আমি আবিরের ফেসবুক প্রোফাইলের ছবিটা খুলে তাকিয়ে থাকি। ছবিতে চিরায়ত হাসোজ্জ্বল মুখের আবির। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও স্বপ্নমাখা চোখে সে তাকিয়ে আছে মনিটরে। কত কথা যে মনে পড়ে আমার। কতক্ষন যে তাকিয়ে থাকি ওর ছবিটার দিকে জানা নেই। এই সেই আবির। বাড়ির সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে নীরবে গড়ে ওঠা আমাদের ভালোবাসার গল্প। যা সারাটা জীবন লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যাবে। আমি ওর ছবিটাতে হাত বুলোই।
আমি কোনোদিন ওর মুখে হাত বুলোইনি। নিজে থেকে ওর হাতটাও কখনও ধরিনি পর্যন্ত। কোনোদিন আদরও করিনি ওকে। কৈশোরের গোপন ভালোবাসার স্বপ্নে যা যা থাকে বা সিনেমা নাটকে ভালোবাসার গল্পেরা যেমন হয় ঠিক তেমনি কত শত স্বপ্ন দেখেছি ওকে নিয়ে। কিন্তু কখনও সেসব মুখ ফুটে বলা হয়নি তাকে আমার। আমার স্বভাবজাত লজ্জা আমাকে আটকে দিয়েছে বারংবার। আবির নিজ থেকে আমার হাত না ধরলে বা অস্ট্রেলিয়া যাবার আগের শেষদিন আমাকে চুমু না খেলে কোনোদিন সেই স্মৃতিটুকুও থাকতোনা আমার। তখন আমি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম, শুধু তাই নয় একটু রাগও লেগেছিলো। ওকে ভেবেছিলাম কি বেহাইয়া ছেলে। আজ সেই স্মৃতিটুকুর জন্য আবিরের কাছে কৃতজ্ঞ আমি । আর আজ সে কথাটা ভেবে চোখ দিয়ে নিজের অজ্ঞাতেই পানি পড়তে থাকে আমার।
আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে অমলিন মধুর স্মৃতি আবির আমাকে দিয়ে গেছে, তাই নিয়েই জীবনের বাকী কটা দিন কাটিয়ে দেবো আমি। আমার এই অভিশপ্ত জীবনের কোনো ছায়াও যেন আবিরের স্বর্ণালী রঙ্গিন বা এই আলোকচ্ছটাময় বর্ণীল জীবনের কোথাও না পড়ে, সেই আমার চাওয়া। আমার বুকের মধ্যে গুমরে মরা বোবা কান্নারা ঝড় তোলে। মনিটরে আবির হাসিমুখেই দাঁড়িয়ে থাকে। আবিরের পিছে ক্রিস্টমাসের উৎসব মুখর আলো ঝলমল নগরী। সে দাঁড়িয়ে আছে সান্টা ক্লজ তুষারবুড়োর স্লেজটার সামনে। স্লেজটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাঙ্গারুরা। রেইনডিয়ারের বদলে ক্যাঙ্গারু? আমি আগে কখনও এমন দেখিনি। অস্ট্রেলিয়াতে কি তুষারবুড়োকে টেনে নিয়ে যায় ক্যাঙ্গারুরাই? তাই হবে হয়তো।
ক্যাঙ্গারুদের আমার খুব মজার লাগে। আমার মনে হয় বিধাতা ওদের মাতৃত্বকেই এই দুনিয়ার সকল মাতৃত্ব থেকে প্রাধন্য দিয়েছেন বেশি। আমার ক্যাঙ্গারু হতে ইচ্ছে করে। ক্যাঙ্গারু হলে আমি আমার পেটের থলির মধ্যে করে লুকিয়ে রুপকথাকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম কোথাও। যেখানে কেউ আমাদেরকে আর খুঁজে পেত না।
আমি বিছানায় অকাতরে ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে থাকা রুপকথার দিকে তাকাই। কিছুদিনের মধ্যেই আমার এই চির আঁধার কক্ষ আলো করে থাকা এই এ্যন্জেলটাকে হারাতে হবে আমার। হঠাৎ আমি হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকি। সৃষ্টিকর্তার কাছে চিৎকার করে জিগাসা করতে ইচ্ছে করে আমার, কেনো কেনো আমার সাথেই এমন হবে বার বার? কেনো আমার থেকে বার বার কেড়ে নেওয়া হবে আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে? এই মানব জীবন আমি চাইনা ।
তার থেকে আমি ক্যাঙ্গারু হবো অথবা কোনো ইতর প্রাণী যার মন নেই, হৃদয় নেই, নেই কোনো বোধ বুদ্ধি, ব্যাথা বেদনা। অথবা যার বোধহীন হৃদয়ে কারো জন্য মায়া দয়া কিচ্ছু জন্মায় না আমাকে তেমনি কিছু করে দেওয়া হোক। হিংস্র শ্বাপদ হতে ইচ্ছে করে আমার। চিৎকার করে বিধাতাকে বলতে ইচ্ছে করে আমাকে কেনো তুমি মানুষ জীবন দিলে?
