প্রচন্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো পুরো ল্যাবরুমটি। আশেপাশের রুমগুলো থেকেও ছুটে বেরুলো সবাই। নবীন এবং তরুণ বিজ্ঞানী অসাধারণ মেধাবী ডক্টর পিয়াল রহমান অচেতন পড়ে আছেন ল্যাবের মেঝেতে। হৈ চৈ, এ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, চিৎকার, চেঁচামেচি কয়েক মুহুর্তের মাঝে ঘটে গেলো কয়েক শতাব্দীর পরিবর্তন।
বোস্টন ইউনিভারসিটি হতে কেমিস্ট্রীতে পি এইচ ডি করে গত বছরের শেষদিকে এ গবেষনাগারে সায়েন্টিস্ট হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন পিয়াল। চুপচাপ, শান্ত এবং কর্মপাগল এ ছেলেটির দিনরাতের কাজ ছিলো নতুন কিছু আবিষ্কারের। ছোট থেকেই সবাই তাকে বলতো পিয়াল একদিন বড় হয়ে কিছু একটা হবে, দেশ ও দশের মাঝে একজন। হয়েওছিলো তাই। এসএসসি, এইচএসসি হতে শুরু করে পিএইচডিতে তার অসাধারণ মেধার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিলো। তবুও দেশকে ভালোবাসতো বলেই দেশের বাইরে লোভনীয় সব চাকুরীর অফার ফিরিয়ে দিয়ে ফিরে এসেছিলো দেশে। দিনরাত তার অভীষ্ঠে পৌছাবার লক্ষ্যে ল্যাবে পড়ে থাকতো সে। এত কাজ পাগল ছেলে, নাওয়া খাওয়াও ভুলেছিলো যেন। পিয়ালের মারাত্মক দূর্ঘটনায় থমকে যায় তার পুরো পরিবার, সহকর্মীবৃন্দ।
আর লিমা?
লিমা যখন পিয়ালের দূর্ঘটনার কথা শোনে তখন সে সুদূর সিডনীতে। ক্লাস শেষে কেবলই বাসায় ফিরে কাপড় ছেড়েছে, এমন সময় বাংলাদেশ থেকে ছোটবোন সীমার ফোন। ফোনে সীমার কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে "হেলো" শুনেই চমকে ওঠে লিমা। দারুণ উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় জানতে চায় বাবা কেমন আছেন, মা ভালো আছেন কিনা। ছোটভাই এর কথা জিগাসা করবার আগেই সীমা বলে ওঠে," আপু পিয়ালভায়ের অবস্থা খুব খারাপ। পিয়ালভাই বাঁচবেন না আপু।" কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সীমা। লিমা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা। বার বার চিৎকার করে জানতে চায় কি হয়েছে পিয়ালের। কিন্তু সীমা কান্নার দমকে কি বলে কিছুই বুঝতে পারেনা সে।
সারারাত নির্ঘুম কাঁটে। এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে্ করে পিয়ালের পাশটিতে। যেখানে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে তার পিয়াল। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। তার জীবনের পরম প্রিয় একজন মানুষ। তার ভালোবাসার মানুষ। সাধারণত বিজ্ঞানমনস্ক বা সায়েন্টিস্ট টাইপ মানুষেরা নাকি রোমান্টিক হয় না, এমনি শুনেছিলো লীমা। অথচ পিয়ালের এক একটি কবিতা পড়ে অবাক হয়ে যেত সে। সৃষ্টিকর্তা কি যাকে দেয় তাকে সবকিছু উজাড় করেই দেয়! পড়াশুনা, লেখালিখি, খেলাধুলা সাথে অসাধারণ গান ও আবৃত্তির গলার অধিকারি পিয়াল যেন তার কাছে সাক্ষাৎ স্বপ্নে দেখা এক রাজকুমার। আর সেই পিয়াল এত বড় দূর্ঘটনায় আজ পড়ে আছে হাসপাতালের বেডে। এত ভালোবাসে যাকে তার পাশেও থাকতে পারলোনা সে তার দুঃসময়ে। দম বন্ধ হয়ে আসে তার। পিয়ালের মুখটা চোখের সামনে ভাসে। কতই না কষ্ট হচ্ছে ওর পিয়ালের!
