন্টাই তো রাতের আঁধার।
ভাবনা থেকে ফের ফিরে যাই লেখায়।
“পাথরকুঁচির হৃদয় এখন পাথর। মনটাও তার পাথর। আর ডঃ প্যাট্রেসিয়া তার অপর একটি মায়াকাড়া চোখের আদলে তাকে বানিয়ে দিয়েছেন একটি পাথরের চোখ। স্থির পাথর চোখে সে দূরে তাকিয়ে রয়। পেছনে ফেলে আসা সুখের স্মৃতিগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাঁথরকুচি আয়না দেখে না । দীর্ঘ সুচিকিৎসা ও সুশ্রুসার পরেও এখনও এক দলা মাংস কুচকে রয়েছে ওর মুখের এক পাশে। পাঁথরকুচি সহ্য করতে পারেনা সে বিভৎস্য দৃশ্য। নিজের উপরে ঘেন্না হয়।“
উফ! এক ঝটকায় বন্ধ করে ফেলি ল্যাপটপের ডালাটা আমি। আমার মাথার ভেতরে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হয়। মাথা চেপে ধরে বসে থাকি কতটা সময় জানা নেই। মাথার ভেতর একটাই প্রশ্ন ঘুরতে থাকে কে এই মেয়ে? কি তার পরিচয়? এ কি সত্য ঘটনা লিখছে নাকি নিছকই কাল্পনিক বানোয়াট সবকিছু? মনেপ্রানে বিশ্বাস করতে চাইনা এ কারো জীবনের সত্য ঘটনা হোক তবু আমি নিশ্চিৎরুপেই জানি এই অনুভুতির নাম কখনও মিথ্যে হতে পারে না।
এই মেয়ে এসিড সন্ত্রাসের শিকার এ কথা বুঝতে আর আমার সময় লাগেনা.....
২
আমি রোজ রোজ অপেক্ষা করে থাকি এরপর। যত কিছুই ঘটুক আর পৃথিবী উলটে যাক আমি পাথরকুঁচির লেখা পড়বার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি। সেদিন কি হলো, সকাল থেকে মানে ঘুম ভাঙ্গবার পর থেকেই আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হচ্ছিলো। পুরো শরীরের ইনএ্যাকটিভিটি, মাথা ব্যাথার সাথে পুরো শরীর ব্যাথায় কুঁকড়ে আসছিলো। তবুও ডক্টরের নির্দেশে পেইনকিলার খেতে রাজী হচ্ছিলাম না আমি। ডক্টর সেন খুব অবাক হয়ে জিগাসা করলেন এত ব্যাথা নিয়েও কেনো আমি মেডিসিন খেতে চাচ্ছিনা, আমার এত অবুঝ হবার কারণ কি? আমি সেই সিলি কারনটা বলিনি তাকে কারণ আমি পেইন কিলার খেয়ে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়তে চাইনা। আমি পাথরকুঁচির লেখাটা গল্প পেইজে পাবলিশ হওয়া মাত্র পড়তে চাই। কোনোভাবেই মিস করতে চাইনা তার লেখা আমি। সর্বপ্রথম পাঠকটি আমিই হতে চাই।
আসলে দূরদেশে আত্মীয় পরিজনহীন এই হসপিটাল জীবনটা ক্রমে দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে আমার কাছে। এ দীর্ঘ চিকিৎসার শেষ কবে হবে জানা নেই আমার। এ বন্দী জীবন আমার আর ভালো লাগছে না। বেঁচে থেকেও সকল স্বপ্ন ফুরিয়ে যাবার এ দুঃসহ ক্ষন কাটাতে হবে আমাকে আগে কখনও ভাবিনি আমি। বাইরের গতীময় পৃথিবী আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। নিজেকে বড় অপাংক্তেয় মনে হয় মাঝে মাঝে। দৃঢ় মনোবল থাকা সত্বেও কখনও কখনও ভেঙ্গে পড়ি আমি। পাথরকুঁচি তার লেখায় ঠিকই বলেছে। এ অবাক করা ধরিত্রীতে কখন কোথা থেকে যে ধস নেমে আসে মানুষের জীবনরেখায়, শুরু হয় এক স্বপ্নহীন আশাহীন কালের পরিক্রমা তা তো কারো জানা হয় না তার এক মুহুর্ত আগেও। মেয়েটার জন্য আমার খুব মায়া হতে থাকে। আমি ওর জীবনটা ঠিক কেমন তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি।
দুপুরের দিকে ওর লেখা আসে।