অনেক রাতে আমি আমার টিনের তোরঙ্গটা খুলে বসি। ছোট্ট লাল ভেলভেটের ব্যাগটা থেকে বের করে আনি আবিরের দেওয়া আংটিটা। আবিরের চিঠিগুলো হাজার হাজার চুমুতে ভরিয়ে তুলি। আবিরের চিঠিগুলিই জীবন্ত আবির হয়ে যায় আমার কাছে। আমি ওর সব চিঠিগুলি বুকে চেপে ধরে ঘুমিয়ে পড়ি। রাতে আবার আমি আবিরকে স্বপ্নে দেখি। সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। আবির আমার সামনে বসে আছে ভিজিটরস রুমে। আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে আছি। আমি ওকে দেখাতে চাইনা আমার এই কলঙ্কিত মুখ। আবির আমার দুহাত ধরে আছে। তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে । লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার। আবির আমাকে নিয়ে যেতে চায় ওর কাছে। কিন্তু আমি তো কোথাও যাবোনা।
অনেকগুলো দিন পরে আবার হঠাৎ একদিন রুপকথা গভীররাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। আশে পাশে কাউকে খোঁজে সে। আমি ওকে এত বলি এই যে আমি। সোনামনি কি হয়েছে, আমাকে বলো? রুপকথা শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজে চলে। মনে হচ্ছিলো ও বাতাসের মাঝে কাউকে দেখতে পাচ্ছে। আমার শরীর ভার হয়ে আসে। একটা সন্দেহ উঁকি দেয় মনে। আচ্ছা রূপকথার মা বেঁচে আছেন তো? নাকি ....
আমি ঘরের মধ্যে কারো অশরীরি অস্তিত্ব অনুভব করি। আমি নিশ্চিৎভাবেই জেনে যাই। সে অশরিরী কেউ নয়, সে রূপকথার জন্মদাত্রী মা। আমি রূপকথাকে ছেড়ে যাবো জেনেই হয়তো উনি জানান দিতে এসেছেন আমাকে। আমার মনে হয় যদি সে কথা বলতে পারতো সে নিশ্চয় আমাকে অনুরোধ করতো তার প্রিয় সন্তানকে ছেড়ে না যাবার জন্য।
আমি রূপকথাকে বুকে চেপে ধরি। নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করি পৃথিবীর কোনো শক্তির সাধ্য নেই রূপকথাকে কেড়ে নেয় আমার বুক থেকে। কোনোভাবেই আর পরাজিত হবোনা আমি। আমি লড়বো আমার রুপকথার জন্য। তার জন্য যা কিছু করতে হয় তাই করবো আমি। আমি আর হারতে চাইনা । আমাকে পারতেই হবে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
নরওয়ের সেই লোভনীয় চাকুরীর অফার ফিরিয়ে দিয়েছি আমি। এ কারণে ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়া এবং আমার কাউন্সেলর যথেষ্ঠ বিরক্ত হয়েছেন আমার উপরে। আমার এই খামখেয়ালীপনাকে আমার স্বেচ্ছাচারিতা বা একগুয়েমী পাগলামী হিসাবেই দেখছেন তারা আজকাল। আমার পিছে এতগুলো দিন নষ্ট করা, কম্পিউটার কোর্স, ইংরেজী শিক্ষা সবকিছু পন্ডশ্রম হলো ভেবে দুকথা শুনিয়ছেনও তারা আমাকে। কিন্তু আমি অনড় অটল থেকেছি আমার সিদ্ধান্তে। রুপকথাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবোনা। জোর করা হলে আমার জীবন বিসর্জনের হুমকী দিয়েছি আমি। আর সত্যিই আমি সেটাই করবো। মনে মনে সে ঠিক করাই আছে আমার।