পরদিনই দেশে ফিরে যাবার সব যোগাড় যন্তরে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই জানতে পায় পিয়ালকে বোস্টনেই নিয়ে যাওয়া হবে সুচিকিৎসার জন্য। দেশে থাকলে নাকি তাকে বাঁচানো যাবেনা। স্থবির বসে থাকে লীমা। কোনো কাজেই মন বসাতে পারেনা। মনে পড়ে পিয়ালের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা। স্কুল জীবন থেকে তারা তিন হরিহর আত্মা লীমা,বেদৌরা আর মার্জিয়া। তারা তিন বন্ধু। সেদিন ওরা গিয়েছিলো মার্জিয়াদের বাড়ি। মার্জিয়ার ভাই এর ছেলের বার্থডে ছিলো সেদিন। সে অনুষ্ঠানেই পরিচয় হয়েছিলো পিয়ালের সাথে ওর। পিয়াল তখন বোস্টন ইউনিভার্সিটি এর ছাত্র আর লীমারা কেবলি এইচএসসি দিয়েছে। কি এক ছুটিতে দেশে এসেছিলো সেবার পিয়াল। খুব গর্ব করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো মার্জিয়া সেদিন তার এই অসম্ভব ট্যালেন্ট এই কাজিন ভাইটির সাথে। একটু অহংকারী কিন্তু গভীর চোখে যে কি যাদু ছিলো তার। লীমা প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গেলো!
লীমার ভাবলে অবাক লাগে! বাড়ি ফিরে তার বুকের মধ্যে কি এক অস্থিরতা! আসলে পিয়ালের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর ওর অসাধারণ ব্যাক্তিত্বের বেড়াজালে আটকে পড়েছিলো লীমা। লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট কিনা জানা নেই তবে পিয়ালকে দেখবার পর ওর মনের নদীতে যে উথাল পাথাল ঢেউ এর জোয়ার বয়ে গেলো, সে কথা ভাবলে আজও একটু লজ্জাই লাগে তার। তখনও লজ্জায় কাউকে বলতেও পারছিলোনা সে কথা। তবুও কি নির্লজ্জের মত পিয়ালের পিছু নিয়েছিলো সে। চুপিচুপি মার্জিয়ার ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে খুঁজে বের করে সে পিয়ালকে। পিয়ালের স্টাটাস ছবিতে, ওর লেখা কবিতায় নির্দ্বিধায় লাইক দিতে শুরু করে। নিসংঙ্কোচে অবলীলায় জানায় তার ভালোলাগার কথা। এভাবেই আউটবক্স থেকে ইনবক্স।
পিয়াল তাকে ইনবক্সে প্রথম যে কবিতাটি লিখেছিলো, খুঁজে খুঁজে কয়েক লাখ মেসেজ ঘেটে সে কবিতাটি বের করে লীমা আজ আবারও।
হৈমন্তী বিকেলের দীপাবলি সন্ধ্যা,
তারা ঝিলমিল রাত ছিলো নিভু নিভু...
দীপ হাতে সোজা স্বর্গের সিড়ি বেয়ে;
নেমে এলো এক অপ্সরী অপরূপা।
আমি অসহায়, নীল চোখ সুনয়না
অতল জলের গহীনে দিয়েছি ডুব,
মুগ্ধ হৃদয়, অপলক কথা বলে
ভাষাহীন চোখ নির্বাক নিশ্চুপ।
সর্বনাশের পেয়ালার বিষ পিয়ে
একাকী প্রহর কাটানোর বেলা শুরু
প্রতীক্ষা কাঁটে মায়াবিনী সারাবেলা
মায়া হরিণের ঘোর লাগা পথ চলা।
মায়া মায়া ঘোর ওগো স্বর্নালী মেয়ে
দেবে কি তোমার কোমল মুঠির হাত
রুক্ষ আমার শুস্ক তালুটি ছুয়ে
কাটুক তোমার মিঠে ভোর জাগা রাত।
লীমার চোখে অঝর বন্যা ঝরে। এত ভালোলাগার মানুষটি থেকে এভাবে কবিতার ভাষায় যখন আহ্বান এসেছিলো। লীমা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। তারপর কত কিছু। কত রাত, কত দিন। ঘন্টার পর ঘন্টা। লীমার সাথে পিয়ালের সম্পর্কের শুরু যখন, তখন পিয়াল দূরদেশে আর লীমা তখন বাংলাদেশে। মেসেঞ্জার, স্কাইপে ঘন্টার পর ঘন্টা। এরপর পিয়াল যখন বাংলাদেশে ফিরে এলো তখন লীমা বিদেশে উড়ে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে।
অনেক পরিকল্পনার পর ওদের প্রথম দেখার দিনটি ওরা ঠিক করেছিলো পিয়ালের জন্মদিনে। মানে পিয়াল যেবার পড়াশুনার পাট চুকিয়ে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে গিয়েছিলো, পরদিনই ছিলো ওর জন্মদিন। এতদিন পর দেশে ফিরেও পিয়াল সবার সব অনুরোধ উপেক্ষা করে লীমার সঙ্গেই সারাটাদিন কাটাবার প্ল্যান করেছিলো।
বলতে গেলে ঘুমই হয়নি সেদিন রাতে লীমার। রাত বারোটায় ফোনে ওকে উইশ করবার পর, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে চুপি চুপি পিয়ালের জন্য নিজে হাতে কেক বানাতে বসেছিলো। তারপর তার জন্য সবার অগোচরে কেনা পাঞ্জাবী, পারফিউম, কার্ড সেসব র্যাপ করা । কত জল্পনা কল্পনা। পিয়ালও নাছোড়বান্দা সারারাত ওকে একটু পর পর ফোন দিচ্ছিলো। পরদিন যখন সে পিয়ালের প্রিয় রঙের শাড়ি, বেগুনি টিপে নিজেকে সাজাতে বসলো তখন তার দুচোখ জুড়ে রাজ্যির ক্লান্তি। আয়নায় নিজেকে দেখে ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো ওর। পিয়াল তাকে পছন্দ করবে তো? প্রিয় মানুষটির সামনে সেইদিনে নিজেকে বিশ্বের সর্বশেষ্ঠ সুন্দরী সাজাতে সে কি আপ্রাণ চেষ্টা তার!
পরে তার এ গল্প শুনে অনেক হেসেছে পিয়াল। তবে সব শুনে সে বলেছিলো যে, লীমা ভালোবাসার মানুষদেরকে বাহ্যিক সৌন্দর্য্যে বিচার করা যায়না। ভালোবাসার সৌন্দর্য্যই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য্য। আর লীমার পাগল করা ভালোবাসা সে কি আর বোঝে না পিয়াল? তাই পিয়ালের চোখে লীমা এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী। পিয়ালের ভালোবাসা বেশ অদ্ভুত। সে নিজেই কত ছেলেমানুষি করে আবার মাঝে মাঝে লীমার সাথে এমন ভাব দেখায় যেন লীমা একটা দুবছরের শিশু। যেন পৃথিবীর ভালো মন্দ কোনো জ্ঞানই নেই তার। তার এই ছেলেমানুষী কিংবা বড়োমানুষী, আদর, সোহাগ, রাগ শাসন সবই ভালোবাসে লীমা। আসলে পিয়ালের সব রকমের অনুভুতি এবং ওর সর্বাঙ্গিন কথা বলা, হাঁটা, চলা সবই লীমার প্রিয় । আর এত বেশি প্রিয় যে সেসব ছাড়া পুরো পৃথিবীর কিছুই আর এখন ভাবতে পারেনা সে।
পিজ্জা ইন এর কর্নারের একটি টেবিলে সেদিন ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো পিয়াল। এ্যাশ কালার শার্ট পরা পিয়ালকে সেদিন ওর দ্বিতীয়বার দেখা। তবুও এক সেকেন্ডে তাকে চিনে নিতে ভুল হয়নি লীমার। কারন মার্জিয়ার ভাই এর ছেলের বার্থডেতে তাকে প্রথম এই চর্মচক্ষুতে দেখা হলেও রোজ রোজ স্কাইপের ক্যামেরায় ওকে দেখে দেখে ওর মুখের প্রতিটি রেখা হতে শুরু করে রোমকূপ পর্যন্ত ছিল ওর চেনা।
এক গাঁদা উপহার হাতে যখন ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো লীমা । পিয়ালের মুখে তখন মিটিমিটি হাসি। লীমার হঠাৎ এত লজ্জা লাগছিলো। লজ্জায় ওর লালবর্ণ ধারণ করা চেহারা দেখা পিয়াল বললো, ফোনে আর চ্যাটে তো খুব গলাবাজি করতে দেখি, এখন এমন বোবা কেনো? ওর সামনে কেক আর উপহারের প্যাকেটগুলো রাখলো লীমা। কোনো কথা বলতে পারছিলো না সে। নির্বাক মুখেই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো কেকটা পিয়ালকে দিয়ে কাঁটাবে বলে। কিন্তু পিয়াল সেসব কিছু বাদ দিয়ে ওর দুহাত চেপে ধরে আবৃত্তি শুরু করলো-
মায়া মায়া ঘোর ওগো স্বর্নালী মেয়ে
দেবে কি তোমার কোমল মুঠির হাত
রুক্ষ আমার শুস্ক তালুটি ছুয়ে
কাটুক তোমার মিঠে ভোর জাগা রাত।
কবিতা আবৃতির সাথে সাথে লীমা খেয়াল করলো। পিয়ালের হাত মোটেও রুক্ষ, শুস্ক নয়। সে সব লজ্জা ভুলে জিগাসা করে উঠলো, - এ্যই তোমার হাত তো শুস্ক, রুক্ষ না। কেনো এসব লিখেছিলে! এ কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিলো পিয়াল। বালিশ ভিজে যায়। অসহ্য যন্ত্রনায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। লীমা অস্ফুটে নিজের মনেই বলে, পিয়াল তোমার কাছে যাবো।আমাকে পিয়ালের কাছে যেতেই হবে।
কখন ভোর হয়েছে জানেনা লীমা। সারারাত নির্ঘুম কাঁটে তার। ভোরের দিকে কখন যেন একটু তন্দ্রার ঘোর লেগে আসে। স্বপ্ন দেখে পিয়াল ওর মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, ডাকছে ওকে। ধড়ফড় করে উঠে বসে লীমা। দেখে ওর এ্যালার্ম বাঁজছে। এ্যালার্মে পিয়ালের কন্ঠে অনবরত বেঁজে চলেছে, আই লাভ ইউ লীমা, আই লাভ ইউ লীমা। গতবছর শেষবার যখন লীমার সাথে পিয়ালের দেখা হয়েছিলো। পিয়াল ওর কন্ঠে দুষ্টুমী করে ওকে এই এ্যালার্ম সেট করে দিয়েছিলো। পিয়ালের কন্ঠ এ্যালার্মে অনবরত ভেসেই চলেছে, আই লাভ ইউ লীমা। আই লাভ ইউ লীমা। সারারাত অঝর ক্রন্দনে শক্তি নিঃশ্বষ হয়ে আসছিলো প্রায় ওর তবুও ও অস্ফুটে বলে , আই লাভ ইউ পিয়াল। পিয়াল তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
দিনের পর দিন কাটে। কত নির্ঘুম রাত আসে। ভোর হয়। কিন্তু পিয়ালের সাথে দেখা হয় না লীমার। গবেষনাগারের সেই কেমিক্যাল টিউব বিস্ফোরনে পিয়ালের মারাত্মক দূর্ঘটনার দূরহ চিকিৎসায় কেটে যায় বছরের পর বছর। লীমা দেশে ফিরে এসেছে সিডনীতে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে। দেশে ফিরে দুজনের বিয়ে করবার কথা ছিলো। ওদের দুজনের ইচ্ছে ছিলো কোনো অনুষ্ঠান, লৌকিকতা নয়, ওরা নিজেরাই বিয়ে করবে কোর্টে গিয়ে এবং তারপর সারাটাদিন ঘুরে বেড়াবে সারা শহর। ওদের বিয়ের দিনটি হবে আর দশজনের বিয়ের দিনের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। ইচ্ছা স্বাধীন দিন। ওরা বিয়েতে বিরিয়ানী, পোলাও খাবেনা। খাবে ফুচকা, চটপটি, বাদাম, খিরি কাবাব। কিন্তু তা আর হয়না। কত জল্পনা, কল্পনা আর আজগুবী কথায় কেটে যাওয়া স্কাইপ চ্যাট, ফোনালাপ বাজে কানে, চোখে ভাসে পিয়ালের মুখ।
মনে পড়ে সেবার যাবার সময় কতবার ওকে শুধু একটাবার একটা চুমুর জন্য রিকোয়েস্ট করেছিলো পিয়াল। কিন্তু শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও লজ্জায় কিছুতেই পারেনি লীমা। এই মর্ডাণ যুগের মেয়ে হয়েও কিভাবে কোথা থেকে যে লীমার এত লজ্জা এলো লীমা নিজেই খুঁজে পায়না। পিয়াল দুষ্টুমী করে বলেছিলো ওকে, এইবার বিদেশে গিয়ে সব বিদেশিনীদের চুমু নিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড করে দেখাবে তাকে। লীমা সে কথা সত্যি ভেবে খুব রাগ করে বলেছিলো, "খবরদার, তাহলে খুন করে ফেলবো তোমাকে।" তারপর ........ কত স্মৃতি মনে পড়ে...
লীমা বাড়িতে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সে কোনো ভাবেই বিয়ে করবেনা। এরই মাঝে কেঁটে গেলো প্রায় সাড়ে চার বছর। পিয়াল সুস্থ্য হয়ে আজও ফিরলোনা। তবে শেষ পর্যন্ত লীমার প্রার্থনা বুঝি সফল হয়। লীমা মার্জিয়ার কাছে জানতে পারে চিকিৎসা শেষে পিয়াল ফিরে আসছে দেশে। দেশে ফিরলেও আপাতত এসিড সারভাইবরস সেন্টারে থাকতে হবে তাকে। এই অবস্থায় বাড়িতে নার্সিং তার জন্য ঠিক হবেনা।
তবুও লীমার আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে। কতগুলো দিন পর পিয়ালের সাথে দেখা হবে তার। সৃষ্টিকর্তার অশেষ করুনায় শেষ পর্যন্ত কিছুটা তো সুস্থ্য হয়েছে পিয়াল। নিশ্চয় বাকীটাও সেরে উঠবে শিঘ্রী। নানা রকম জল্পনা কল্পনায় কাঁটতে থাকে তার দিন।অবশেষে এলো সেই প্রতীক্ষিত ক্ষন। মার্জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে অনেক কষ্টে একাকী কিছুক্ষন পিয়ালের সাথে দেখা করবার অনুমতি মিললো ওর।
কেবিনের বেডে শুয়ে ছিলো পিয়াল। লীমা কেবিনে ঢুকে চিনতেই পারলোনা ওকে। এই সাড়ে চার বছরে যেন পিয়ালের বয়স বেড়ে গেছে ২০ বছর। ওকে দেখাচ্ছে একজন বুড়ো মানুষের মত। জবুথবু শরীর। চুলহীন মাথা। সারামুখ ক্ষত বিক্ষত। কিন্তু আশ্চর্য্য সুন্দর সেই শান্ত শীতল দিঘীর মত চোখ। পিয়াল স্থির তাকিয়ে ছিলো লীমার দিকে। এতগুলো দিন পরেও লীমাকে দেখে কোনো আনন্দের ঢেউ জাগলোনা ওর ভাবলেশহীন মুখে । লীমা ডুকরে উঠলো।
ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে। চুমোতে চুমোতে ভরিয়ে দিলো ওর মুখ। বললো, "পিয়াল তোমার একি হলো? কি অপরাধ করেছিলাম আমরা বিধাতার কাছে? কোন দোষে তিনি কেড়ে নিলেন আমাদের স্বপ্নটুকু?" কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো লীমা। পিয়ালের কোনো ভাবান্তর নেই। সে কিছুক্ষন লীমাকে কান্নার সুযোগ দিলো। তারপর ধরে পাশে বসালো ওকে। দুহাতে মুছে দিলো ওর চোখ। লীমা তখনও ফোপাচ্ছিলো। লীমা বললো, "পিয়াল তোমাকে ভালোবাসি। আর কোথাও যেতে দেবোনা আমি তোমাকে। কোথাও যাবেনা তুমি আর আমাকে ছেড়ে। তোমার সকল দায়িত্ব আমার। যতদিন বেঁচে থাকবো এক মুহুর্তের জন্যও আর চোখের আড়াল করতে চাইনা তোমাকে আমি। সারাটা জীবন তোমার পাশে থাকতে চাই পিয়াল।"
পিয়ালের ঠোঁটে ফের ফুটে উঠলো সেই ভাবলেশহীন হাসি। চমকে উঠলো লীমা। তবে কি পিয়াল ওকে আর ভালোবাসে না? পিয়াল খুব শান্তভাবে বললো, "স্থির হয়ে বসো লীমা। বল,কেমন আছো তুমি?" লীমা কোনো উত্তর দিতে পারে না। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বলতে পারেনা তাকে ছাড়া সে একটুও ভালো নেই। সে খুব খারাপ আছে। ভীষন খারাপ। পিয়াল আবার বলে, "তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই লীমা। মন দিয়ে শুনবে। তোমার সঙ্গে থাকা বা তোমাকে বিয়ে করা কোনোটাই আর সম্ভব না আমার।" অবাক হয়ে জানতো চাইলো লীমা, "কেনো?" পিয়াল বলে, " দূর্ঘটনা আমার জীবনের সব কেড়ে নিয়েছে। আমার শাররিক, মানষিক, সামাজিক জীবন হতে শুরু করে আমার প্রেম, ভালোবাসা, অভিমান বা দুঃখ-বেদনা সবকিছুই।" লীমা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। তাই দেখে পিয়াল বলে, "লীমা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তাই তোমার থেকে চলে যেতে চাই। অনেক দূরে" লীমা আছড়ে পড়লো ওর বুকে। না কোনো কথাই শুনতে চায় না সে। জীবনের বিনিময়ে হলেও ওর পিয়ালকেই চাই। ওর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো লীমা। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছিলো। পিঠ ভর্তি ছড়িয়ে পড়া দীঘল কালো চুলে হাত বুলোয় পিয়াল। সে তার দৃঢ় সিদ্ধান্তে অবিচল।
পিয়াল বলে চলে, "আমি মাথা নত করতে শিখিনি লীমা। আজ আবেগের ঘোরে যে ভালোবাসাকে আজীবন রক্ষা করবে ভাবছো একদিন সে ভালোবাসাকেই বোঝা মনে হবে তোমার। আমি কারো করুণার পাত্র হতে চাইনা।" "পিয়াল! "লীমা চিৎকার করে ওঠে! "এ কথা তুমি বলতে পারলে? তোমার জন্য এতগুলো বছর কি আমি অপেক্ষা করে নেই? আমি কি তোমার জন্য অপেক্ষা করিনি পিয়াল? কি করে বললে তুমি আমি তোমাকে করুনা করবো! ভালোবাসাহীন করুনা! করুণা, আবেগ এসব কি বলছো তুমি!"
পিয়াল বললো, "আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো লীমা। এই কুৎসিত কদাকার মুখ। এই মুখটিকে কি তুমি ভালোবেসেছিলে? এই ভঙ্গুর দেহ। একে তুমি ভালোবাসোনি লীমা।" কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে লীমা, "পিয়াল তুমিই একদিন বলেছিলে, ভালোবাসার মানুষদেরকে বাহ্যিক সৌন্দর্য্যে বিচার করা যায়না। ভালোবাসার সৌন্দর্য্যই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য্য। তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি সে কথা কি আজও বুঝতে পারোনি তুমি?" কান্না থামতেই চায়না লীমার। যে কোনো মূল্যে সে বাকী জীবনটা কাঁটাতে চায় পিয়ালের সাথে।
কিন্তু পিয়াল অনড়, অটল অবিচল থাকে তার সিদ্ধান্তে। ভিজিটরস টাইম শেষ হয়। ডিউটি ডক্টরস চেক আপ এর সময় আসে। লীমাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় পিয়ালের দরজা তার মুখের সামনে। পিয়াল কিছুই বলেনা। লীমা খুব অবাক হয় পিয়ালের এ নিষ্ঠুরতায়।
এরপর লীমার কি হয়, পিয়াল জানেনা আর। জানতেও চায়না। সে নিজেকে আড়াল করে নেয় লীমার থেকে অনেক দূরে। লোক চক্ষুর আড়ালে, নিভৃত অন্তরালে। একাকী স্বেচ্ছা নির্বাসনে সাগরের কাছাকাছি নির্জনতায় বেঁছে নেয় তার বাকী জীবনের দিনগুলো। পিয়ালের সেই ছোট্ট বাংলো কটেজের জানালা দিয়ে সাগর দেখা যায়। সাগরে আছড়ে পড়ে ঢেউ। সে দৃশ্যে প্রায়ই মনে পড়ে তার লীমার সাথে দেখা হবার শেষ দিনটির কথা। সেদিনও এমনিভাবেই তার বুকে আছড়ে পড়েছিলো লীমা। চোখ ভিজে ওঠে তার। লীমা, তার অনেক ভালোবাসার ছোট্ট পাখিটি। শুধু তারই মুখের দিকে তাকিয়ে, তার জীবনকে নিষ্কন্টক করে দেবার জন্যই তার থেকে অনেক দূরে নিজের পরিবার পরিজনও ছেড়ে এই নিরুদ্দেশে নির্বাসন তার। লীমা সে কথা জানেনা।
লীমা আরও একটি কথা জানেনা, কখনও জানবেনা। লীমার সাথে দেখা করবার আগের দিনটিতে লীমার বাবা মা এসেছিলেন পিয়ালের সাথে দেখা করতে। লীমার স্নেহময়ী মা অনেক কাঁদছিলেন সেদিন। বাবা ছিলেন নির্বাক। অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন তারা তাদের প্রিয় কন্যার ভালোবাসার মানুষটির এই দূর্বিসহ জীবন দেখে। সবশেষে লীমার মা জানিয়েছিলেন তাকে, লীমার অবিচল সিদ্ধান্তের কথা। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে, শত বাঁধা বিপত্তি বা যে কোনো মূল্যে তাদের মেয়ে পিয়ালকেই চায় এবং যা তারা আর চান না।
পিয়ালের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে...
হৃদয় গলে যায়....
লীমার জলভরা চোখ, চোখে ভাসে..
আরও চোখে ভাসে শেষ মুহুর্তের কথা। লীমাকে যখন ওরা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। লীমা চিৎকার করে কাঁদছিলো। তখন পিয়াল স্থির শীতল চোখে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে। লীমার চোখে ছিলো গভীর বিষাদ, ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার বিশাল শূন্যতা। পিয়ালের জন্য লীমার বুকের মধ্যে যে গভীর ভালোবাসাটা ছিলো সেটা খুব প্রবলভাবে অনুভব করে আজো সে। কখনও সমুদ্রের ধারে বা তার এই নিভৃত আস্তানা ছেড়ে কোথাও বের হলে তাকে দেখে কেউ যখন শিউরে ওঠে, ভয় পায় বা ঘৃনায় মুখ সরিয়ে নেয় পিয়াল তখন লীমার কথা মনে করে। লীমা তাকে ঘৃনা করেনি, শিউরে ওঠেনি তাকে দেখে, এতটুকু ভয়ও পায়নি। প্রচন্ড লজ্জায় একদিন যে মুখ সে চুম্বন করতে পারেনি, প্রচন্ড ভালোবাসায়, নিস্পাপ পবিত্রতায় সেই ক্ষত বিক্ষত মুখেই সেদিন সে ঢেলে দিয়েছিলো হাজার হাজার চুমু। হৃদয় থেকে উঠে আসা সে সুগভীর, প্রবল ভালোবাসা সেদিন তার চোখে পিয়াল দেখেছিলো হাজার বছর সেই ভালবাসাটা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে সে। তার বুকের মধ্যে জ্বলজ্বল করবে লীমার ভালোবাসার স্মৃতিটুকু। পৃথিবীর সবাই তাকে ঘৃনা করলেও লীমা তাকে ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে। এ কথাটা ভেবেই বেঁচে থাকতে চায় পিয়াল।
এই পৃথিবীতে তার অনেক স্বপ্ন ছিলো। পৃথিবীকে অনেক কিছুই দেবারও ছিলো তার। কিছুই হলোনা। মানুষ তার নিয়তিকে হয়ত সত্যিই খন্ডাতে পারেনা। তবুও কারো উপরই তার নেই কোনো অভিমান, কারো কাছে নেই কোনো দাবী, দাওয়া, চাওয়া পাওয়া। এখন একমাত্র সঙ্গী তার কবিতার খাতাটি।
কোনো কোনো বিষাদী ভোরে,
ঘুম ভাঙ্গলেই মনে পড়ে যায় তোর মুখ;
কোনো কোনো সবুজ সন্ধ্যায়
চোখ বুজলেই, চোখে হাসিস তুই...
ওগো দীপজ্বালা মেয়ে,
আমার আপন গোপন আঁধার ফুড়ে,
জ্বালিয়ে গেলি তুই দ্বীপশিখা;
অনির্বান, উদ্দিপিত লেলিহান স্নিগ্ধ সে অনলে-
জ্বলি আমি অহর্নিশ...
মনে কি পড়ে তোর আমাকে?
মনে কি আছে সেই কথা?
একটি অভিমানী ছেলে-
উড়ে গেছে ডানা মেলে, দিগন্তে....
আকাশ যেখানে মেশে,
সাগরের লোনা জলে;
তোর সাথে কিছু সুর্যাস্তের স্মৃতি ছিলো যার-
সূর্য্যদয় আর হলো না,
তার দেখা, যুগল কোনো বন বিথীকায়....
তোর অভিমানী সেই ছেলেটির
নেই জানা
কার উপরে এই অভিমান তার?
শুধু জানে-
দ্বীপ নিভে গেছে,
দ্বীপজ্বলা মেয়েটির হাত হতে
খসে গেছে তারা,
চমকিত এক ঝড়ে...
দমকা হাওয়ার তোড়ে...
যদি কোনোদিন
কোনো এক স্বর্ণালী ভোরে
ঘুম ভেঙ্গে চেয়ে দেখি,
তুই দাঁড়িয়ে আমার পাশে...
এক পেয়ালা চা হাতে,
সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে;
একদম আগের মত পরিপাটি, ঝকঝকে,
আমাদের দুরন্ত স্বপ্নের কাছে হবে পরাজয়,
পরাজিত হবে নিয়তি....
আমি সেই দিনটির প্রতীক্ষায় থাকবো......
আমৃত্যু অথবা মৃত্যুর পরেও....
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৪৩