"আজকাল আমার একা থাকতেই ভালো লাগে। কারো সামনে যেতে ইচ্ছে করেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় এর চাইতে মৃত্যুই ভালো ছিলো। এই বিভৎস্য জীবন আমি চাইনা। মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার। কয়েকবার আত্মহত্যার প্ল্যানও করেছিলাম। প্রতিবারই বিফল হয়েছি। আসলে প্রথমবার ফ্যানের সাথে ওড়না ঝুলিয়ে মৃত্যুচেষ্টাটা বোকার মত হয়ে গেলো। কাউন্সেলরের নির্দেশে ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়া আমার হাতের নাগালের সব দড়ি রজ্জু গায়েব করে দিয়েছেন। আমি বসে বসে নীলনক্সা কষি। আমার মৃত্যুর নীলনক্সা। আসলে মৃত্যু বলছি কেনো? সেই আমার মুক্তি। এ দুঃসহ দূর্বিসহ জীবন থেকে সেই কি মুক্তি নয়? "
নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে আমার। না মেয়ে সে তোমার মুক্তি নয়। এমন করে ভাবছো কেনো তুমি? আমি এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠি। কাল্পনিক পাথরকুঁচির সাথে কথপোকথনের খেলা। তাকে আমি শুনাই আমার জীবনের গল্প। কি করে এক নিমিশে আমার জীবনের উপরে বয়ে যাওয়া ঝড়ে আমি আমার দুটি পা হারিয়েছি।মাথার ভেতর বসানো আছে ছোট এক টুকরো চিপস রোবোটদের মত। প্রতি ৪/৫ মাস পর পর আমার মস্তিস্কের অপারেশন করতে হয়। এত কিছু প্রতিকুলতায় যদি বাঁচতে পারি আমি, তুমি কেনো শুধু সামান্য চেহারার পরিবর্তনে এত ভেঙ্গে পড়বে?
কল্পনায় আমি পাথরকুঁচিকে নিয়ে বিকালের চা খাই। কখনও পার্কে বেড়াতে যাই। ওকে বুঝাই যত রকমভাবে বুঝানো সম্ভব ততটাই। আমি নিজের অজান্তেই কাল্পনিক এই খেলায় এডিক্টেড হয়ে পড়ি। আমি মন প্রাণ দিয়ে নিজের দুঃখ ভুলে গিয়ে এই দুঃখী মেয়েটার সকল দুঃখ কষ্ট বেদনা মুছে দিতে অস্থির হয়ে উঠি। একদিন সাহস করে কমেন্ট দিলাম ওর লেখায়। প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টা পরে সে আমার কমেন্টের জবাব দিলো।
তার জবাবটা পেয়ে এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মনে ভরে গেলো আমার। মনে হলো ওর সাথে আমার আত্মার কানেকশন বা টেলিপ্যাথীর সুচনা হলো। এক অজানা ভালো লাগায় মন ভরে উঠলো আমার। আমি সারাদিন খুব প্রফুল্ল থাকলাম। এ অনুভুতির কোনো নাম জানা নেই আমার তবে আমার এই প্রায় দু বছরকালীন হাসপাতাল জীবনে এত আনন্দের দিন বুঝি আর আসেনি এমনটাই মনে হচ্ছিলো আমার। সেদিন আমাকে যখন হুইল চেয়ার করে হাসপাতালের বাগানে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলো একজন কম বয়সী নার্স, আমার মনে হলো পাথরকুঁচিই বুঝি এসেছে আমার কাছে। আমি মনে মনে ওর সাথে কথা বলতে থাকি। আমার বিড়বিড় করে বলা কথার রেশ ধরে নার্স যখন বলে ওঠে, স্যার পাথরকুঁচি গাছ কি আপনার খুব পছন্দের? আমার হোস্টেলের বারান্দার টবে প্রচুর আছে। আমি কাল আপনার জন্য এনে দেবো একটা। আমি সম্বিৎ ফিরে চুপ হয়ে থাকি। বলতে পারিনা ওকে এ পাথরকুঁচি কোনো গাছ নয়, সে রক্তমাংসের মানুষ। এই বিশাল যজ্ঞের যজ্ঞময় জগতের কোনে পড়ে থাকা আমারই মত কোনো অপাংক্তেয় কেউ। এক অর্থে তাকে গাছও বলা যেতে পারে। প্রাণ আছে তবে চলৎশক্তিবিহীন। পৃথিবীর এ বিশাল কর্মযজ্ঞে ঠায় নেই তার।
আমার ওকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে। একদিন লাজ লজ্জার মাথা খেয়েই হয়তো দেখতে চাইবো ওকে। প্রার্থনা করবো ওর বন্ধুত্বের। কিন্তু সে কি রাজী হবে?
চলবে...
পাথরকুঁচির আগের পর্বগুলি
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৩