আমার দুঃস্বপ্নকে সত্যি করে একদিন সত্যিই আবির চলে এলো। ঠিক আমার স্বপ্নে দেখা একটা দিনের ছবির মত আমার মুখোমুখি বসলো সে। আমার দুহাত ধরে আমাকে বললো, আমাকে সে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাবে, উন্নত চিকিৎসা বা প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবই করতে রাজী সে আমার জন্য। আবির ঠিক আমার স্বপ্নে দেখা ছবিটার মত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসেছিলো সেদিন। শুধু আমি লজ্জায় মরে যাইনি। আমি ঋজু ভঙ্গিতে দৃঢ়তার সাথেই সোজাসুজি তাকিয়ে ছিলাম ওর চোখের দিকে। আমি বলেছি, আমি তার সাথে যেতে চাইনা। আমার কারণে আমার প্রিয় মানুষগুলো এতটুকু দূর্ভোগ পোহাক সে চাইনা আমি। আমি ভালো আছি। আমার মত করে। সেও যেন ভালো থাকে। অনেক ভালো থাকে যেন সে।
আবির খুব মন খারাপ করে চলে গেছে। যাবার সময় বলেছে সে আমাকে আজও ভালোবাসে। একই রকম ও একইভাবে সারাজীবন আমাকে ভালোবাসবে সে এবং সারাটাজীবনই এই ভালোবাসা অটুট থাকবে তার। আমি জানি আবির এখন যা বলছে তার মাঝে কোনো মিথ্যে নেই। কিন্তু আমি চাইনা আমার কারণে আবির কারও হাসির পাত্র হোক। কারও করুণার জন্ম হোক ওর জন্য এই আমার কারণেই। আমি আবিরকে ফিরিয়ে দিয়েছি এ কষ্ট আমারও কম নয়। তবুও আমার তাকে ফিরিয়ে দিতেই হলো।
শেষ পর্যন্ত আমার জয় হয়েছে। আমি হারতে হারতেও জিতে গেছি শেষমেশ। আমাদের এই এনজিও এর সদর দপ্তর থেকে রুপকথাকে যে চাইল্ড হোমে পাঠানো হবে আমাকে সেখানেই ইংরেজী শিক্ষার টিচার হিসাবে চাকুরী দেওয়া হয়েছে। রুপকথার অভিভাবকত্বও দেওয়া হয়েছে আমাকে। রিতীমত হাতে কলমে পাকাপাকি দলিল। রুপকথাকে কেউ আর ছিনিয়ে নিতে পারবেনা আমার থেকে।
রুপকথার জন্যই বাঁচতে হবে আমাকে অনেক অনেকদিন।
************************************************
একটা সময় আমি আমার আনন্দময় উচ্ছল জীবন থেকে ছিটকে পড়েছিলাম হঠাৎ। সে সময় সে পরিবর্তনটাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। আমি ভাবতাম আমার প্রথম জীবনের মৃত্যু হয়েছে। শুরু হয়েছে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া আরেক দ্বিতীয় জীবন। আমি দ্বিতীয় জীবনটাকে মানতে পারছিলাম না । আসলে আমিই মানতে চাইতাম না। বরং সে জীবন শেষ করে দিয়ে বা সেই দূর্বিসহ স্টেজটাকে পেরিয়ে তৃতীয় জীবনে মানে মৃত্যুর ওপারের দেশে চলেও যাবার চেষ্টা করেছি আমি বারবার। কিন্তু রূপকথার আগমন আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছে। রুপকথাকে নিয়ে আমি আবার বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। মৃত্যুর ওপারে নয় জীবনের এপারেই না হয় শুরু হোক আমার তৃতীয় জীবন একরাশ স্বপ্ন সাথে নিয়ে। রূপকথা নামের একটি কুঁড়ির মাঝে প্রোথিত হোক আমার স্বপ্নের বীজ। আমার অকথিত গল্প।
আর তাই রুপকথাকে নিয়েই তৃতীয় জীবনের পথে পা বাড়ালাম আমি ......
আগের পর্বগুলি-
দ্বিতীয় জীবন- ১ম পর্ব
পাথরকুঁচির জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আগের অংশটুকু -২য় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের দিন ও রাত্রীগুলো - তৃয় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের স্বপ্ন ও কান্নারা -৪র্থ পর্ব
পাথর চোখে দেখা পাথরকুঁচি জীবন- ৫ম পর্ব
পাথরকুঁচি ও একটি কুঁড়ি -৬ষ্ঠ পর্ব
পাথরেও ফোটে পাথরকুঁচির ফুল- ৭ম পর্ব
পাথরকুঁচি ও একটি রুপকথা- ৮ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪১